Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শোচনীয় দশায় কর্ণফুলী

| প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বেপরোয়া দখল, ভরাট ও দূষণের পরিণতি। চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক দেশের অর্থনৈতিক নদীটির চওড়া ও গভীরতা কমে আসছে। হারিয়ে গেছে অর্ধশত প্রজাতির সুস্বাদু অর্থকরী মাছ। দলিলমূলে অবৈধ স্থাপনাগুলোর হালনাগাদ তালিকা চূড়ান্ত হলেই উচ্ছেদ অভিযান, মাস্টার প্ল্যান তৈরি ও নাব্য সুরক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হবে -জেলা প্রশাসন
শফিউল আলম : কর্ণফুলী নিছক একটি ‘নদী’ নয়। দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের ধারক ও প্রাণভোমরা, অর্থনীতির লাইফ লাইন বা প্রাণপ্রবাহ হচ্ছে কর্ণফুলী। হাজার বছর পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ পোতাশ্রয় আজকের সমুদ্রবন্দর ধীরে ধীরে গড়ে উঠে কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগরের মিলিত মোহনাকে ঘিরে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। নদীর দুই তীরজুড়ে বিস্তার লাভ করে জনবসতি, কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ মহাপ্রকল্প, শিল্প-কারখানা, সওদাগরী পাড়া, সভ্যতার মেলা। প্র্রকৃতির অপার দান কর্ণফুলী। এই নদী দেশ ও জনগণকে সবই দিয়েছে উদারভাবে। কিন্তু অপরিণামদর্শী, অতিলোভী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আগ্রাসী কালোহাত খর¯্রােতা পাহাড়ী নদীটির অস্তিত্বকে করে তুলেছে বিপন্ন। বর্তমানে শোচনীয় দশায় পড়েছে কর্ণফুলী। নদীর চওড়া ও গভীরতা ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বেপরোয়া দখল, ভরাট ও দূষণÑ এই তিন কারণে ভরা যৌবন হারাচ্ছে। নেপথ্যে সক্রিয় থাকা প্রভাবশালীদের মদদে ভূঁইফোড় সংগঠন-সমিতির নামে ভূমিদস্যুরা গ্রাস করছে নদীর তীরভূমি, সরকারি জমি ও তলদেশের বালি-মাটি। ১৭টি খাল-ছরা দিয়ে আবর্জনা নিষ্কাশন, দু’শরও বেশী কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও শত শত জাহাজের তেলবর্জ্য নিঃসরণের কারণে কর্ণফুলী পরিণত হয়েছে বিশাল ভাগাড়ে। বিষিয়ে উঠেছে নদীর পানি। রঙ, স্বাদ, ঘ্রাণ বদলে যাচ্ছে। বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। মূল্যবান চিংড়িসহ অর্ধশত প্রজাতির অর্থকরি সুস্বাদু মাছ প্রায় হারিয়ে গেছে। নানামুখী আগ্রাসনে কর্ণফুলী নদীটিরও পরিণতি বুড়িগঙ্গার মতো হবে কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় চট্টগ্রামবাসীও। ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে ‘কর্ণফুলী নদী বাঁচাও’ আওয়াজে সামাজিক আন্দোলন।
কর্ণফুলী নদী সুরক্ষায় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল (মঙ্গলবার) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, কর্ণফুলী নদী সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট রয়েছে। এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনাও আছে। এরজন্য সমন্বিতভাবে এবং টেকসই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদে অভিযান, মাস্টার প্ল্যান তৈরি ও নাব্য সুরক্ষাÑ এই তিনটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। আমরা তা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আমরা চাই আইনানুগভাবে অবৈধ স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদ করার পর আর যাতে কেউ ফিরে আসতে না পারে। অর্থাৎ টেকসই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ দেলাওয়ার হোসেন জানান, কর্ণফুলী নদী, তীরভূমি ও জমির অবৈধ দখল বা স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করে ২০১৫ সালে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। আর.এস জরিপ/ খতিয়ানসহ মূল যাবতীয় দলিল অনুসারে অবৈধ স্থাপনাগুলোর হালনাগাদ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এটি চূড়ান্ত হলেই অবৈধ স্থাপনাসমূহের তালিকা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হবে। এরপর জেলা প্রশাসন কর্তৃক উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও উচ্ছেদ অভিযানের খরচ বাবদ এক কোটি ২০ লাখ টাকা সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে। হালনাগাদ তালিকা সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে কর্ণফুলী নদীতীরে অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা ২ হাজার একশ’ এমনকি আরও বেশি হতে পারে বলে তিনি জানান। তবে অবৈধ দখলীকৃত ভূমির পরিমাণ সম্পর্কে হালনাগাদ তালিকা চূড়ান্ত হলে বলা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে নির্বিচারে অবৈধ দখলবাজি, ভরাট ও দূষণের কারণে কর্ণফুলী নদী তার মূল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারানোর উপক্রম হয়েছে। প্রতিনিয়তই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে নদীর গতিধারা। চট্টগ্রাম বন্দরের পুরনো জেটি-ঘাটসমূহের কিনারায় বছর বছর গভীরতা কমছে। নদীর বুকের দিকে এগোচ্ছে ঘাটসমূহ। চওড়ায় ছোট হয়ে আসছে। উজান থেকে পানির প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা হারিয়ে বর্ষায় জোয়ারে ডুবে যাচ্ছে বন্দরনগরী এবং ব্যবসা-বাণিজ্যিক এলাকা ও শিল্প-কারখানা। এককালে বন্দরের কর্মব্যস্ত ওমর আলী ঘাট, অভয়মিত্র ঘাটে চর জেগে নদী ভরাট ও মরা বন্দরে রূপ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়েছে। জাপানের সহায়তায় ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৪ বছর আগে নির্মিত মনোহরখালী মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে আর কোনো ট্রলার ভিড়তে পারে না। ফেরিঘাট থেকে সদরঘাট লাইটারেজ জেটি পর্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে পলিমাটি ভরাটের কারণে নাব্যতা কমেছে। বন্দরের মূল জেটির দিকে ক্রমশ পলিবালির আস্তর জমছে।
গতবছর ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম সফরকালে এক অনুষ্ঠানে কর্ণফুলী নদীর দুর্দশায় ক্ষোভ-অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। কর্ণফুলীর ড্রেজিং ও সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি চাই না কর্ণফুলীর অবস্থা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর মত মৃত হয়ে যাক। কারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটি। কাজেই আমাদের কর্ণফুলীর নাব্যতা যেন ঠিক থাকে সেজন্য ড্রেজিং করতে হবে। যেহেতু এখানে পোর্ট আছে। সাথে সাথে কর্ণফুলী নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। শহরের বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে যাবে সেটা গ্রহণযোগ্য না। এখানে ওয়াসার জায়গা আছে। আমি বলবো ওয়াসার জায়গায় একটা সেন্ট্রাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার জন্য। একটা সেন্ট্রাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট যদি করা হয় তাহলে এখানকার বর্জ্যগুলো সেখানে গিয়ে সেখান থেকে ট্রিটমেন্ট হয়ে নদীতে যাবে। দূষিত পানি নদীতে যাবে না। কর্ণফুলীর কোন কোন এলাকায় দূষিত পানি আসে তা চিহ্নিত করতে হবে। যেমন ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল বেল্ট আছে। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল বেল্ট থেকে দূষণ হয় কিনা, সেখান থেকে দূষিত পানি কর্ণফুলীতে যায় কিনা সেগুলোর বিষয়ে এখন থেকেই খোঁজ নিতে হবে। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করে দ্রæত ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন থেকে যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে এই নদীর ভাগ্য কি হবে তা বলা যায় না।’ অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব নির্দেশনা প্রদানের পর প্রায় এক বছর ঘনিয়ে এলেও এর দায়-দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও বিভাগগুলো এখন পর্যন্ত সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হয়নি।
কর্ণফুলী নদী গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া ইনকিলাবকে জানান, কর্ণফুলী সুরক্ষায় এ মুহূর্তে দু’টি বিষয় জরুরী। এক. দূষণরোধ এবং দুই. অবৈধ দখলকৃত স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ। কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে হলে অতীতের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। ইতিপূর্বে হাইকোর্টের প্রদত্ত যুগান্তকারী আদেশ কার্যকর করে ভূ-প্রাকৃতিক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, গতিপথ ঠিক রেখে কর্ণফুলী সুরক্ষার জন্য নদীর তীররেখা, সীমানা নির্ধারণ এবং তীর বাঁধানো প্রয়োজন। দূষণরোধে চট্টগ্রাম ওয়াসার পয়োনিষ্কাষণ ব্যবস্থা চালু, সিটি কর্পোরেশনের পয়ো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদী তীরবর্তী কল-কারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। কর্ণফুলী বাঁচলেই বন্দর বাঁচবে। এ নদী দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাÐের প্রাণস্পন্দন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক একজন প্রধান প্রকৌশলী বলেন, কর্ণফুলী ভরাট করে ভূমির ব্যবসা চলছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির দাম বৃদ্ধির সুবাদে জমির ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এই অপতৎপরতাও বেড়ে গেছে। এর পরিপ্র্রেক্ষিতে কর্ণফুলী মোহনায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল নেভিগেশনাল চ্যানেলে নিয়মিত ড্রেজিং পরিচালনা এবং উজানের দিকে হালদার চর পর্যন্ত অনতিবিলম্বে স্থায়ীভাবে তীর রেখা নির্ধারণ, রিভার ট্রেনিং ওয়াল নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরী। অতীতে কর্ণফুলী ছাড়াও উজানে হালদা নদী পর্যন্ত নিয়মিত ড্রেজিং করা হতো। বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ এবং রিভার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটকে আরও সক্রিয় করা দরকার।
চট্টগ্রামের উন্নয়নে সামাজিক আন্দোলনের সংগঠক ও পরিবেশবাদী শাহরিয়ার খালেদ জানান, দখল, ভরাট ও দূষণের কবলে পড়ে কর্ণফুলী বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে। ১৭০ কি.মি. দীর্ঘ গতিপথের কর্ণফুলী নদীর বিশেষ ভাটিতে অবৈধ দখলের মাত্রা ব্যাপক। অতীতের যাবতীয় ভূমি সংক্রান্ত দলিলাদির ভিত্তিতে কর্ণফুলী নদীর তীর চিহ্নিত করা, প্রয়োজনীয় গাইডওয়াল নির্মাণ অপরিহার্য হয়েছে। তাছাড়া অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ বালি উত্তোলন বন্ধ করে নদীর সুরক্ষা প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের অর্থনীতির দ্বার কর্ণফুলী নদী সুরক্ষার দাবি তুলে ধরে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নামে-ব্যনারে সামাজিক আন্দোলন। এরমধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী বাঁচাও আন্দোলন, জনউদোগ, পিপলস ভয়েস, নওজোয়ান, পরিবেশ আন্দোলন চট্টগ্রাম, লিড সমাজ উন্নয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন। কর্ণফুলী নদী বাঁচাও আন্দোলন গত ডিসেম্বর’১৭ই মাসে ‘কর্ণফুলী উৎসব’ পালনকালে নদী সুরক্ষায় সরকারের কাছে ২৫ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।



 

Show all comments
  • A M Mohsin Khan ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ২:০১ এএম says : 0
    Karnafulee river is the life line of the country, heart of Chittagong Port. Now the heart is sick. Land grabers should be punished. Take immediate steps to save the river.
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাম্মদ সালেহীন রিপন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৩:০৬ এএম says : 0
    কর্ণফুলী নদী বা্ঁচলে চট্টগ্রাম বন্দর বাঁচবে। তাই কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে নদীটিকে রক্ষা করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কর্ণফুলী

৮ জানুয়ারি, ২০২৩
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২
২৪ আগস্ট, ২০২২
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ