Inqilab Logo

সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নির্বাচনের বছর শুরু হলেও রাঙামাটির রাজনীতিতে ভোটের হাওয়া তলানীতে

| প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রাঙামাটি থেকে সৈয়দ মাহাবুব আহামদ : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে চলছে নতুন হিসাব-নিকাশ। দেশের অন্যান্য সমতল এলাকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভৌগলিক অবস্থান আর বিশেষায়িত এলাকা হিসেবে পরিচিত পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে আগাম প্রস্তুতি বেশ জোরেশোরে নিলেও এখানকার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে এখনো নির্বাচনের কোনো আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি নির্ভর পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে বইছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির হিমেল হাওয়া। জাতীয় সংসদের ২৯৯ নম্বর এ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নানামুখি তৎপরতা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ১০ উপজেলা ও দুই পৌরসভা নিয়ে রাঙামাটি আসনের জনসংখ্যা ছয় লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে সর্বমোট চার লাখ ১১ হাজার ৭৭৪ জন ভোটারনির্ভর এই জেলায় পুরুষ ভোটার রয়েছেন দুই লাখ ১৭ হাজার ৭০৪ জন। বিপরীতে নারী ভোটারের সংখ্যা এক লাখ ৯৪ হাজার ৭০ জন। পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ভ‚ক্ত রাঙামাটিতে বর্তমানে প্রায় সমান সমান অবস্থানে রয়েছে ভোটাররা। বিগত সংসদ নির্বাচনে এই অঞ্চলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করে নতুন আঙ্গিকে নিজেদের অস্থিত্বের জানান দিয়ে পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের জন্ম দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস।
অনিবন্ধিত দল হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করে পাহাড়ের ক্ষমতার চেয়ার দখলে নেয় দীর্ঘ বছর পাহাড়ি অরণ্যে গেরিলা জীবন যাপনকারী দল জেএসএস। গণতন্ত্রের ধারায় নিজেদেরকে অন্তর্ভূক্ত করেই আঞ্চলিক এই দলটি ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনপূর্বক কলাকৌশল আয়ত্ব করে নিজেদের অবস্থান এবার নতুন কৌশলে কাজ করতে পারে বলে মনে করছে পাহাড়ের বিভিন্ন সূত্র। অতীতের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পার্বত্য রাঙামাটি আসনে জয়-পরাজয়ের অনেক হিসাব নির্ভর করে স্থানীয় আঞ্চলিক রাজনীতির ওপর। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তদের একসময়ে মিত্রদল হিসেবে পরিচিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের সাথে চরম দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ভোটের হিসাব নিয়ে আবারো দ্বিধাদ্ব›দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী বছরের শুরুতেই আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের উপর একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জেএসএস। কারণ জেএসএস দৃশ্যত স্বীকার না করলেও আওয়ামী লীগ বরাবরই এই হামলাগুলোর জন্য জেএসএসের দিকেই আঙুল তাক করে আসছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে একের পর এক আন্দোলন পরিচালনা করে বিষয়টি মাঠে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে যে, আগামী নির্বাচনের আগে পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে নির্বাচন হুমকির মুখে পড়বে। এই প্রেক্ষাপটে গত নির্বাচনের সংসদীয় আসন আয়ত্তে নেয়া জেএসএস নির্বাচনী মাঠে যে সুবিধাজনক অবস্থানটি অর্জন করেছিল তার অনেকটাই মিঁইয়ে পড়েছে। কারণ ইতোমধ্যে মানুষ পেশিশক্তির বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থান জানান দিতে শুরু করায় দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পড়ে গেছে জেএসএস।
পাহাড়ি এই অঞ্চলে স্বাধীনতার পর স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী সময়ে রাঙামাটি আসনটির দখলে ছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর হাতে। ৯১ ও ৯৬ সালে এই আসনে দলটির হেভিওয়েট প্রার্থী দীপঙ্কর তালুকদার বিজয়ী হয়ে আসলেও রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ২০০১ সালে এই আসনেও বিজয়ী হয় বিএনপির প্রার্থী মনি স্বপন দেওয়ান। এরপর ২০০৮-এর নির্বাচনে সেই পুরোনো আসনটি আবারো নিজেদের দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী এই দলটি টানা দুইবারের ক্ষমতার মসনদে থাকার সময় দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে প্রথমবারের আঞ্চলিক রাজনীতির কাছে হোঁচট খায়। এতে গণতন্ত্রের সিঁড়িতে প্রথমবারের মতো পা রাখে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনকারী দল জেএসএস। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে জয়ী হওয়া জেএসএসকে বর্তমানে অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে করেই আগামী নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সাম্প্রতিক সময়ে চুক্তি সম্পাদনকারী আওয়ামী লীগ ও জেএসএসের মধ্যেকার রাজনৈতিক দ্ব›েদ্ব উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পাহাড়ের রাজনৈতিক গরম হাওয়ায় রাঙামাটি আওয়ামী লীগের নানামুখী তৎপরতা ও জেএসএস বিরোধী অবস্থানে উৎকণ্ঠিত এখানকার ভোটাররা।
গত দুটি সংসদ নির্বাচনের ফল পর্যালোচনায় দেখা যায়। দশম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেএসএসের উষাতন তালুকদার ৯৬ হাজার ২৩৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী আওয়ামী লীগের দীপঙ্কর তালুকদার ৭৭ হাজার ৩৮৫ পান। অবশ্য ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তবে অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে জেএসএসের এমএন লারমা (সংস্কার) ২৪ হাজার ৩৫২, বাঙালি সংগঠনের হয়ে অ্যাডভোকেট আবছার আলী পাঁচ হাজার ৩৯৫, ইউপিডিএফ সমর্থিত সজিব চাকমা এক হাজার ২৪৩ এবং জাতীয় পার্টির রূপম দেওয়ান পান মাত্র ৯২৪ ভোট।
নবম সংসদ নির্বাচনে জেএসএস প্রথম প্রার্থী (স্বতন্ত্র) দেয় উষাতন তালুকদারকে। সেবার তিনি ৫১ হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। ওই নির্বাচনে আইনি জটিলতার কারণে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেননি অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান। ফলে তার সহধর্মিণী মৈত্রী চাকমা ৫৬ হাজার ৪২৯ ভোট পেয়ে হন দ্বিতীয়। আর আওয়ামী লীগের দীপঙ্কর তালুকদার এক লাখ ১৪ হাজার ৯৭২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পান পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর। ওই নির্বাচনে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) অবস্থান নিয়েছিল ‘না’ ভোটের পক্ষে। এতে প্রায় ৪৫ হাজার ভোট পায় সংগঠনটি।
এই হিসাব অনুযায়ী ভোটের রাজনীতির কৌশলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমান্তরালভাবেই বিবেচনায় থাকে জেএসএস ও ইউপিডিএফ। আগামী নির্বাচনে সংগঠন দুটির একক প্রার্থী না দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে দল দুটি কার পক্ষে কাজ করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে দৃশ্যত জনসংহতি সমিতি নির্বাচনের মাঠে সোচ্ছার না থাকলেও তারা সরকারের উচ্চ মহলে এই আসনটি তাদের অনুক‚লে ছেড়ে দেয়ার জন্য লবিং তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই লবিংয়ে ইদ্ধন দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীরই খুব কাছের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। যদি ঘটনাচক্রে সে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত জনসংহতি সমিতির অনুক‚লে যায়, এখানকার তৃণমূল রাজনীতিতে আগুন জ্বলবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে বিষয়টিকে বেশ পাশ কাটিয়ে পাহাড়ের রাজনীতের নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ব্যাপকভাবে সাংগঠনিক কার্যকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিগত দিনের ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদারকেই একমাত্র দলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইলেও জেএসএস বিরোধীরা সর্বোপরি বিগত কয়েক বছরে মন্ত্রীসভা থেকে দূরে রাখায় দীপঙ্করের বিকল্প চিন্তাও কেন্দ্র যে এক্কেবারে করছে না; সেদিকে ইঙ্গিত মিলছে। সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দলটির পক্ষ থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকা নিখিল কুমার চাকমার নাম শোনা যাচ্ছে জোরালোভাবেই।
এদিকে, আগামী নির্বাচনে জেএসএস যে কোনো মূল্যে রাঙামাটির আসন ধরে রাখতে চায়। দলটির সিনিয়র সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদার বর্তমান এমপি। তবে নানা কারণে তাকে এবার প্রার্থী দেয়ার আগে চিন্তা করবে জেএসএস। তার বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গুনেন্দু বিকাশ চাকমা ও গৌতম কুমার চাকমাকে। নিজেদের রিজার্ভ ভোট ব্যাংক থাকায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকা এই দলটি এখনো পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পর্কে কোনো বার্তা প্রকাশ না করেই কৌশল নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সংগঠনটির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
অপরদিকে, রাঙামাটি জেলা বিএনপির নির্বাচনী প্রার্থীতা নিয়ে যতরকম আলোচনাই বাতাসে উড়ে বেড়াক না কেন, শেষ সময়ে অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ানকেই দলটি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেবে বলে মনে করছে দলীয় একাধিক সূত্র। কারণ হিসেবে তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ চাকরি ছেড়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়া দীপেন দেওয়ান দীর্ঘ এক দশক অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে অদ্যাবধি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাকেই অন্যতম যোগ্যতা বিবেচনা করবে হাইকমান্ড। বিশেষ কোনো কারণে দল যদি পরিবর্তন চায়, সে ক্ষেত্রে সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মণিষ দেওয়ানকেই প্রাধান্য দেবে কেন্দ্রীয় বিএনপি এমনটিই দাবি দলের একাধিক নেতার।
প্রার্থী বাছাইয়ের এই সম্ভাবনা এখনো নিছক আলোচন পর্যায়েই সীমিত। কারণ আঞ্চলিক রাজনীতির টানাপড়েন ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সুবাদে রাঙামাটিতে এখনো ভোটের হাওয়া একেবারেই তলানীতে। দেশের অন্যান্য সংসদীয় আসনে যেখানে পাড়া কমিটি পর্যন্ত চ‚ড়ান্ত হয়ে গেছে, সেখানে রাঙামাটিতে নির্বাচনী তৎপরতার নিয়ে দলগুলোর গা ছাড়া ভাব নতুন অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ