Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান, সংলাপের আহ্বান মির্জা ফখরুলের

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮, ৯:০৬ পিএম

নির্বাচনকালীন সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিদ্যমান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছেন, সে বিষয়ে আলোচনা করতে সংলাপ ডাকার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। নির্বাচনের বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে শনিবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন কিছু ভেবে থাকেন, তাহলে তার উচিৎ হবে এ নিয়ে সকল স্টেক-হোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া। আমার দল (বিএনপি) মনে করে, একটি আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে অর্থবহ সমাধানে আসা সম্ভব। দীর্ঘকাল যাবত সকল বিরোধী দল ও সুশীল সমাজসহ সব দলের অংশগ্রহণে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বিএনপির রূপরেখা ‘যথা সময়ে’ উপস্থাপন করা হবে বলে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জানান ফখরুল। তিনি বলেন, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান নাই। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেই নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হবে না। কারণ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারও হবে বিদ্যমান সরকারেরই অনুরূপ। তিনি বলেন, সংবিধানের ১৫তম ও ১৬ তম সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনকে পাকাপোক্ত করার একটি ব্যবস্থাই করা হয়েছে মাত্র। সংবিধান ও গণতন্ত্র সবসময় সমার্থক বা সমান্তরাল হয় না। তাই যদি হতো তা হলে হিটলার ও মুসোলিনির শাসনকেও গণতান্ত্রিক বলা যেত। কারণ তাদের শাসনও সংবিধান অনুযায়ীই ছিল।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আত্মম্ভরিতা বাদ দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জনগণের শান্তি ও স্বস্তির জন্য সকল বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে ‘দায়িত্বশীলতার পরিচয়’ দিতে আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব। সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশবাসী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিদ্যমান সঙ্কট উত্তরণে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা পায়নি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতিকে হতাশ, বিস্ময়-বিমূঢ় এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা খুবই অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাপূর্ণ, এবং বিভ্রান্তিকর। জাতি আশা করেছিল তার প্রধানমন্ত্রীত্বের এই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি যে ভাষণ দেবেন সে ভাষণে থাকবে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, জাতীয় সংকট নিরসনে একটি স্পষ্ট রূপরেখা এবং জনগণের উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য থাকবে বিভ্রান্তির বেড়াজালমুক্ত কর্ম পদক্ষেপ।
তিনি মহাসচিব বলেন, পাকিস্তানের স্বৈর সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তাঁর শাসনের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উন্নয়ন দশক পালন করেছিলেন। গণতন্ত্রহীন তথাকথিত উন্নয়ন জনগণ গ্রহণ করেনি। পরিণতিতে তাঁর মত ‘লৌহমানব’কে ক্ষমতা থেকে সমস্ত পাকিস্তানব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিতে হয়েছিল। বর্তমান সরকারও ‘উন্নয়নমেলা’ করছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস পাকিস্তানী আমলের স্বৈরশাসক ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য যে ধরনের চমকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও সেই একই পথে হাঁটছে। এ দেশের সচেতন জনগণ সবকিছু জানে ও বোঝে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের কোন মন্তব্য বাহুল্যই হবে মাত্র।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের সাথে বিশ্বব্যাংক একমত হয়নি উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, জানুয়ারি- ২০১৭ এর বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রস্পেক্টাস থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশের বেশি হবে না। অথচ অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন এই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে হবে না। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সরকারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। অথচ সরকার এ অর্থবছরে ৭.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। এ ভাবে প্রায় প্রতি বছরই প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সরকারি প্রাক্কলনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো দ্বিমত পোষণ করে আসছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, জনগণ কোন তথ্য বিশ্বাস করবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের একটি সহসম্পর্ক থাকার কথা। কিন্তু আমদানি রপ্তানি, বৈদেশিক র‌্যামিট্যান্স, ঋণ প্রবাহ প্রভৃতির সঙ্গে সরকারের প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রাক্কলনের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি করে সরকার বরাবরই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও তাই করলেন।
বিএনপি নেতা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি শ্লথ হয়ে গিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩.১ শতাংশ হলেও ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১.৮ শতাংশে নেমে আসে। যা অর্থনীতিতে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করণ ও সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রবৃদ্ধির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার ও নি¤œ আয়ের মানুষদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন হ্রাস, প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার প্রবণতা ও কর্মসংস্থানের অভাব একদিকে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানের উপর প্রতিকূল প্রভাব সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করছে।
অর্থনীতির দুর্দশার জন্য শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ভয়াবহ লুণ্ঠন, মূল্যস্ফীতি, মেগা-প্রকল্প কেন্দ্রিক ডাকাতি, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা ও সর্বস্তরে লাগামহীন ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি দায়ী বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের উন্নয়নের বয়ানকে দৃশ্যমান করার জন্য কোশেস করছে। মেগা-প্রকল্পগুলো নিয়ে গণমাধ্যম ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করছে। এ সব প্রকল্পের ব্যয় ভারত, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। সঠিক সময়ে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় একাধিকবার প্রকল্প-ব্যয় উর্ধ্বমুখী সংশোধন করতে হচ্ছে। ফলে এ সব প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে।
ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের হিসেব অনুযায়ী মার্চ ২০১৭ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৪ শত ৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ১০.৫৩ শতাংশ। ২০১৬ মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪ শত ১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ তথ্য খেলাপির হিসাবে নিলে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। হিসাবটি আঁতকে ওঠার মতো। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ অবৈধভাবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার জালিয়াতি শনাক্ত করে। এরপর একে একে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি এবং বেসিক ব্যাংকসহ দেশের অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি ও জনগণের অর্থ লোপাটের লোমহর্ষক খবর দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি বলেন,সরকার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্নতার দাবি করলেও ২০১৭ সনে লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়েছে। তাহলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হল কিভাবে? ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বন্যার ফলে খাদ্য উৎপাদনে যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণের জন্য যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে বাজারে চালসহ খাদ্যশস্যের দাম সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বাজারে পেঁয়াজ, ডাল ও সবজিসহ প্রত্যেকটি খাদ্যদ্রব্যের দাম অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, শিল্পসহ অর্থনীতির সকল খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের মানুষের রক্ত চুষে লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা বিদেশে প্রেরণ করার ফলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমে এসেছে। মানুষ নি:স্ব হচ্ছে আর বেকার সমস্যা বাড়ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু টাকা পাচার রোধে দৃশ্যত সরকারের কোন রাজনৈতিক সদিচ্ছা নাই। কারণ দেশের ভেতর বিভিন্ন ভাবে লুটপাট করে অবৈধভাবে অর্জিত এসব টাকা বিদেশে পাচার করার সাথে যারা জড়িত তাদের অধিকাংশই আওয়ামী ঘরানার লোক বা আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় ‘আগুন সন্ত্রাসে’ নিহতদের কথা বলেছেন। ঐ সন্ত্রাস আসলে কে করেছে এটা জানার আগ্রহ আমাদেরও। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য তা ছিলো এক সরকারি অপচেষ্টা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত ও প্রচেষ্টায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে তার কথা সকলেই অবগত আছেন।
এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মির্জা ফখরুল

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ