Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গবেষণা প্রতিবেদন: হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকেরা

| প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : তৈরি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ১২৬ জন কর্মক্ষেত্রে মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন। আর যৌন নির্যাতনের শিকার হন ১৮ জন। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন যথাক্রমে ১০৬.৫ এবং ৩০ জন। ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কর্মরত ১৫০ জন নারী শ্রমিকের ওপর দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে তৈরি পোশাক খাতের নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা ‘কর্মজীবী নারী’ আয়োজিত একটি সেমিনারে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) প্রফেসর জাকির হোসেন ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাফিজ আহমেদ এ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্কার্স সেফটি ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন।
জাকির হোসেন মূল প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, বেশির ভাগ নারী পোশাক শ্রমিক কাজে যোগ দেওয়ার সময় নিয়োগ সংক্রান্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত। ১৫০ জনের মধ্যে ৫১.৩ শতাংশ (৭৬ জন) বলেছেন, তারা নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, পে ¯িøপ, সার্ভিস বই, উপস্থিতির কার্ড পান না। এর অর্ধেকই (৫০ শতাংশ) দৈনিক ৯-১০ ঘণ্টা কাজ করেন। বাকি অর্ধেক নারী শ্রমিক দৈনিক ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। ২৭.৩ শতাংশ বলেন, তারা গড়ে দৈনিক তিন ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় কাজ করেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত সময়ের এ কাজ করেন না। বরং অনেক সময় তাদের বাধ্য করা হয়।
তৈরি পোশাক কারখানায় কাজের ধরন অনুযায়ী বিশ্রাম একটি অংশ হলেও ৭০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক বলেছেন, তারা বিশ্রামের সময় পান না। ৭৪ শতাংশ নারী শ্রমিকের রাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। জরিপে অংশ নেওয়া ২৫ শতাংশ নারী শ্রমিকেরা বলেন, তারা সব সময় সাপ্তাহিক ছুটি পান না।
কারখানার নারী শ্রমিকেরা শারীরিক, মানসিক, মৌখিক এবং যৌন হয়রানির শিকার হন। ৮৪ শতাংশ (১২৬ জন) উত্তরদাতা নারী বলেন, তারা মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন। মৌখিক নির্যাতন বলতে তারা কর্তৃপক্ষ ও সুপারভাইজার কর্তৃক বকাঝকা এবং নিজেদের ও মা-বাবা তুলে গালাগাল করা বুঝিয়েছেন। মানসিক নির্যাতন বলতে তাঁরা বকাঝকার পাশাপাশি কাজ থেকে ছাটাইয়ের ঝুঁকি বোঝান। এ ছাড়া কাজের চাপ ও টার্গেট পূরণ এবং এই টার্গেট পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কারখানা থেকে বের হতে না দেওয়াকেও মানসিক নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ করেন।
২০ শতাংশ (৩০ জন) নারী শ্রমিক শারীরিক নির্যাতন এবং ১২ শতাংশ (১৮ জন) যৌন নির্যাতনের শিকার হন। শারীরিক নির্যাতন বলতে তারা চড় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় (মুখ, মাথা, পিঠে এবং গলায়) ধাক্কা দেওয়া বোঝান। এবং যৌন নির্যাতন বলতে বেশির ভাগ নারী শ্রমিক তাঁদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় (মুখ, গলা, মাথা, পিঠ) অপ্রত্যাশিতভাবে হাত দেওয়া এবং গালাগালকে বোঝান।
নারী শ্রমিকদের ওপর করা গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, শ্রম আইন অনুযায়ী নির্ধারিত চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না। অনেক সময় গর্ভবতী হওয়ার পর অনেক নারী শ্রমিকের কাজ চলে যায়। তা ছাড়া মাসিক চলাকালীন তারা আগে চলে যাওয়া, কাজের কম চাপ এবং বসে কাজ করা এবং ওষুধ ও স্যানিটারি ন্যাপকিনের সুবিধা পান না।
প্রফেসর জাকির হোসেন মূল প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য, তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত নারী পোশাকশ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা। এ প্রতিবেদনে নারী পোশাকশ্রমিকদের শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা-নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা, বিশ্রাম ও ছুটি, কর্মপরিবেশ, কল্যাণ ও সামাজিক সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের উপস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে নারী পোশাকশ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পেশাগত অগ্রগতির প্রত্যাশার চিত্রও উঠে আসে।
জাকির হোসেন বলেন, দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে দেওয়া সুবিধাগুলো এসব কারখানার নারী শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না। এ প্রতিবেদন তৈরিতে যাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, তারা ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় (৬৪টি) অন্তত এক বছর ধরে কাজ করছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের একটি অবস্থার ধারা বা প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে।
সেমিনারে বক্তাদের কয়েকজন পোশাকশিল্পে উৎপাদন বাড়াতে এবং মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে পোশাকের দাম নির্ধারণে পোশাক মালিকদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
কর্মজীবী নারীর সভাপতি এবং ঐক্য সিএসও (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন) প্ল্যাটফর্মের সদস্য প্রতিমা পাল মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদ, কেয়ার বাংলাদেশের প্রতিনিধি নাদিয়া আফরিন শামস, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক, আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সহমহিলা সম্পাদক হামিদা খাতুন, গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি লিমা ফেরদৌস, রেডিমেড গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি লাভলি ইয়াসমিন প্রমুখ।



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Alam Khan ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৯:৩৪ পিএম says : 0
    গার্মেন্ট মহিলা শ্রমিকদের বাংলাদেশে কোন উন্নতি হবার আশা খুবই কম কারন তাদের ফেডারেশনের নেতারাই বাধার কারন এটাই প্রকৃত সত্য। এদের বেশীর ভাগ নেতা/নেত্রী নিজেদের আখের গুছাতেই সবসময় ব্যাস্ত থাকে। এরা বিদেশী টাকায় ঢুবে আছে তাই এরা সাধারন শ্রমিকদেরকে সামনে রেখে এদের স্বার্থ আদায় করছে। এখানে একজন জাতীয় ফেডারেশনের সভাপতি যিনি ধর্ষন মামলার আসামী হয়ে পয়সা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করেছেন আবার তিনি একজন মহিলা শ্রমিক নেত্রী যে তারই একজন সহযোগী হিসাবে পরিচিত প্রায়ই তারা দু’জন বিদেশ ভ্রমণ করত এক সঙ্গে কিন্তু মতের অমিল হওয়ায় সেই মহিলা শ্রমিকে শারীরিক ভাবেও পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। শুনা যায় পয়সার কারনে এখন আবার তারা এক হয়েছে। এই যদি হয় বড় বড় নেতা/নেত্রীদের আচার ব্যাবহার তাহলে কিভাবে সাধারন শ্রমিকরা তাদের অত্যাচার অবিচার থেকে রেহাই পাবে। আরো শোনা যায় এসব নেতারা নিয়মিত ভাবে গারমেন্ট মালিক ফেডারেশন থেকে মাসোহারা তুলেন। তারপর আবার কোন শ্রমিক ঝামেলা হলে সেখানেও এসব নেতারা লক্ষ লক্ষ টাকা খেয়ে মালিকের পক্ষে কাজ করে দেয়। আরো শোনা যায় মালিকরা কোন শ্রমিক বাদ দিলে পাওনা টাকার জন্য মামলা হয় এবং শ্রমিকরা মামলা খরচও দেয় তারপর আবার ২৫% এসব নেতাদেরকে দেয় টাকা পাবার পর। ফলে দেখা যায় তাদের পাওনা ৫০০০০.০০ হলে পায় ২০০০০.০০ টাকা, মামলা চলে ৫/৬ বছর। আবার এসব শ্রমিক নেতা চাকুরি যাবার একমাসের মধ্যে শ্রমিককে ১০০০০.০০ থেকে ১৫০০০.০০ টাকা মালিকের সাথে সমঝোতা করে পাইয়ে দেয়। শোনা যায় এখানেও শ্রমিক নেতা মালিকের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ টাকা নিয়ে আপোষ রফা করিয়ে দেয়। কাজেই যতদিন না এসব শ্রমিক নেতা/নেত্রীদে স্বভাব চরিত্র পরিবর্তন হচ্ছে ততদিন শ্রমিকদের ভাগ্য এভাবেই চলবে এটা সত্য। এসব নেতাদের মাথায় আবার বাম রাজনৈতিক দলের হাত রয়েছে বলেও শুনা যায়। বলতেগেলে রাজনৈতিক বাম দল্গুলি এসব নেতাদের পাঁশে থাকে তাই এরা অন্যায় কাজ করার পরও এদের কোন কিছুই হয়না এটাও সত্য। এখন একমাত্র আল্লাহ্‌র উপরই এসব শ্রমিরা নির্ভর করে আছেন। দুর্বলদের এটাই একমাত্র আশ্রয়ের যায়গা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রতিবেদন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ