ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গঠিত বর্তমান সরকার গত ১২ জানুয়ারি চার বছর পূর্ণ করলো। সরকারের চার বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সরকারের নানা উন্নয়ন ও সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, সরকার আবারো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কেননা সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান নেই, আরপিও তে স্পষ্ট করা আছে যে, সংসদ বহাল রেখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছোট পরিসরের একটি মন্ত্রিসভা থাকবে এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল সমূহের সংসদ সদস্যগণ সেই মন্ত্রিসভায় থাকবেন। সে অনুযায়ী বিএনপি যেহেতু সংসদের বাইরে তাই তার প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা নয়। তবে সরকার চাইলে টেকনোক্র্যাট বা উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে এমপি বানিয়ে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সময় ঘনিয়ে এলেও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি এখনও কোন মতৈক্যে পৌঁছোতে পারেনি। আদৌ সমঝোতা হবে কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। সরকারি দল সভা-সমাবেশসহ কোন কিছুতেই বিএনপিকে রাজনৈতিক স্পেস দিতে নারাজ। এদিকে বেগম খালেদা জিয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিএনপিকে নির্র্বাচনের বাইরে রাখা যাবে না। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নয় সেই নির্বাচন হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। বিএনপি নেতারাও বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি না মানলে আন্দোলনের মাধ্যমেই তা আদায় করা হবে। অপরদিকে আওয়ামীলীগ নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে এবং বিএনপি অংশ না নিলে তাদের কিছু করার নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, উভয় দলের সমঝোতা সুদূরপরাহত আর দেশ আবারো পড়তে যাচ্ছে সহিংস রাজনীতির কবলে। প্রশ্ন হলো, সংশোধিত সংবিধান সমুন্নত রাখাই কি অগ্রগণ্য নাকি দেশের মানুষকে কীভাবে সহিংস রাজনীতির হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটা দেখা বড়ো? রাজনীতি যদি জনকল্যাণ ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য হয় তবে তো সংবিধানের দোহাই দিয়ে আত্মঘাতী নির্বাচন কাম্য নয়। বরং উভয় বড় দলকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে কীভাবে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায় সেটা নিশ্চিত করাই কাম্য। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ আর রাজনৈতিক সংকট দেখতে চায় না। তারা চায় সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু পরিবেশে নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে। কেননা গত নির্বাচনের আগে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তাতে শুধু গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাই ব্যাহত হয়নি সেই সাথে ইমেজ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। তাই জনমনে শঙ্কা যদি দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা অতীতের মতো না হয় তবে সংঘাত অনিবার্য। হামলা-মামলায় জর্জরিত ও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। তাই নির্দলীয় সহায়ক সরকার প্রশ্নে তারা যদি আন্দোলনের ডাক দেয় তবে দেশ আবারো অরাজকতায় পড়তে পারে। বলাবাহুল্য যে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিএনপি এখনও দেশের অন্যতম বৃহৎ দল। এবার জনগণও ভোটাধিকার ফিরে পেতে তাদের ডাকা আন্দোলনে হতে পারে যুক্ত। সমঝোতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধান সংশোধন প্রণিধানযোগ্য। যেহেতু সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে ও ১২৩(৩)অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ পূরণের আগে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। পৃথিবীর কোন দেশেই সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের নজির নেই। এমপি পদে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর সাধারণ প্রার্থীর মধ্যে সমান সুযোগ কখনই নিশ্চিত হবে না। সমান সুযোগ নিশ্চিতে সবার আগে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানের ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণের অংশগ্রহণে। যা বর্তমান সংসদে অনুপস্থিত। কিন্তু বিগত নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছিল আর বাকি আসনগুলোতেও নামে মাত্র অর্থাৎ ৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন না হলেও সরকার বা সংসদ গঠন সম্ভব ছিল বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা। সেজন্য দেশ-বিদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে উভয় দলের সমঝোতা অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বলেছিলেন, আমরা আর বিতর্কিত নির্বাচন চাই না। আমরা সুষ্ঠু অবাধ ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতে কাজ করছি। জাতি আশা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কথা রাখবেন দেশ-জাতির কল্যাণ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এটা হয়ে যাক, অল্প সময়ের মধ্যেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া হবে। অথচ সরকারের মেয়াদ ৪ বছর পূর্ণ হয়ে গেলেও তিনি এখন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের কথা বলছেন। উপরন্তু সরকারের মন্ত্রী-এমপিগণ উন্নয়নের জিগির তুলে বলছেন, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এটা ভুললে চলবে না যে, উন্নয়নের পূর্বশর্ত গণতন্ত্র। কেননা টেকসই উন্নয়নে যেমন গণতন্ত্রের বিকল্প নেই, তেমনি এসডিজি অর্জনেও নেই সুশাসনের বিকল্প। আমাদের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। এর একটাই কারণ হতে পারে, হয় তারা আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র এই তত্তে¡ বিশ্বাসী হয়ে গেছেন। নতুবা মুখ খুললে যদি দৈত্য এসে টুটি চেপে ধরে বা গুম হয়ে যান এই ভয়ে আতঙ্কিত। জাতীয় স্বার্থে, গণতন্ত্র বিকাশে ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে, প্রয়োজনে সংবিধানে আরেকটি সংশোধনী আনতে হবে, হতে পারে সেটা নির্বাচনকালীন সরকার অথবা সহায়ক সরকার এর সংশোধনী। সেটা বর্তমান সংসদের মাধ্যমেই সম্ভব। জাতি আশা করে, সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়িয়ে ষোল কোটি মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে উভয় দলের নেতাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে সময় থাকতেই। বিএনপির সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ বের করতে হবে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে জাতিকে রাজনীতির নির্দয় শিকারে পরিণত করা কাম্য নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকার যদি সংবিধানের গো ধরে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী না হয়, তবে আবারো সংঘাতময় রাজনীতির কবলে পড়বে দেশ ও জাতি। এ ব্যাপারে উভয় দলের অস্তিত্বও পড়বে সংকটে। সুতরাং সংকট সমাধানে ঐক্যমতে আসতেই হবে। সমঝোতাতেই শুদ্ধ হোক অপরাজনীতি আর নিশ্চিত হোক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।