Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দলরক্ষার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং দেশরক্ষার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত ১২ জানুয়ারী ছিল আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের ৪ বছর পূর্তি। এ উপলক্ষে দেশে বা নগরীতে সরকারী কোন আয়োজন চোখে পড়েনি। তবে তার সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের চার বছর র্পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্যেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি লাইভ ব্রডকাস্টিং ভাষণ প্রচারিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি ছিল বেশীরভাগ রাজনৈতিকদল এবং ভোটারদের অংশগ্রহণহীন একটি একতরফা নির্বাচন। এক-এগারোর সেনা সমর্থিত অন্তবর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাথে দেশি-বিদেশী কুশিলবদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে জানা যায়। এ কারণেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও একটি পাতানো নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করা যায়। এমনিতেই আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনে ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে থাকে। বিএনপি ও জোট সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক রেটিং-এ পরপর তিনবার বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষস্থান দখল করে। অবশ্য প্রথম বছর বা ২০০১ সালে দুর্নীতির যে রেটিং প্রকাশিত হয়েছিল তা ছিল পূর্ববর্তী অর্থবছরেরই চিত্র। অর্থাৎ প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের(১৯৯৬-২০০১) আমলের দুর্নীতির ধারবাহিকতা জোট সরকারের আামলেও অব্যাহত ছিল। তবে যেহেতু বিএনপি ও জোট সরকারের আমলে দুর্নীতির রেটিং-এ শীর্ষস্থান লাভ করে অতএব পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগের বিএনপি বিরোধি রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় এটি। একদিকে ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর, অন্যদিকে নির্বাচনের আগে বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বহুবিধ মামলা, হুলিয়া, তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পাশাপাশি একটি পরিকল্পিত ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশনের শিকার হয় বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য ও প্রার্থীরা। এমন ত্রিমুখী আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিএনপি নির্বাচনী নীল নকশা বুঝে ওঠার আগেই তারা মাত্র ১০ ভাগ আসন পেয়ে হতবিহŸল ও দুর্বল বিরোধিদলে পরিণত হয়। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেই নিজেদের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের সব দুর্নীতির মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যদিকে বিএনপি ও ২০দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের সব মামলা আমলে নেয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার নতুন মামলায় জড়িত করা হয়। পুলিশি হয়রানি, গ্রেফতার, হুলিয়া ও গুম-খুনে বিহ্বল বিএনপি’র দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ পুর্নবার ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে নেয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেনি। জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এখনো অনুপস্থিত। নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এবং তাদের আইনসম্মত ক্ষমতার চর্চা এখনো দলীয় সরকারের ক্ষমতার নিগড়ে বাঁধা। এ কারণে দলীয় সরকারের অধীনে কোন অবাধ, নিরপেক্ষ ও ক্ষমতার প্রভাবহীন জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনের দৃষ্টান্ত খুঁেজ পাওয়া যায়না। কেউ কেউ হয়তো সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনের উদাহরণ তুলে ধরতে পারেন, যেখানে সরকারী দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিএনপি বা জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে এটুকু বলা যায়, বিরোধী দলের প্রার্থীদের জয়লাভই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া, নির্বাচন কমিশনের শক্তি-সামর্থ্য, নিরপেক্ষতার প্রমান বা মানদন্ড নয়। যে সব নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন এবং সরকারী দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন এসব প্রতিটি নির্বাচনে মাঠের পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সবক্ষেত্রেই নির্বাচনে জয়-পরাজয় এবং ভোটের ব্যাবধান কমিয়ে আনার পেছনে সরকারী প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীনদের প্রভাব অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
সব প্রত্যাশা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করেই ৫ জানুয়ারীর সেই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গঠিত দশম জাতীয় সংসদে গঠিত সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে চলেছে। চারবছর ধরেই দেশের অন্যতম জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার জোটের পক্ষ থেকে সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে এমন একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তুলতে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানানো হচ্ছে। যদিও ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট এসব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে আন্দোলনের মাধ্যমে তেমন কোন চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে যে সহিংস ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছিল এবং নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পর বিরোধি কর্মসূচিকে সামনে রেখে বালুর ট্রাক দিয়ে বিএনপি নেতার গুলশান অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা এবং বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের দেশব্যাপী সড়ক অবরোধের সময় কথিত আগুন সন্ত্রাসের বলি হয়েছে অনেক মানুষ। সেই আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংস ঘটনার দায় পুরোটাই বিএনপির কাঁধে চাপিয়ে খালেদা জিয়াসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় ফাঁসিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখা হয়েছে। বিএনপি’র আন্দোলনে এসব আগুন সন্ত্রাসের অনেক ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় মোটাদাগে বিএনপি এর দায় এড়াতে না পারলেও আন্দোলনে আগুন সন্ত্রাসের অনেক ঘটনাই রহস্যাবৃত। গোয়েন্দারাও প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করতে না পারলেও হুকুমের আসামী হিসেবে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়ে বিএনপিকে আন্দোলন থেকে আদালতমুখী রাজনৈতিক দলে পরিণত করা হয়েছে। এ সময়ে রাজপথে-ময়দানে বিএনপির সভা-সমাবেশের উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে ঘরোয়া মতবিনিময় অনুষ্ঠান আয়োজনেও বাধা দিয়েছে পুলিশ। একদিকে নিজ দলীয় কার্যালয়ে বা রাজপথে একদন্ড দাঁড়াতেই না দেয়ার কঠোর ফ্যাসিবাদি সিদ্ধান্ত অন্যদিকে সরকারের উপর কোন রকম চাপ সৃষ্টি করতে না পারার খোটা(আন্দোলনের মুরোদ নেই) আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে সর্বর্দাই শুনতে হচ্ছে বিএনপি নেতাদের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারে একের পর এক ফাঁসির রায় হাজার হাজার মামলায় লাখ লাখ নেতাকর্মীকে তটস্থ-সন্ত্রস্ত রাখা ছাড়াও অসংখ্য নেতাকর্মী গুম হয়ে যাওয়ার ভীতিকর পরিস্থিতিতে পুলিশকে মারমুখী ভূমিকায় রেখে বিএনপি ও জোটের আন্দোলনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে প্রকারান্তরে তাদেরকে সহিংস আন্দোলনে ঠেলে দেয়ারই উস্কানী দিয়েছে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশীরভাগ আসনে কোন প্রতিপক্ষ প্রার্থী না থাকা, বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া এবং বেশিরভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার বাস্তবতায় নির্বাচনের ক্রেডিবিলিটি নি:সন্দেহে প্রশ্নসাপেক্ষ। অপ্রস্তুত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাও তাৎক্ষণিকভাবে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং আলোচনা সাপেক্ষে শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতি ও নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার সেই অবস্থান থেকে সরে গেলেও অবশেষে আওয়ামী লীগের গত জাতীয় কাউন্সিলে দেয়া বক্তৃতায় তারা ৫ই জানুয়ারীর মত নির্বাচন আর চাননা, আগামীতে একটি গ্রহনযোগ্য ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। এ প্রেক্ষাপটে দেশের গণতন্ত্রকামি মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক সংলাপের আয়োজন করবে।
অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দাবী আদায়ে বিএনপি সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। আংশিকভাবে হলেও সেই ব্যর্থতার কারণগুলোও অনেকটা স্পষ্ট। একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মধ্যবর্তী নির্বাচন না দিয়ে এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য জাতীয় সংলাপ-সমঝোতার জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক আহ্বান ও চাপ অগ্রাহ্য করেও দুর্বল(?) বিএনপির সামনে মহাজোট সরকার দিব্যি বহাল তবিয়তে আছে। এটা তাদের জন্য অনেক বড় আত্মপ্রসাদের বিষয় হলেও প্রত্যাশিত জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার পরিবেশ না থাকায় গত চার বছরে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা অর্থনীতিতে ধস এবং চীন-ভারত-রাশিয়াসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণের ফলে এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের সামনে যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ছিল তা’ কার্যত হাতছাড়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিপুল উদ্বৃত্ত জনশক্তি, সস্তা শ্রমিক, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, জমির উর্বরাশক্তি, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, জনশক্তি ও গার্মেন্টের পাশাপাশি ওষুধ ও জাহাজ নির্মান রফতানীর মত বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন নতুন খাত তৈরী হওয়ার পরও গত ১০ বছরে দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগের সিকিভাগও বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে রয়েছে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা এবং তথাকথিত জঙ্গিবাদ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের অতি প্রচার। তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে অগ্নিকান্ড, রানাপ্লাজা ভবন ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ও মানিবক বিপর্যয় সৃষ্টির মত ঘটনার সাথে রাজনৈতিক বিতর্ক, একের পর এক বিদেশি নাগরিক আততায়ীর হামলায় হতাহত হওয়া এবং জননিরাপত্তায় বড় ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির নেতবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর। মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার এবং নানা শর্ত পুরণের পরও তা পুনর্বহাল না হওয়ার জন্য আমাদের প্রভাবশালী মন্ত্রীরাও এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দেশে গণতকান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটলে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সহাবস্থান ও সমঝোতার পথ ইচ্ছাকৃতভাবে রুদ্ধ করে দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অসহিষ্ণুতা, বিভক্তি ও প্রতিপক্ষ নির্মূলের হাতিয়ারে পরিণত করার অপরাজনীতিকে পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্যিক অংশিদাররা মেনে নেয়নি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের বিনিয়োগ, বাণিজ্য, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক খাতসমুহে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক খাতের প্রতিটি সেক্টরেই নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, গার্মেন্ট রফতানীর প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধস, বৈদেশিক কর্মসংস্থানে মন্দার পাশাপাশি অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দারিদ্র্য বেড়েছে। দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ, জননিরাপত্তা, সুশাসন এবং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা থাকলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি,কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্সের চাকা আরো দ্রæত গতিতে সামনে এগিয়ে যেত। নিরাপত্তাহীনতা, বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা এবং ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে প্রভাবশালীদের লুন্ঠন ও টাকা পাচারের সুযোগ না থাকলে আরো আগেই মধ্যআয়ের দেশের তালিকায় পৌছে যেতে পারত বাংলাদেশ।
নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে ৩০ অক্টোবর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে ঘোষনা দিয়েছে। অথচ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে যে ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন তার কিছুই এখনো হয়নি। বিশেষত: প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি’র সাথে আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ এখনো নেতিবাচক অবস্থানেই রয়েছে। নির্বাচনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরুর আরো ৯ মাস বাকি থাকায় এ বিষয়ে যে কোন সময়ে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব নয়। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে ৫ জানুয়ারীর(দশম সংসদ) অনুরূপ নির্বাচন না করার কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে তেমন কোন মতামত এখনো পাওয়া যায়নি। গত বছরের শেষদিকে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসনে সংলাপ বা সমঝোতার উদ্যোগ নিতে নির্বাচন কমিশনকে অনীহা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বিশেষত: সিইসি আওয়ামী লীগের সাথে সুর মিলিয়ে সংবিধান অনুসারে নির্বাচন(এমনকি আগাম নির্বাচন হলেও) আয়োজনে তাদের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছানুসারে যেনতেন প্রকারে একটি জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করাই নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য। নির্বাচনকে ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত রাখা, অবাধ, নিরপেক্ষ,সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমুলক করা যেন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। রাজনৈতিক সংলাপ বা নির্বাচনী সমঝোতা যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছাধীন বিষয়, তথাপি নির্বাচনকে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ও প্রয়াসের ঘাটতি থাকলে তা পুরণ করার কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কারো হাতেই নেই। একটি সুষ্ঠু অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য করণীয় ঠিক করতে নির্বাচন কমিশন সব পক্ষের সাথেই আলোচনা করেছে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই তাদের মতামত মৌখিক ও লিখিত আকারে পেশ করেছে। এসব প্রস্তাব ও সুপারিশ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। এসব প্রস্তাব ও সুপারিশ থেকে গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলো নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন তাদের করণীয় ঠিক করবে বলেও জানালেও অদ্যাবধি সে সব প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে তাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছেনা।
সরকারের চারবছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষনে অমিমাংসিত অনেক বিষয়ে একটি পরিস্কার ধারনা পাওয়া, শেষ বছরের প্রথম ভাষনে প্রধানমন্ত্রী প্রচ্ছন্নভাবে হলেও একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দরজা খুলবেন, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল নাগরিক সমাজ ও বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রধানমন্ত্রীর ভাষনে এ ধরনের কোন ইঙ্গিত না থাকায় পুরো জাতি হতাশ হয়েছে বলে বিএনপি’র পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়ায় জানানো হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সমঝোতা হবেই বলে মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষনে সংবিধান অনুসারে যে ’নির্বাচনকালীণ’ সরকারের কথা বলেছেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তাকে সংবিধান অনুসারেই একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌছানো সম্ভব। তা না হলে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আবারো রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছেন। ক্ষমতাসীনরা যা’ই বলুন, বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই একতরফাভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি দীর্ঘ মেয়াদি অচলাবস্থা, বন্ধ্যাত্ব ও অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিপতিত হয়েছে। দলরক্ষার জন্যই হয়তো বিএনপি ও তার জোট নির্বাচনে যেতে চায়। সংসদ বহাল রেখে বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারেও তারা আগাম হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। যে কোন ম্যাকানিজমের ইলেকশনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় গেলে একটি দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে দেশ। দেশরক্ষার জন্য একটি অবাধ গ্রহণযোগ্য ও সকলের সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার মত রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ