Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সংবিধান তুমি কার

প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রিদওয়ান বিন ওয়ালী উল্লাহ
কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ১৯৪৭, ’৫২, ’৬৯ আর ’৭১ আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের এক একটি আলোকিত অধ্যায়। যার প্রতিটি পাতা রক্তে রাঙানো। একেকটি পাতা কত শত ঘটনার সাক্ষী। একেকটি পাতা উল্টাই আর খুঁজে পাই আমার ভাইয়ের খুনের দাগ। আমার মায়ের আঁচলে সম্ভ্রমহানির ক্ষত। আমার বোনের আর্তনাদে আকাশের বীভৎস গোমরা মুখ, শুনতে পাই বাতাসের কান ফাটা শো শো হাহাকার।
শত অপশাসন আর শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে আমরা গড়েছি একেকটি ইতিহাস। কেড়ে এনেছি অধিকার। সত্যের হয়েছে জয়। ২৫ মার্চের কালরাতে অসংখ্য মা-ভাইবোন রক্ত, মানসম্মান, সম্ভ্রম আর জীবন বিনিয়োগ করেছে শুধু একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে। যে ফুল প্রতিটি নির্জীব আত্মাকে সজীব করে তুলবে। যে ফুলের সুগন্ধে শোষকেরা ভেসে যাবে মহাসাগরের অতল গহ্বরে।
অন্যায়কে তাড়িয়ে একটি সীমানা এঁকে দিলাম। যার সীমানা ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিমি। শুরু হলো নতুন জীবন। রচিত হলো নতুন ইতিহাস, অনেক দেরিতে হলেও পেলাম একটি নতুন সংবিধান। এ সংবিধান অঙ্গীকার করেছে আমাকে নিরাপদে রাখবে। আমার জীবনের নিরাপত্তা থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নিল সংবিধান। কিন্তু দিন যত গড়ায়, সংবিধান আমাকে ছেড়ে দূরে সরে যায়। কেন? কার কারণে? তা আমার জানা নেই।
একটি স্বাধীন দেশের নেশায় যে মা তাঁর সতীত্ব হারালো, যে মায়ের আঁচলে রক্তের দাগ সঙ্গী হয়ে গেল সেই মা আর বোন যেন আজ বড় অসহায়। কি গরিব, কি বিত্তবান! সর্বস্তরের মা-বোনেরা অসহায়! নির্যাতনের স্টিমরোলার আজ তাদের পিষে মারছে। জাহেলিয়াতকে অনেকাংশে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, ধর্ষণের ঘটনা ২০১০ সালে ৪১১, ২০১১ সালে ৬০৩, ২০১২ সালে ৮৩৬, ২০১৩ সালে ৭১৯, ২০১৪ সালে ৭৮৯টি সংঘটিত হয়। অন্য এক জরিপে এসেছে, ২০১৫ সালে এর উন্নতি হয়ে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৪৬। ১৭ মার্চ ২০১৬ এনএনসি ফাউন্ডেশন এক জরিপে উল্লেখ করেছে, গত ৫ বছরে নারী নির্যাতনের সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার। বেডরুমের কথা থাক। আমার দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বৈশাখের বর্ষবরণে নারী নির্যাতিত হয় তখন আর কি বলার থাকে?
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- হবে।’ একই সঙ্গে জরিমানার কথাও আছে। ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদ- বা মৃত্যুদ-, কমপক্ষে ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে।’
কিন্তু কই? কয়টি মামলার বিচার হয়েছে? দৈনিক যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে এসেছে, গত ১৩ বছরে ঢাকা মহানগরে বিভিন্ন থানায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০৭৫টি। সাজা হয়েছে হাজারে দুটি। আহ! আফসোস! কী সস্তা নারী জাতি! দু’হাজার ধর্ষিতা হলে সাজা হবে দুজনের! আজ মনের গহিনে প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে ভাবি, তবে আমি স্বাধীন কীভাবে? কোথায় আমার মায়ের সম্ভ্রম? কোথায় আমার বোনের নিরাপত্তা? যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার নারী হওয়া সত্ত্বেও নারীর এতটুকু নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয় না সে দেশে নারীর মর্যাদা বলতে কী থাকে? এই তিন প্রধান নারী প্রশাসকই বা নারীর মর্যাদা দানে কতটুকু সতর্ক তাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ১৯ বছরের মেয়েটিকে কে বা কারা ধর্ষণের পর হত্যা করে ফেললো? এর উত্তর আমরা জানি না। আর পাবো কিনা তাও জানি না। কে বা কারা করেছে তা তদন্তের আগে মন্তব্য করা ঠিক না। তবে আফসোস এতটুকু যে, আমার দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা অতন্দ্র প্রহরী তাদের এরিয়াতে সেই মা-বোনরাও আজ আর নিরাপদ নয়।
মানবাধিকার কমিশন কোথায়? একটি কথাও শুনলাম না। আজ বড় আফসোস লাগে! দেশ স্বাধীন হয়েছে যে মায়ের সতীত্ব হারিয়ে সে মা কেন আজ স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার মাসে ধর্ষিতা? যখন আমি স্বাধীনতা দিবসের গান বাজাচ্ছি তখনও আমার ধর্ষিতা বোনের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। আমার এ দেশপ্রেমের কী অর্থ আছে? এ লজ্জা রাখি কোথায়?
স্বাধীনতা দিবসের গানের শব্দে যখন আকাশ-বাতাস মুখরিত, তখন ধর্ষিতা মা-বোনের আর্তচিৎকারে আমি দিশেহারা। কোথাও ঠাঁই না পেয়ে যখন সংবিধানের কাছে যাই। সংবিধানও আমায় অসহায় করে অন্যদিকে অন্যকারো হাত ধরে চলে যায়। আমি তখন অশ্রু বিসর্জনে চোয়াল ভাসাই। আর ভাবি! ওহে আমার মায়ের রক্তে লেখা সংবিধান! তুমি কার জন্য?
ষ লেখক : এমফিল গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সংবিধান তুমি কার

৩০ মার্চ, ২০১৬
আরও পড়ুন