বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ১৬ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশ মুদ্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়ে ফিলিপাইনে পাচার হয়ে যায়। এ নিয়ে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা আছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। সবকিছুই যেন হচ্ছে দায় সাড়াভাবে গতানুগতিকভাবে। গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি, তদন্ত চলছে, কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অপসারণ বা বদলি হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষের মনে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নানাবিধ প্রশ্ন থেকেই গেছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ও আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, ঘটনাটি ঘটে যাবার মাসাধিক পর বিষয়টি দেশবাসী জানতে পারে। এটি যখন বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারেন তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ভারতে এক সফরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে ১৫ মার্চ ১৬ প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন। পদত্যাগের পর নিজ বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘তিনি স্বেচ্ছায় বীরের বেশে পদত্যাগ করেছেন’। পদত্যাগ পত্র দাখিল করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবার পথে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “দেশের স্বার্থে পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি যদি পদত্যাগ করতে বলেন, তাহলে আমি পদত্যাগ করবো। তাতে যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভালো হয়, দেশের ভালো হয়, তাহলে পদত্যাগ করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নিয়ে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে না জানানোর জন্য আমার ভুল হয়ে থাকলে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাই”। তার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আতিউরের পদত্যাগ একটি সাহসী পদক্ষেপ। যা নৈতিক মনোবল ও সৎ সাহসের বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে”।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা হয়েছিল। এরমধ্যে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার ঠেকানো গেছে। বাকি ১০১ মিলিয়ন ডলার হ্যাকের মাধ্যমে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় চলে যায়। এরমধ্য থেকে শ্রীলঙ্কায় পাচার করা ২০ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঠেকানো গেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়। বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ অর্থ উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে যাওয়ায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পেতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে।
ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক জালিয়াতি হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত ব্যাংক বেসিকে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার দায় দায়িত্ব গভর্নরও এড়াতে পারেন না বলে আগেই অভিযোগ উঠেছিল। আর শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়ার জন্য ড. আতিউরকে দায়ী করেন অনেকে। আর তাতে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন নেমে আসে। আর এজন্য বিনিয়োগকারীরা দোষী মনে করেন তাকে।
ড. আতিউর রহমান তার পদত্যাগ পত্রে উল্লেখ করেছেন যে, গত ১ মার্চ রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। পদত্যাগের পর গুলশানে নিজের বাসভবন গভর্নর হাউজে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি ছিল অনেকটা ভূমিকম্পের মতো। কোন দিক থেকে এসেছে, কে করেছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। প্রথম যখন আমাকে বলা হলো, আমি খুবই পাজল্ড ছিলাম...। পুরো ব্যাপারটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে তারপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’ বিশ্বের ইতিহাসে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির এত বড় একটি ঘটনা প্রায় একমাস গোপন করে রাখার বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে ভালোভাবে নেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ নিয়ে দলীয় ও মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘আগে জানালেও পরিস্থিতি বদলাত না’।
উল্লেখ্য, ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়। চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখায় ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে অর্থের বড় অংশ চলে যায় দেশটির ক্যাসিনোতে। আবার ক্যাসিনোতেও সেই অর্থ ছিল আরও ২০ দিন, ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থ চুরির পুরো ঘটনাটি বাংলাদেশে গোপন রাখা হয়। আর গোপনীয়তার মধ্যেই অর্থ সরিয়ে ফেলা সহজ হয়। ফিলিপাইনে এ ঘটনা তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যেরভিত্তিতে সেখানকার সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে এ চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থ চুরির পরপরই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশ করা হলে ফিলিপাইনের ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে তা আটকে ফেলা যেত বলে অনেকেই মনে করেন। ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোসকে অর্থ পাচারে সহযোগিতার জন্য দায়ী করা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহার ভাষায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। হ্যাক হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম। যেখানে থেকেই হ্যাকড হোক, প্রযুক্তি বলছে যে ভাইরাস ইনফেকশন অথবা অভ্যন্তরীণভাবে পিন কোড না দিলে এই অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব নয় (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ মার্চ ২০১৬)। যদিও চরম দুঃখজনক ও অবাক করার বিষয় হলো যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা নিয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করার পর নিখোঁজ হন তথ্য-প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা। ১৭ মার্চ রাত ১টা থেকে তিনি নিখোঁজ। রাজধানীর ভাসানটেক এলাকায় জোহাকে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা একটি গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর থেকে জোহার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ বিষয়ে থানা পুলিশও কোনো অভিযোগ নেয়নি। অবশ্য অত্যন্ত সুখের বিষয়ে যে, বিষটি নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হলে গত ২২ মার্চ গভীর রাতে জোহাকে তার বাসায় ফেরত দিয়ে যান অজ্ঞাত ব্যক্তিরা।
জোহার নিখোঁজ (অপহরণ?) হবার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রির্জাভের অর্থ চুরির হোতাদের সম্পর্ক থাকার বিষয়টিকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ জোহা অপহৃত হবার আগে অনেক কথা বলেছেন, যা একটি মহলকে হয়তো ক্ষুব্ধ করেছে। কারণ ১৮ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ‘সেই জোহা নিখোঁজ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করে, দেশের বাইরে থেকে হ্যাকাররা অর্থ চুরি করেছে। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ব্যাংকের ভেতরের চ্যানেলের লোক ছাড়া শুধু বাইরে থেকে কারও পক্ষে এ বিশাল অর্থ চুরি করা সম্ভব নয়। জোহা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ’ নামক প্রকল্পের পরিচালক (অপারেশন) ছিলেন। প্রকল্পটি দুই মাস ধরে বন্ধ আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্ত শুরু করলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। তিনি ১৩ মার্চ বিকালে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও সেখানে যান। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওই সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দীর্ঘ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে অর্থ চুরির ঘটনায় তদন্ত করা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সের প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালট্যান্ট ভারতের নাগরিক রাকেশ আস্তানাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রাকেশের দাবি, ঘটনাটি বাইরে থেকে ঘটানো হয়েছে। কিন্তু দেশীয় তথ্য-প্রযুক্তিবিদরা বলেন, ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই। আর এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত সব প্রমাণও তাদের কাছে আছে। এরপর ১৪ মার্চ সকালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ‘তানভীর হাসান জোহা তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের কেউ নন’। এ বিজ্ঞপ্তির পর যোগাযোগ করলে জোহা বলেন, ‘আমাকে চিঠি দিয়ে তদন্তকাজে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ১৩ মার্চ রাতেও র্যাবের তদন্ত দলের সঙ্গে আমি ছিলাম। আমি র্যাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছি এবং তদন্ত সহায়তা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘রোববার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছি এবং তদন্তে সহায়তা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘১৩ মার্চ রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে এটা নিশ্চিত হয়েছি যে, রিজার্ভের সুইফট কোডের কম্পিউটার আলাদা ছিল না। এটা সাধারণ কম্পিউটারের সঙ্গেই ছিল। এ কম্পিউটারের আলাদা কোনো নিরাপত্তা ছিল না।’ জোহা অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি নিয়ে প্রকৃত তথ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করায় একটি মহল আমার ওপর ক্ষুব্ধ। তাই তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা তদন্ত সহায়তা থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। কারণ আমি অনেক বিষয়েই প্রশ্ন তুলছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি বিদেশি নাগরিকদের তদন্তে রাখা নিয়ে আপত্তি করেছি। কারণ, আমি মনে করি হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি হোল (গর্ত) তৈরি করেছে, আর এখন বিদেশি বিশেষজ্ঞদের হাতে তদন্তের নামে তথ্য তুলে দিলে আরও বড় হোল তৈরি হবে। আমি পুরো বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও জানাতে চাই।’ তবে এর আগেই ১৬ মার্চ রাতে নিখোঁজ হয়ে যান এই তথ্য-প্রযুক্তিবিদ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১১মার্চ ২০১৬)।
ঘটনার আগে থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানজেমেন্ট ডিভিশনের ডিলিং রুমের দুটি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বন্ধ থাকায় ডিলিং রুমে কারা ছিল, সুইফট কোড ব্যবহার করে কারা কাজ করছিল সেসব তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকের সূত্র মতে, ৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফেডারেল রিজার্ভে ডলার পেমেন্টের বার্তাগুলো পাঠানো হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিলিং রুমে সুইফটের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট পরিচালন ব্যবস্থায় প্রবেশ করে বার্তাগুলো পাঠিয়েছেন কয়েকজন কর্মকর্তা অথবা হ্যাকার। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে সিস্টেমে ঢুকতে ইউজার নেম ও পার্সওয়ার্ড রয়েছে। এই পদ্ধতিতে সিস্টেমে কারা প্রবেশ করল এবং কারা বের হলো সেসব তথ্য সংশ্লিষ্ট সার্ভারে ও কম্পিউটারে থাকার কথা।
রিজার্ভের এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চুরি ও পাচারের পর প্রধানমন্ত্রীর তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেব জয় জার্মানির হ্যানোভার সিটিতে আয়োজিত সিবিট মেলায় ১৫ মার্চ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসাবে দেয়া বক্তব্যে বলেন, ‘আইসিটি খাতে উল্লেখযোগ্য এগিয়ে যাওয়ার কারণে হ্যাকারদের অন্যতম টার্গেট এখন বাংলাদেশ’। অর্থমন্ত্রী ১৭ মার্চ প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্যই জড়িত। তাদের যোগসাজশ ছাড়া এ কা- হতে পারত না।’
অপরপক্ষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার দায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও এড়াতে পারেন না। তিনি বলেন, দায়িত্বশীল পদে থাকলে, দায়িত্ব নিয়েই কথা বলতে হবে। আপনাকেও দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। এটা আপনার ব্যক্তিগত টাকা না। এটা আপনার-আমার বাবার টাকা না। এ অর্থ জনগণের অর্থ। আমাদের রাষ্ট্রীয় খাতের অর্থে হাত পড়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, অর্থমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যেকটি মানুষ সে যেই হোক কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অথচ, চরম দুঃখজনক ও লজ্জার বিষয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের এই কোটি কোটি টাকা চুরি হওয়ার পরও দেশের একজন শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী বলেন, ‘এটা তেমন কিছু না’।
গত ২৬ মার্চ ৪৫ তম মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হলো। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেখানে গণতন্ত্র পাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা থাকবে। কিন্তু চরম দুঃখজনক যে, ক্ষমতালিপ্সার কারণে দেশের গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেতে খেতে গণতন্ত্র আজ একেবারেই নির্বাসিত। বর্তমানে একদলীয় শাসন দেশের মানুষের বুকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে রয়েছে। অপরদিকে অর্থ লিপ্সার কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস প্রায়। শেয়ারবাজার এবং বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরির পর এবারে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে হাত দিয়েছে চোরের দল। এছাড়া মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। নেই কোনো স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। নেই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ আজ নিত্যদিনের ঘটনা। গোটা দেশটি আজ সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মায়ের গর্ভে সন্তানও নিরাপদ নয় সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। দেশের আজ এই নৈরাজ্যের মূলে রয়েছে গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব।
পরিশেষে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক এই নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি ও পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ ফিলিপাইনের আদালত বা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা যাতে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক ওই অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
লেখক : প্রফেসর, ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস ও সাবেক প্রো-ভিসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।