Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ঘুষ যেখানে ওপেন সিক্রেট

প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : এক যুবক বসেছিলেন পরীক্ষার হলে। কিছুক্ষণ পরেই লিখিত পরীক্ষা। পরীক্ষার জন্য কী কী পড়েছেন জানতে চাইলে ওই পরীক্ষার্থী বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না। শুধু নাম লিখতে জানি। লেখাপড়া না জানলে কীভাবে পরীক্ষা দিবেন? পরীক্ষার্থীর উত্তর, টাকা দিয়েছি। যা যা লেখার উনারাই লিখে দিবেন। কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় অবস্থিত বিআরটিএ অফিসে সরেজমিনে গিয়ে এ রকম বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থী পাওয়া গেছে যারা লেখাপড়া জানা ছাড়াই ড্রাইভিংয়ের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখানে টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সবই পাওয়া যায়। এ কাজের বিআরটিএ’র দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করার জন্য আছে শ’খানেক দালাল। ভুক্তভোগীদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দালাল ছাড়া ইকুরিয়া বিআরটিএ’তে কোনো কাজই হয় না। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বেশ কয়েকবার আকস্মিক অভিযান চালিয়ে ইকুরিয়া বিআরটিএ অফিস থেকে বেশ কয়েকজন দালালকে আটক করেন। মন্ত্রীর অভিযানের পর দু’চারদিন দালালদের তৎপরতা বন্ধ থাকে। এরপর আবার তারা সক্রিয়। এ প্রসঙ্গে সহকারী পরিচালক মহসিন হোসেন বলেন, সপ্তাহের মধ্যে দু’তিন দিন এখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। এর মধ্যে অনেক দালালই ধরা পড়েছে। কারো কারো সাজাও হয়েছে। তিনি দাবি করেন, দালালরা প্রধান গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। টাকা আদায় করে। বিআরটিএ-এর কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ না থাকলে দালালরা কী এমনটা করতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে সহকারী পরিচালক মহসিন বলেন, আগের মতো অবস্থা এখন আর নেই।
সরেজমিনে ইকুরিয়া বিআরটিএ অফিস ঘুরে দেখা গেছে, এখানে মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন বা রেজিস্ট্রেশনের নবায়ন, ফিটনেস করতে এলেই দালালরা ঘিরে ধরে। তারা প্রকাশ্যেই বিআরটিএ-এর সহকারী পরিচালক, ইন্সপেক্টর, পুলিশের দোহাই দিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে বসে। আরিফ নামে একজন ভুক্তভোগী জানান, তিনি দালাল না ধরে সরাসরি গিয়ে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ভুলত্রুটিসহ নানা অজুহাতে কয়েকবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি দালালকে নির্ধারিত ফি-এর চেয়ে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। গাড়ির ফিটনেস করতে আসা একজন বলেন, টাকা বা ঘুষ না দিলে নানা দোষত্রুটি ধরে বসেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তারাও এডি স্যার বা ইন্সপেক্টরের দোহাই দিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে বসেন। চাহিদামতো টাকা দিলে সবই পানির মতো সোজা হয়ে যায়।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় ইকুরিয়া বিআরটিএ’তে। বিশেষ করে ঢাকা মেট্রো অঞ্চলে জাল-জালিয়াতি অতীতের চেয়েও বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রথমে শিক্ষানবিশ (লারনার) লাইসেন্স দেওয়া হয়। প্রথমেই নির্ধারিত ফি-এর তিনগুণ টাকা নেওয়া হয়। এ কাজে দালালরাই সব কিছু ঠিকটাক করে দেয়। লাইসেন্সের জন্য চোখ পরীক্ষা করে একজন ডাক্তারের সার্টিফিকেটও জোগাড় করে দেয় দালালরা। নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষানবিশ লাইসেন্স পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এই পরীক্ষার তারিখের জন্যও বিআরটিএ’তে ঘুষ দিতে হয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। টাকা দিলে তাড়াতাড়ি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় পুরোপুরি সমঝোতার ভিত্তিতে। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা বিআরটিএ-এর প্রতিনিধি, পুলিশের প্রতিনিধিসহ সবাইকে ম্যানেজ করেই সবকিছু করা হয়। লিখিত পরীক্ষার সময় ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকেন না বলে কর্মকর্তাদের সামনেই দালালদের প্রবেশপত্র নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমনভাবে করা হয় যাতে শুধু টিক চিহ্ন দিয়েই ২০ এর মধ্যে ১২ নম্বর পাওয়া সম্ভব। এই টিক চিহ্ন পরীক্ষার্থীর বাইরে যে কেউই দিতে সক্ষম। গত ২ মার্চ বুধবার ইকুরিয়া বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে বসেছেন। একজন পরীক্ষার্থীর পাশে গিয়ে বসে তার কাছে পরীক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পরীক্ষার প্রশ্নের কোনো ধারণাই দিতে পারেননি বরং জানিয়েছেন, নাম ও রোল লেখা ছাড়া তিনি কোনো কিছুই লিখতে পারেন না। পরীক্ষায় পাশের বিষয়টি টাকার মাধ্যমে চুক্তি করেছেন বলে তিনি জানান। আরেক পরীক্ষার্থীও একইভাবে জানান, তিনি খাতায় শুধু নাম ও রোল লিখবেন বলে চুক্তি হয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর কে লিখবে তা না জানলেও তিনি পাস করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ওই দিন দুপুরে ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেছে, ওই দুই পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন। এ বিষয়ে বিআরটিএ-এর সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ম্যানুয়াল পরীক্ষাতে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবেই। তা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য এখনো ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি। সে কারণে সবাই পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্য বলেই ধরা হয়। তিনি বলেন, ড্রাইভিং পরীক্ষার প্রশ্নও মূলত টেকনিক্যালভিত্তিক। উত্তর সহজ। ইকুরিয়া বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাছে হরহামেশা অভিযোগ আসছে। আমরাও সারপ্রাইজ ভিজিট করছি। কর্মকর্তাদের সতর্ক করছি। তারপরেও কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লাইসেন্স বিভাগের সর্বশেষ দুর্নীতি হয় প্রাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) পরীক্ষার সময়। এখানে এক জনের পরীক্ষা আরেক জন, টাকার বিনিময়ে অযোগ্যকেও যোগ্য ঘোষণা, একাধিকবার সুযোগ করে দেওয়া, এক স্লিপে একাধিক লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে কৌশলে ব্যস্ত রাখা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক, ইন্সপেক্টর, পুলিশের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যস্ত রাখেন। এই ফাঁকে দূর থেকে ‘পাস’ বলে টাকার বিনিময়ে অযোগ্যকেও যোগ্য ঘোষণা করা হয়। সরেজমিনে গিয়ে সেসব দৃশ্যও চোখে পড়েছে। আলাপকালে দালালরাই দাবি করেছেন, তাদের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এখানকার কর্মকর্তারা। বিশেষ করে ঢাকা মেট্রোর একজন কর্মকর্তা যিনি ইতোমধ্যে পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিচালক হয়েছেন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার সাথে দু’জন ইন্সপেক্টরসহ আরও ক’জন আছেন। যাদের নাম সবারই জানা। আব্বাস নামে এক দালাল বলেন, বিআরটিএ’তে ঘুষের কারবার হয় এটা আবার নতুন কী, এটাতো ওপেন সিক্রেট।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঘুষ যেখানে ওপেন সিক্রেট

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ