Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বোরো উৎপাদন বৃদ্ধিতে শুকনো বীজতলা স্থাপনে ব্যাপক সাফল্য

| প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : বোরো ধানের বীজতলা তৈরীতে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন শুকনো পদ্ধতির বীজতলা। কর্দমাক্ত বীজতলার পরিবর্তে শুকনো বীজতলা তৈরীতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে নরসিংদীর কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা। পর পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে শুকনো বীজতলা তৈরীতে ব্যাপক সাফল্যের পর এ বছর ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ-২ (এনএটিপি-২) প্রজেক্ট নরসিংদী সদর উপজেলার ১৪ টি ইউনিয়ন ও ২ টি পৌরসভার ৪০ টি কৃষি বøকের প্রায় ৪০ হেক্টর জমিতে এই শুকনো পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরী করেছে। এসব বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা জমিতে রোপন শুরু হয়েছে।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে কৃষির বয়স ১০ হাজার বছর। ১০ হাজার বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম চীন ও জাপানের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধান চাষ শুরু হয়। আর তখন থেকেই শুকনো ও কর্দমাক্ত বীজতলা তৈরীর পদ্ধতি আবিষ্কার করে মানুষ। এরপর থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শুকনো ও কর্দমাক্ত বীজতলা তৈরীর মাধ্যমে ধানের চাষাবাদ করা হতো। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানীরা উচ্চ ফলনশীল জাতের (উফশী) ধান আবিষ্কার করার পর এসব জাতের ধানের বীজতলা তৈরীতে কর্দমাক্ত পদ্ধতিকেই বেছে নেয়। পাশাপাশি শুকনো বীজতলা তৈরীর পদ্ধতিকে অবৈজ্ঞানিক আখ্যায়িত করে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। আমন, আউশ এবং বোরো ৩ মৌসুমেই কর্দমাক্ত পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরী করা শুরু হয় দেশে। উফশী জাতের ধানের মূল লিটারেচারে অধিকাংশ ধানের চারারই বয়স নির্ধারণ করা হয় কমবেশী এক মাস। কৃষি বিজ্ঞানীরা বীজতলায় উৎপাদিত এক মাস বয়সের চারা ক্ষেতে রোপন করার তাগিদ দেয়। কিন্তু আধুনিক উফশী ধান চাষে চাষীরা কখনোই এক মাস বয়সের চারা বীজতলা থেকে নিয়ে ক্ষেতে রোপন করতে পারে না। যার ফলে বীজতলায় বেশী বয়স কেটে যাবার কারণে কোন উফশী জাতের ধান কাঙ্খিত ফলন দিতে পারে না। দেড় মাস, দুই মাস, আড়াই মাস বয়সের চারা রোপন করার কারণে ধানের উৎপাদন ২৫-৩০ ভাগ কমে যায়। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহে নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা-নালা তথা প্রাকৃতি জলাশয়গুলোর পানি শুকাতে শুরু করলে এসব জলাশয়ের কিনারের কাদায় বীজতলা তৈরী করে কৃষকরা। অর্থাৎ চাষীরা কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অগ্রাণ মাস পর্যন্ত বীজতলায় চারা উৎপাদন করে। পক্ষান্তরে সেচযন্ত্র মালিকরা তাদের অর্থ সাশ্রয়ের জন্য পৌষ মাসের শেষে বা মাঘ মাসের প্রথম দিকে তাদের সেচযন্ত্র চালু করে। যার ফলে বীজতলায় চারার বয়স বেড়ে যায়। এর উপর পৌষের তীব্র শীতে ধানের চারার পাতার উপরিভাগ শুকিয়ে যায়। বীজতলা থেকে এসব অতি বয়সী ও রোগাক্রান্ত চারা তুলে নিয়ে ক্ষেতে রোপন করার ফলে ধানের উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যায়। কোন কোন জাতের ধানের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়। যার ফলে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট উফশী জাতের ধানের উদ্ভাবন করলেও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ধানের উৎপাদন কাঙ্খিত পর্যায়ে বৃদ্ধি করতে পারেনি। বইয়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার সাথে জমিতে ধানের উৎপাদনের কখনোই মিল হয়নি। ব্রি-২৮,২৯ জাতের ধানের মূল লিটারেচারে উল্লেখ করা হয়েছে এসব জাতের ধানের হেক্টর প্রতি ফলন হবে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টন। কিন্তু দেখা গেছে, জমিতে হেক্টর প্রতি ফলন ৩ থেকে সাড়ে ৩ টনের বেশী উৎপাদন খুবই কম হয়েছে। বিঘা প্রতি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ১৯ মণ, সেখানে উৎপাদন হয়েছে বড়জোর ১০/১২ মণ। ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বিনার উদ্ভাবনসহ দেশে কমবেশী ৯১ টি উফশীও হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করা হলেও দেশে খাদ্য ঘাটতি লেগেই থাকে। এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে নরসিংদী উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন ইব্রাহিম হোসেন ও মোতাহার হোসেন নামে কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: লতাফত হোসেন ও সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল হাই’র সাথে পরামর্শক্রমে শুকনো বীজতলা তৈরীর চিন্তাভাবনা করতে থাকে। পরে তারা ধান চাষীদের সাথে আলোচনাক্রমে সদর উপজেলার আমদিয়া, নুরালাপুর, শীলমান্দী ও পাঁচদোনা ইউনিয়নে পাইলটিং আকারে পলিথিন আবৃত করে শুকনো বীজতলা তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করে। নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: লতাফত হোসেন ও সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো: আবদুল হাই জানিয়েছেন, শুকনো বীজতলা একটি সফল প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে বীজতলা তৈরী করা হলে বোরো মৌসুমে উফশী জাতের ধান উৎপাদন ৯৫-৯৯ ভাগ সফল হবে। ধানের সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করার জন্যই এই শুকনো পদ্ধতির বীজতলা উদ্ভাবন করা হয়েছে। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন জানান, শকুনো বীজতলা সনাতন পদ্ধতির বীজতলা তৈরীর চেয়ে খরচ অনেক কম পড়ে। পলিথিন আবৃত বীজতলা স্থাপনে জমি তৈরী, শ্রমিক, বীজ, সার, পলিথিন এবং চারা উঠানো বাবদ প্রতি ৩ শতক জমিতে খরচ পড়ে ৩৬৫০ টাকা। পক্ষান্তরে সনাতন পদ্ধতির বীজতলা স্থাপনে খরচ পড়ে ৫০৫০ টাকা। এছাড়া বীজের পরিমাণ ৪০-৪৫ ভাগ কম লাগে। ২৫-৩০ দিনে সুস্থ, সবল চারা উৎপাদিত হয়। অধিক শীত এমনকি শৈত্য প্রবাহে চারার কোন ক্ষতি হয় না। চারা উত্তোলনে শ্রমিক খরচ কম লাগে। ১০ কেজি বীজের চারা দিয়ে ৮০-৯০ শতক জমি রোপন করা যায়। প্রতি গোছায় ২ টি চারা রোপন করলেই চারার অংগজ ও অধিক কুশি উৎপাদিত হয়। ফলন হয় ২৫-৩০ শতাংশ বেশী। তারা আশা করেন সারাদেশে এই নতুন উদ্ভাবিত শুকনো বীজতলার স্থাপন করে বোরো ধান চাষাবাদ করলে সরকারের অধিক খাদ্য ফলাও কর্মসূচী সফল হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ