Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নতুন বছরে রাজনীতির আকাশের কালো মেঘ কাটবে কি

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নতুন বছর আসার পর থেকেই আলোচনা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। গত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সবাই যার যার মতো নতুন বছরের অনাগত দিনগুলো নিয়ে তাদের আশা নিরাশার কথা বলছেন। ২০১৮ সালকে অনেকেই নির্বাচনের বছর হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেননা, এ বছর দেশের পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনসহ বেশ কিছু নির্বাচন ও উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তাছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ বছর না হলেও এর বিশাল কর্মযজ্ঞ এবছরই শুরু হবে। ফলে ২০১৮ সালটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই।
সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী আমাদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল ধারণা করছেন যে, সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ করেই হয়তো নির্বাচনের ঘোষণা দেবে। তবে, সে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে এ নতুন বছরেই। বছরটি কি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশের বছর হবে, নাকি অস্থিরতা ও সহিংসতা কবলিত হবে- এ ভাবনা কম-বেশি সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। রাজনীতি সচেতন যারা, তারা মনে করছেন যদি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী পরিত্যাগ করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য না দেয়, তাহলে তাহলে আবারো সহিংসতার কালো মেঘ রাজনৈতিক আকাশকে ছেয়ে ফেলতে পারে।
নতুন বছরের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হলে গত বছরের পরিবেশ পরিস্থিতিকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত কয়েকটি বছরের মতো গত বছরটিও ছিল একতরফা রাজনীতির বছর। বলা যায়, রাজনীতির মাঠ ছিল সরকার তথা সরকারি দলের দখলে। বিরোধী দল বিশেষত. বিএনপি গত বছরও নির্বিঘেœ তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারেনি। যদিও বছরের শেষ দিকে এসে সরকার বিএনপির প্রতি কিছুটা সহনশীলতা দেখিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফেরার দিন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের দিন সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের সমাবেশকে কোনো রকম বাধা দেয়নি বা বিঘœ সৃষ্টি করেনি। এ দুটি কর্মসূচিতেই বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি বিএনপিকে সঙ্গত কারণেই আশবাদী করে তুলেছে।
কিন্তু সরকারের এ সহনশীলতার ধারা খুব একটা প্রলম্বিত হয়নি। কারণ পরবর্তী সময়ে আদালতে বেগম জিয়ার হাজিরার দিনগুলোতে উপস্থিত নেতাকর্মীদের পুলিশ লাঠিপেটা করেছে, আটক-গ্রেফতার করেছে, এমনকি মামলাও দিয়েছে। এমনই একদিন আদালত প্রাঙ্গণে অবরুদ্ধ নেতাকর্মীদেরকে ছাড়িয়ে নিতে কয়েক ঘণ্টা বেগম জিয়াকে তাঁর গাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট করতে হয়েছে। অবরুদ্ধ নেতাকর্মীদের মুক্ত করার পর তিনি আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেছিলেন । অভিজ্ঞজনেরা বলছেন যে, আদালতে বেগম জিয়ার হাজিরার দিন পুলিশের এ মারমুখি আচরণের অর্থ হলো ভীতি ছড়িযে দেয়া, যাতে ওইদিন নেতাকর্মীরা জড়ো না হয়। কেননা, এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ইদানিং বেগম জিয়া যেখানেই যাচ্ছেন, বিপুল লোক সমাগম হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির কোনো জনপ্রিয়তা নেই, তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে- সরকার এবং সরকারি দলের পক্ষ থেকে ক্রমাগত চালিয়ে আসা এ প্রচারণার এটা একবারে বিপরীত দৃশ্য। একই সাথে এটা সরকারের জন্য বিব্রতকরও বটে। ফলে বেগম জিয়ার উপস্থিতিস্থলে যাতে বেশি সংখ্যক লোক জমায়েত হতে না পারে, সরকার সে চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সর্বশেষ যে ঘটনাটি সরকারের মনোভাব অপরিবর্তিত থাকার প্রমাণ বহন করছে, সেটি হলো, গত ২ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিশন মিলনায়তন নিয়ে সরকারের ভেল্কিবাজী। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্ট ভবনে অবস্থান করছেন- এ অজুহাতে মিলনায়তনের মূল ফটক সারাদিন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়াও দীর্ঘক্ষণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে অবস্থান করেছেন এবং সন্ধ্যার পর গেট খুলে দিলে তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। পুলিশ এবং আইইবির পক্ষ থেকে এখন যত ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন, এটাও যে বেগম জিয়া তথা বিএনপির অনুষ্ঠানে বিঘœ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে তা আর কারো কাছে অস্পষ্ট নেই।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, দেশের রাজনীতির আকাশে আবার কালো মেঘ জমাট বাঁধছে কীনা। গত বছরের শেষ দিকের কিছু ঘটনাবলীতে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিবর্তে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার আশা যারা করেছিলেন, তারা পুনরায় হতাশা ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন। সরকার এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি শত্রæতা ভুলে গিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় অবতীর্ণ হয়ে দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে-এমন আশা অনেকেই পোষণ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা দেশের রাজনীতি আবারো সংঘাত-সংঘর্ষের আবর্তে নিমজ্জিত হওয়ার আশংকা করছেন। কেননা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। সে নির্বাচন কি সব দলের অংশ গ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, নাকি আবারো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি এক তরফা বা পাতানো নির্বাচন হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ, সরকার সংবিধানের বাইরে একচুলও যাবেনা এ ধরণের কথা সরকারের দায়িত্বশীল নেতা-মন্ত্রীরা প্রায়শই বলছেন। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই কথা বলেছেন। গত ৭ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের (বিএনপি) সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। তাতে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে নেবে, না নিলে না নেবে, সেটা তাদের দলের সিদ্ধান্ত, আমাদের কিছু বলার দরকার নেই। তবে, বিএনপি মনে হয় আগের মতো ভুল করবে না, নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্য আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে নতুন করে দূরত্ব বৃদ্ধির অশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। কেননা, যাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি ওই মন্তব্য করেছেন, সেই বিএনপি এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওইদিনই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘নাকে খত দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। বরং সব দলকে নির্বাচনে আনতে সরকারকেই বাধ্য হতে হবে। মির্জা আলমগীর আরো বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা যিনি সরকার প্রধান তার দায়।’ সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন প্রশ্নে তারা বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরণের আলোচনা করবে না, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তারা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে। অনেকাটা কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানকে শিরোধার্য করে-‘ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে..।
অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট নয় যে, তারা শেষ পর্যন্ত কী করবে। তাছাড়া নির্বাচন প্রশ্নে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্যেও অধিকাংশ সময় মিল থাকছে না। কেউ ‘দ্ব্যর্থহীন’ কণ্ঠে বলছেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আবার অন্যজন হয়তো বলছেন, শত প্রতিকূলতার মাঝেও বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশ নেবে। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন যে, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে না। বিএনপি নির্বাচনে যাবে। তবে সে নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এখন আন্দোলনের কথা বলে সরকারকে চাপে ফেলে যতোটা দাবি আদায় করা যায়, তারা সে চেষ্টা করছে। অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি যদি এবার নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে দলটি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে দলটি যে ভুল করেছে তার পুনরাবৃত্তি তারা হয়তো করবে না। আর এখানেই নিহিত রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের কঠোর অনমনীয়তার কারণ। বিভিন্ন সোর্সে তারা হয়তো ইতোমেধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, বিএনপি মুখে যতোই আন্দোলন এবং নিবাচন বয়কটের কথা বলুক শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশ নেবে।
এদিকে রাজনৈতিক জট খোলা এবং আগামী নির্বাচনকে অর্থবহ করতে দেশের প্রধান দুই দলের আগ্রহকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ। তারা বলছেন যে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যে পরষ্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে আছে তার সমাধান সংলাপের মাধ্যমেই করতে হবে। এ বিষয়ে উভয় দলকে কিছুটা হলেও ছাড় দিতে হবে। তারা অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে যে দূরত্ব প্রধান দুই দলের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, তা দূর করতে হলে দুই দলকেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।
সংলাপ বা আলোচনায় বিএনপির যতটা আগ্রহ, আওয়ামী লীগের ততটাই অনীহা। দলটির নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীরা হরহামেশাই বলছেন যে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনার প্রয়োজন নেই। এখানে ব্যতিক্রম একটি বিষয় অনেকেরই দৃষ্টিতে এসেছে। সাধারণত কোনো গুরুতর রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিলে সরকার আলোচনা বা সংলাপের জন্য বিরোধী দলকে আহ্বান জানায়। এবার ঘটছে তার উল্টোটা। সরকারের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ও বিরোধী পক্ষ বিএনপিই আলোচনায় বসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের এ আহ্বান অনেক সময় আকুলতার পর্যায়েও চলে যাচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সরকার যদি আলোচনায় না বসে তাহলে বিএনপি কি করবে, কোন পথ অবলম্বন করবে তা দলটি পরিষ্কার করছে না। সাংগঠনিক দুর্বলতাই এর কারণ বলে মনে করছেন রাজনীতি সচেতন মহল।
বছরটি কেবলমাত্র শুরু হলো। নির্বাচন কিংবা রাজনীতির বাতাস কখন কোন দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করবে তা এখুনি হয়তো বলা যাবে না। তবে, দুই দলই যদি নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে পরিবেশ পরিস্থিতি আবারো কোনো অনাকাঙ্খিত ঘর্ণাবর্তে পড়তে পারে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসে, নাকি বিএনপি নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী সরকার নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ