Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চলনবিলে সরিষার বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে মধুর হাসি

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

এক লাখ ৩০ হাজার টন সরিষা ও দুই হাজার ২০০ টন মধু উৎপাদন হবে। বাজার দর ৪১৫ কোটি টাকা
সিরাজগঞ্জসহ বৃহত্তম চলনবিল এখন নয়নাভিরাম সরিষার হলুদ ফুলের চাদরে ঢাকা পড়েছে। সে এক দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এ অঞ্চলে এবার এক লাখ ৩০ হাজার টন সরিষা ও দুই হাজার ২০০ টন মধু উৎপাদন করা হবে। আর এ সরিষা ও মধু থেকে আয় হবে প্রায় ৪১৫ কোটি টাকা যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়তা করবে।
বৃহত্তম চলনবিল অঞ্চলসহ সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের কৃষকেরা বন্যায় আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যাপকভাবে সরষের আবাদ করেছেন। চলতি মওসুমে তিন জেলায় প্রায় ৬৫ হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবী জাতের সরষের আবাদ হয়েছে। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠগুলোতে এখন সরষের হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে বিরাজ করছে থোকা থোকা হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সরষের ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছিসহ প্রকৃতিপ্রেমীদের। গোটা অঞ্চল মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মৌচাষিরা মধু আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জসহ বৃহত্তম চলনবিল অঞ্চল, পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, সুজানগর, চাটমোহর ও ভাঙগুড়া; নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, লালপুর ও সিংড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তাড়াশ, চৌহালী, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুরসহ ২৬টি উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবী জাতের সরষে চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে ২৩ হাজার ৫৭৫ হেক্টর, পাবনায় ২১ হাজার ৪২৫ হেক্টর এবং নাটোরে ১৯ হাজার ৯২৬ হেক্টরে সরষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে দুই লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টন। উল্লাপাড়া-তাড়াশ সড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। চলতি মওসুমে সরষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কৃষিসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার চরপেঁচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, চরসাফুলা, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যাণপুর, পূর্বশ্রীকণ্ঠদিয়া, পদ্মারচর, চরযমুনা, বাইরচর, শ্রীপুর, খিদ্রদাশুরিয়া, মুরাদপুর, বরাঙ্গাল, ঘোড়জান, মেঘাইরচর, খাসকাউলিয়া, মিনারদিয়াচর, যমুনারচর, ওমরপুরচর, পয়লারচর, বানতিয়ারচর, মীরকুটিয়ারচর, রোস্তমেরচর, সোলজানারচর, দইকান্দিরচর, চরআগবাঙলা, শিমুলকান্দি, বারোপাখিয়ারচর, ধীতপুর, কুশিরচর, ভুমোরিয়া, চানতারা, শিংঘুলি, নয়াহাটাবরঙ্গাইল, ভারদীঘুলিয়া, চরবলরামপুর, চরভাঁড়ারা, সাদিপুর, সুদিরাজপুর, আশুতোষপুর, কোমরপুর, বীরপুর, পীরপুর, চালাকপাড়া, হঠাৎপাড়ারচরসহ দুটি জেলায় প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরষে আবাদ হয়েছে। নয়নাভিরাম সেই সরষে ক্ষেতের আলে আলে এখন শুধুই সারি সারি মৌবাক্স। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় এ বছর সরষের আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।
বেড়া উপজেলার যমুনা নদীবেষ্টিত ঢালরচরের কৃষক আবেদ আলী জানান, এক একর জমিতে সরষে চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মণ সরষে উৎপাদন হয়। প্রতি মণ সরষের বাজারমূল্য এক হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমাণ জমিতে সরষে চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। এ অঞ্চলে সরষের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মওসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরষে যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ ছাড়া সরষের ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরষে চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। সিরাজগঞ্জের হাÐিয়াল এলাকার কৃষক রাজ্জাক জানান, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরষে আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। সাত বছর ধরে সরষে চাষ করে তিনি প্রতি মৌসুমে পৌনে দুই থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। চলতি মৌসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
এদিকে ইউরোপিয়ান হাইব্রিড মৌমাছির মধুময় গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌবাক্সে। চলতি মৌসুমে যদি আবহাওয়া অনুক‚ল থাকে তাহলে তিন জেলায় দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনি¤œ ২৫০ টাকা হিসেবে ৪৩ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। এমনটিই আশা করছেন মৌচাষিরা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরষে ক্ষেতের আলে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরষে ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।
আবদুল আজিজ জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দেড়গুণ মৌবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জেলার মৌচাষিরা। মধু উৎপাদনে (সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর) চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন তাই নয়। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরষের ফুলে পরাগায়ণ ঘটছে। তাতে সরষের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরা। শুধু তাই নয়, পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।
বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কেজি। প্রতি কেজি মধু অগ্রিম ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগতমান খুবই ভালো। এ জন্য ভারতের ডাবর কোম্পানি, ঢাকার প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ বিভিন্ন নামী দামি ব্যান্ডের প্রসাধনি কোম্পানির অ্যাজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছেন। সুন্দরবনের মধুচাষিরা এ অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে, এখানে মধু সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়েছে।
পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা জানান, আমাদের দেশে অতীতকাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে। মধুর উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গøুকোজ যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের মজুত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মধুতে রয়েছে ফলশর্করা ৩৮.২ ভাগ, গøুকোজ ৩১.৩ ভাগ, মালটোস ৭.১ ভাগ, সুক্রোজ ১.৩ ভাগ, পানি ১৭.২ ভাগ, উচ্চ চিনি ১.৫ ভাগ, ছাই ০.২ ভাগ, খনিজ পদার্থ আয়রণ, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, সোডিয়াম ক্লোরিন, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে ৩.২ ভাগ। এ ছাড়া মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য।
নাটোর থেকে চলনবিলের বারুহাঁস এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা আব্দুস সালাম বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মধু আহরণ করছেন। মাত্র কয়েক দিন হলো এখানে এসেছি। মনে হচ্ছে গতবারের চেয়ে অনেক বেশি মধু সংগ্রহ হবে। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরষের পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়। ‘পরিবর্তন’ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাড়াশ উপজেলার প্রশিক্ষিত আদিবাসী নারীরা মধু সংগ্রহ করছেন। পুংরুহালী-মুÐুমালা গ্রামের আদিবাসী নারী দীপালি বালা মাহতো বলেন, একটি রানী মৌমাছির সাথে প্রায় ৩০০ শ্রমিক মৌমাছি নিয়ে একটি কাঠের ফ্রেমের মৌবাক্স করা হয়। চলতি মওসুমে তাড়াশ এলাকায় দীপালি বালা মাহতোর মতো ৩০ জন আদিবাসী নারী মধু সংগ্রহ করছেন।
রাজশাহী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে সিরাজগঞ্জ, বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, সুজানগর চাটমোহর, ভাঙগুড়া, ফরিদপুর, নাটোর সদর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, লালপুর, সিংড়া, উল্লাপাড়া, তাড়াশ, চৌহালী, রায়গঞ্জ ও শাহজাদপুর উপজেলায় সরষের আবাদ ভালো হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার সরষের ভালো ফলন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ