Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

শিশুকন্যাকে নিয়ে ১১ বছর পালিয়ে থাকার পরে পুলিশের কাছে ধরা

যৌতুকলোভী স্বামীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আত্মগোপন

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বরিশাল ব্যুরো : যৌতুক লোভী স্বামীর হাতে থেকে প্রান বাঁচাতে শিশুকন্যাকে নিয়ে দীর্ঘ ১১ বছর নিজ পরিবার এবং শ্বশুড় বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে পালিয়ে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন বরিশালের জোৎস্না। শিশু সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে বেছে নিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ। স্কুলে ভর্তি করেও ক্লাস করতে দেননি মেয়ে জিবাকে। পাষন্ড পিতা যাতে কোনভাবে মেয়ে জিবাকে চিহ্নিত করতে না পারে এজন্যই সব সময় মেয়েকে আড়াল করে রেখেছে জোৎস্না। যৌতুকের এক লাখ টাকা এনে দেয়ার জন্য জোৎ¯œাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল স্বামী আহাম্মদ উল্লাহ। তাতেও খান্ত না হয়ে নির্যাতন চালিয়ে স্ত্রীর শরীরে এসিড ঢেলে দেয় সে। মেয়েকেও হত্যার হুমকি দেয় সে।
এসব কারনে নিজে ও মেয়েকে বাচিয়ে রাখতেই পালিয়ে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত সিআইডি পুলিশের কাছে ১১বছর পরে ধরা পড়ে নির্যাতিতা মা-মেয়ে। আর উদ্ধারের পরে বের হয়ে আসে যৌতুক লোভী আহাম্মদ উল­াহ মুন্সির নির্যাতনের কাহিনী। বরিশালের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বামীর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন স্ত্রী জোৎ¯œা বেগম ও মেয়ে জিবা মনি। বিচারক আনিছুর রহমানের কাছে দেয়া ২২ ধারার জবানবন্দীতে জোৎ¯œা বেগম জানায়, প্রায় ১৮ বছর আগে আহমদ উল­াহর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর যৌতুক চেয়ে বিভিন্ন সময় শারীরিক নির্যাতন চালাতো স্বামী। নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে ভাইয়ের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা এনে দেয় একবার। ওই টাকা দেখে আহাম্মদ উল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়ে তা চুলার আগুনে পুড়ে ফেলে।
এরপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য ১লাখ টাকা দাবি করে আহমদ উল­াহ। টাকা দিতে না পারায় মারধর করে মুখে ও হাতে এসিড নিক্ষেপ করে। আর ঐসব নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরেই এক পর্যায়ে কাউকে কিছু না বলে মেয়ে জিবা মনিকে নিয়ে ঢাকায় চলে যায় সে। তখন মেয়ের বয়স ছিল ৪ বছর। মেয়েকে মানুষ করতে ঢাকায় বিভিন্ন লোকের বাসায় কাজ করত সে। ভাইদের সংসারে থাকার কোন সমস্যা না থাকলেও আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলে সেখানেও পাষন্ড স্বামী হানা দিয়ে নিজ বাড়িতে এনে হত্যা করতে পারে বলে শংকিত ছিল জোৎস্না।
নিজে বেঁচে থাকার চেয়েও কণ্যা শিশু সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে সে এপথ বেছে নিতে বাধ্য হয় বলে আদালতে জানায়।
দীর্ঘ ৫বছর পর ঢাকা থেকে বরিশাল এসে মেয়েকে বুখাইনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেও স্কুলে ক্লাস করতে দেয়নি। স্কুল থেকে বই নিয়ে ঢাকায় চলে যেত সে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে বরিশালে এসে মেয়ের পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনতে বুখাইনগর স্কুলে যাবার পথে পুলিশ তাদের অফিসে নিয়ে যায়। আদালতে ও পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেয়ার সময় জোৎ¯œার একটিই আকুতি ছিল ‘স্যার আমাকে ও আমার মেয়েকে বাঁচার সুযোগ দিন। আহাম্মদ উল্লাহ যে কোন সময় আমাদের মেরে ফেলতে পারে’। একই সময়ে মেয়ে জিবা মনি (১৬) তার জবানবন্দিতে যৌতুকের টাকার জন্য মায়ের উপর বাবার নির্মম নির্যাতনের কথা জানায়। ২০১২ সালে মা তাকে নিয়ে বরিশালে এসে বুখাইনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে। ২০১৭ সালে বরিশাল এসে শায়েস্তাবাদ চরআইচার বাবার বাড়িতে গিয়ে বাবাসহ পরিবারের লোকজনের কাছে মেয়ে জিবা তার পরিচয় দেয়। এতে পাষন্ড পিতা মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে মেয়ে সেখান থেকে চলে এসে মায়ের সাথে আবার ঢাকায় চলে যায়।
এদিকে ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই কোতোয়ালি মডেল থানায় যৌতুক দাবিতে জোৎ¯œা বেগম ও মেয়ে জিবা মনিকে হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে মামলা দায়ের করে ভাই সরোয়ার খান। মামলায় চরআইচার আঃ রশিদ মুন্সির ছেলে আহাম্মদ উল­াহ মুন্সি ও তার ভাই শহিদ মুন্সি, ইউনুস মুন্সি, বোন আসমা বেগম, সালেহা বেগম ও মা জাহেদা বেগমকে অভিযুক্ত করা হয়। একই বছর ২৩ নভেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মাহাবুবুর রহমান ভিকটিম জোৎ¯œা বেগম ও তার মেয়ে জিবা মনির কোন সন্ধান না পেয়ে এবং তাদের উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে ৪ জনকে অব্যাহতি দিয়ে স্বামী আহাম্মদ উল­াহ ও শহিদকে অভিযুক্ত করে মামলার চার্জশীট জমা দেন।
২০১৭ সালের ১৬ জুলাই মামলার রায় ঘোষণার ধার্য্য তারিখে ভিকটিম জোৎ¯œা বেগম ও জিবা মনির হদিস না পাওয়ায় বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নজরে আসে। এতে ট্রাইবুনাল মামলাটিতে ‘যৌতুক দাবিতে মারপিটের অভিযোগে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হলেও উপযুক্ত তথ্য উপাত্ত না থাকায় হত্যা ও গুম সংক্রান্ত অভিযোগ প্রসঙ্গে অধিকতর তদন্ত হওয়া বিশেষ জরুরী মনে করে’। ট্রাইব্যুনাল আরো মনে করে, ‘ভিকটিম ও তার সন্তান জীবিত থাকলে অদ্যাবধি তাদের কোন হদিস পুলিশী তদন্তে উদ্ধার না হওয়ায় যৌক্তিক কোন কারন নেই’। মামলাটি রায় ঘোষণার দিনক্ষন স্থগিত রেখে সিআইডি কর্তৃপক্ষকে ‘ভিকটিম জোৎ¯œা বেগম ও জিবা মনিকে হত্যা, লাশ গুম ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে অধিকতর তদšেতর নির্দেশ দেয়া হয়’। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহানগর সিআইডি’র পরিদর্শক মোঃ ফরিদুজ্জামান তদšতকালে জানতে পারেন মা ও মেয়ে বেঁচে আছে। এরপর তাদের উদ্ধারে বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাপ করে নিশ্চিত হন জিবা এ বছর বুখাইনগর স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পরিদর্শক ফরিদুজ্জামান ওই স্কুলের উপর নজর রেখে দীর্ঘ ১১ বছর পর গত মঙ্গলবার মা-মেয়েকে উদ্ধার করে আদালতে হাজির করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ