Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির মুখরোচক খাবার মুড়ি-মোয়া

| প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : মুড়ি মোয়া। শীতকালে বাঙালীর এক মুখরোচক খাবার। গুড় ও মুড়ি সমন্বয়ে ঘরে তৈরী এই মুড়ি মোয়া খুবই জনপ্রিয়। যুগ যুগ ধরে বাঙালী নারী-পুরুষ রসনা তৃপ্ত করে গুড় মুড়ি মোয়া খেয়ে আসছে। আখের রস থেকে তৈরী রশি গুড় চুলায় জ¦াল দিতে দিতে চিটচিটে করে মুড়ির সাথে মেখে তৈরী করা হতো মুড়ি মোয়া। মুড়ি মোয়ার ডাইস ছিল টিনের গোল ঢাকনা। মুড়িগুলো গুড়ের সাথে মেখে পরে টিনের মুখের ডাইসে দিয়ে চ্যাপ্টা গোলাকৃতির মোয়া তৈরী করা হতো। আর এই চ্যাপ্টা গোলাকৃতির মোয়াই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় মোয়া। কিন্তু কালের চক্রে আধুনিক ফার্স্ট ফুডের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী খাবার মুড়ি মোয়া। এখন আর গাঁয়ে হেটে হেটে ডেকে ডেকে ফেরি করে কেউ মুড়ি মোয়া বিক্রি করে না। দোকানে দোকানে কেউ মুড়ি মোয়া আর সাজিয়ে রাখে না। ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই ঐতিহ্যবাহী এই মুড়ি মোয়ার নাম ভূলে যেতে বসেছে। প্রবীণজনেরা জানিয়েছেন, মুড়ি মোয়া খাওয়া বাঙালী নারী-পুরষ ও শিশুদের যুগ যুগের সংস্কৃতি। শীত এলেই কটকতারা, বটেশ^র ইত্যাদি মোটা ধানের মুড়ি আর রশিগুড় দিয়ে তৈরী করা হতো মুড়ি মোয়া। বাঙালী মহিলারা মুড়ি মোয়া বানিয়ে মাটির পাতিলে রেখে মাটির সরা দিয়ে ঢেকে রেখে দিত। এতে মাসব্যাপী মুড়ি মোয়া মচমচে তাজা থাকতো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গ্রামের বাঙালী শিশু-কিশোর খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে বাঙালী মায়েরা সকালের নাস্তা তৈরী হবার পূর্ব পর্যন্ত মুড়ি মোয়া দিয়ে শিশু-কিশোরদের শান্ত রাখতো। প্রবীণজনরা বলতেন, শীতের সকালে মুড়ি মোয়া খাওয়ার একটি বৈজ্ঞানিক কারণ ছিল। তা হচ্ছে মচমচে মুড়ি মোয়া চিবুলে শরীর গরম হতো। যার ফলে শীত কম লাগতো। একবার মুড়ি মোয়া তৈরী করলে একটি পরিবারের এক মাস চলে যেত। শিশু-কিশোর সকালের রোদে বসে শীতে কাপতো আর এই মুড়ি মোয়া খেত। রাস্তা দিয়ে হেটে গেলে দেখা যেত গ্রামের স্বল্পবসনা ন্যাংটা শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে মুড়ি মোয়া। মুড়ি মোয়ার একটি বাণিজ্যিক দিকও ছিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মুড়ি মোয়া তৈরী করে দোকানে দোকানে সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মুড়ি মোয়ার দামও ছিল খুবই কম। চাল ও গুড়ের দাম কম ছিল বলে মুড়ি মোয়ার দাম কম ছিল। দোকানদাররা সরিষার তেলের টিন কেটে আয়না লাগিয়ে মুড়ি মোয়া থরে থরে সাজিয়ে রাখতো দোকানে। মানুষ দোকান থেকে এসব মুড়ি মোয়া কিনে নিয়ে খেত। অনেকে মুড়ি মোয়া কিনে মাঠা বা গুল বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাখন নিয়ে মোয়ার ওপর মেখে খেত। এছাড়া গ্রামের বিধবা মহিলারা মুড়ি মোয়া তৈরী করে আয়নাওয়ালা টিনের ‘কাতিতে’ (তেলের টিনের অর্ধেক কেটে আয়না লাগিয়ে তৈরী করা হতো কাতি) ভরে গ্রামে গ্রামে বাড়ী বাড়ী গিয়ে ‘মোয়া রাখবেনগো মোয়া’ বলে ডাকাডাকি করতো। তখন গ্রামের মায়েরা যারা মোয়া তৈরী করতে পারতো না, তারা পাটকাঠি, ধান, চাল ইত্যাদির বিনিময়ে মোয়া কিনে রাখতো। গ্রামাঞ্চলে মোয়া বিক্রি হতো পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে। তখন বাজার-বন্দরে পিঠা বা কোন প্রকার ফার্স্ট ফুড বিক্রি হতো না। কেউ পিঠা বিক্রি করলে তার সাথে গ্রামের মানুষ সম্পর্ক রাখতো না। এখন এই মোয়ার বাজার দখল করে নিয়েছে ফার্স্ট ফুড এবং বিভিন্ন পিঠা। আলুপুরি, ডালপুরি, সিংগারা, সমুচা, চটপটি ও ফুসকাসহ আটার তৈরী বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক ক্ষতিকর খাবার মোয়ার বাজার দখল করে নিয়েছে। চিতই পিঠা, তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা ইত্যাদি পিঠাপুলিও এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব ফার্স্ট ফুড ও বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরী পিঠা খেয়ে খেয়ে মানুষ গ্যাষ্ট্রিক, আলসারসহ বিভিন্ন আন্ত্রিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ ও কিডনি রোগের মতো কঠিন অসুখে। অথচ মুড়ি মোয়া ছিল একটি স্বাস্থ্যকর মুখরোচক খাবার। যুগ যুগ ধরে এই মুড়ি মোয়া খাওয়ার পর কোন মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে এমন কোন ঘটনা জানা যায়নি। মুড়ি মোয়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার। ধান থেকে চাল, চাল থেকে মুড়ি। আখ থেকে গুড়, গুড় থেকে চিটচিটে গুড়। এ হচ্ছে মুড়ি মোয়ার উপকরণ। মুড়ি মোয়ায় কোন রাসায়নিক পদার্থ নেই। কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক খাবার বাঙালীর সংস্কৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রবীণজনরা জানিয়েছেন মুড়ি মোয়া হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে চাল ও গুড়ের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। পাকিস্তান শাসন আমল থেকে বাংলাদেশ আমলের ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সরকারগুলো খাদ্যে ভর্তুকি দিত। যার ফলে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এক কেজি চাল বিক্রি হতো ১০ আনা থেকে ১৪ আনা। গুড়ের দামও ছিল খুবই কম। এক কেজি গুড় বিক্রি হতো এক দেড় টাকা। এখন এক কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকারও বেশী দরে। এক কেজি গুড়ের দাম চিনির চেয়েও বেশী। এক কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা কেজি দরে। আর ১ কেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। গুড়েও রয়েছে ভেজাল। গুড়ের দাম বেশী বলে অসাধু ব্যবসায়ীরা গুড়ের রসে চিনি ও কেমিক্যাল মিশিয়ে ভেজাল গুড় বানিয়ে ৮০/৯০ টাকা দরে বিক্রি করছে। চিনি মিশ্রিত বা ভেজাল গুড় দিয়ে মুড়ি মোয়া বানালে তা আর মচমচে থাকছে না। মোয়া বানানোর পরপরই মোয়ার মুড়িগুলো চুপসে যাচ্ছে। যার ফলে অনেকেই এখন আর মোয়া তৈরী করছে না। তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভিন্ন গোলাকৃতির কিছু মোয়া তৈরী হচ্ছে। এই মোয়াগুলো পলিব্যাগে ভরে বাজারে বিক্রি করছে না। তবে দাম বেশী হওয়ায় সাধারণ মানুষ এসব মোয়া কিনে খেতে পারছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ