হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
পৃথিবীর সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য পরম করুণাময় আল্লাহপাক চোখ ধাঁধাঁনো অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন, যার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টি পাখী। আল্লাহপাক বলেন, আমার সৃষ্টিতে কোন ‘খুঁত’ ধরতে পারবে না এবং তিনি আরো বলেছেন যে, অনর্থক আমি কোন কিছু সৃষ্টি করি নাই। এর অর্থ প্রতিটি সৃষ্টির পিছনে কোন না কোন কল্যাণকর কারণ রয়েছে। পৃথিবীতে এক প্রকার পাখী রয়েছে যারা ‘বাদুর’ নামে পরিচিত। ইংরেজিতে যাকে বলে BAT| OXFORD ENGLISH DICTIONARY-তে BAT এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে Flutter one’s eyelashes.. বাংলা একাডেমী প্রণীত English to Bengali Dictionary মতে, ‘পাখা ঝাপটানো পাখী যারা চোখে দেখে না।’ মানুষের মধ্যেও অনেক লোক রয়েছে যারা COLOUR BLIND. বিআরটিসি’র (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ সভায় জানতে পেরেছি যে, চালক COLOUR BLIND হওয়ার কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। বাদুরের মতো COLOUR BLIND-দের প্রচলিত ভাষায় ‘রাতকানা’ বলে, চিকিৎসা বিজ্ঞানমতে এটা এক ধরনের রোগ।
আমাদের দেশের সাংবিধানিক পদপদবীধারীরা বাদুরের মত রাতকানা রোগে আক্রান্ত। BLIND COLOUR রোগীদের মতো তারা কোন বিষয় ‘দেখে’ বা কোন বিষয় ‘দেখে’ না। পক্ষান্তরে দেখেও না দেখার ভান করে জনগণের সাথে করে প্রতারণা, এর অন্যতম প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন; যা সাংবিধানিক শপথের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং দুদক আইনের ৩ ধারা মোতাবেক তারা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন (!)
দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন (যদিও ‘জেহাদ’ শব্দটি ছাত্রদের পাঠ্য পুস্তকে আর থাকছে না)। তিনি কোচিং সেন্টারের দুর্নীতি বন্ধ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন, অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যকরি কমিটি গঠনে শিক্ষা বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের দুর্নীতি এবং কমিটি গঠিত হওয়ার পর কমিটি কর্তৃক স্কুলের সম্পত্তি আত্মসাতের খবর প্রতিদিন যে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে তিনি তার কি প্রতিকার করছেন? স্কুল ম্যানেজিং কমিটি গঠনে এখন আর সরকারি নীতিমালা শিক্ষা বিভাগ ও জেলা প্রশাসন অনুসরন করে না। বরং সরকারি দলের লোক হলেই হলো। স্কুল/কলেজ পরিচালনায় যোগ্যতার মাপকাঠি একমাত্র শর্ত সরকারি দলের লোক। প্রশাসন যার সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে জেলা প্রশাসক, তারা নির্লজ্জের মত এতোই দলবাজী করে যে, স্কুল পরিচালনা পর্ষদে সরকারি দলের লোক বসানোই তাদের দায়িত্ব বলে মনে করে, এমনিভাবেই প্রভূদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে।
দেশব্যাপী স্কুল/কলেজগুলি সরকারি দলের দখলে। স্কুল পরিচালনায় সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারিতার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো। গত ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকে ‘প্রতি রাতেই স্কুলের ভেতর থেকে চালক হেলপারদের হৈ চৈ আড্ডা, মাসদাইরে বেগম রোকেয়া খন্দকার উচ্চ বিদ্যালয়ের ভেতরে সভাপতির গাড়ির গ্যারেজ’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটিতে দলীয়করণের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির স্বরূপ ফুটে উঠেছে যা নিন্মরূপ:
‘নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার মাসদাইরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া খন্দকার পৌর উচ্চ বিদ্যালয়কে গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছেন স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি। সন্ধ্যার পর থেকেই স্কুল কম্পাউন্ড ব্যবহৃত হচ্ছে গণপরিবহনের গাড়ি রাখার স্থান হিসেবে। শুধু তাই নয়, ওই সকল গাড়ির চালক ও হেলপারদেরও অনেকেই রাত কাটাচ্ছেন স্কুলটির অভ্যন্তরে। প্রতি রাতেই স্কুলের ভেতর থেকে চালক হেলপারদের হৈ চৈ আড্ডার শব্দও শুনতে পাচ্ছেন আশেপাশের বাসিন্দারা। স্থানীয়দের অনেকেই এ বিষয়ে মৌখিকভাবে আপত্তি জানালেও স্কুল কমিটির সভাপতি ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি হওয়ায় এসকল বিষয়কে পাত্তাই দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, মাসদাইরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া খন্দকার পৌর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে আসীন রয়েছেন হাবিবুর রহমান হাবিব ওরফে ডিস হাবিব, নাসিকের ১৩নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি ও স্থানীয় ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক (ডিস) ব্যবসার মালিক। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টার পর থেকেই স্কুলটির মাঠে জড়ো হতে থাকে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া থেকে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর পর্যন্ত চলাচলকারী লেগুনাগুলো (হিউম্যান হলার)। ওই লেগুনাগুলোর মালিক হাবিবুর রহমান হাবিব ওরফে ডিস হাবিব ও তার লোকজন। স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার সুবাধে কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্কুলের মাঠকে গাড়ি রাখার গ্যারেজে পরিণত করেছেন তিনি। রাত অবধি যে শুধু গাড়িগুলোই থাকে এমনটি নয়, গভীর রাত অবধি স্কুলটির দু’টি কক্ষে প্রায়ই আড্ডাও দেয় লেগুনাগুলোর চালক ও হেলপাররা। এছাড়া ওই দু’টি কক্ষে হাবিবুর রহমান হাবিবের গাড়ির একজন ড্রাইভার ও একজন হেলপারও প্রতিদিন রাতযাপন করে।’
বর্ণিত বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও দুদকে অভিযোগ করেও অভিভাবক ও জনগণ কোন প্রতিকার পায়নি, কারণ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের যে ওয়ার্ডে (১৩নং ওয়ার্ড) স্কুলটি অবস্থিত সে ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতিই স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, যদিও তার কোন সন্তান ওই স্কুলের ছাত্র/ছাত্রী নয়। অথচ, জেলা প্রশাসক/দুদক এখানে বাদুরের মতই রাতকানা হয়ে গেছে।
গত ১৪ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের লাল অক্ষরে ‘অধরা থাকছে ব্যাংক লুটেরা’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ‘নজিরবিহীন ব্যাংক জালিয়াতির নায়ক বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকার খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়া সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বাচ্চুর বিরুদ্ধে। লুটপাট হওয়া টাকার ভাগ সরাসরি নিয়েছেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এবং তার পরিবারের সদস্যরা। চেয়ারম্যান থাকার সময়ই স্ত্রী শেখ শিরিন আখতার, পুত্র শেখ সাবিদ হাই অনীক ও মেয়ে শেখ রাফাহাইকে সঙ্গে নিয়ে খুলেছিলেন ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১১ মাসেই জমা হয় ১৩ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ও নগদে জমা হওয়া এসব টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া টাকা সরাসরি জমা হয়েছে বাচ্চু ও তার ভাই শাহরিয়ার পান্নার ব্যাংক হিসাবে। এভাবে ২০১২ ও ২০১৩ সালে দু’জনে মিলে ৩০ কোটি টাকার বেশি অর্থ নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন ও বাচ্চুর ব্যাংক হিসাব বিবরণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ২০১৪ সালেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে এসব তথ্য পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও দুদক কোনো মামলায় শেখ আবদুল হাইকে এখন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করেনি।’ সুপ্রীম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশন ভিন্নরায়ে ঙইঝঊজঠঅঞওঙঘ দেয়ার পর দুদক এখন বাচ্চু মহোদয়কে ডাকাডাকি শুরু করেছে মাত্র।
অনুসন্ধানী রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক। প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোকদের প্রতি দুদক বাদুরের মত ‘রাতকানা’ হয়ে পড়বে এটাইতো স্বাভাবিক। আশার কথা এই যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে উৎবুদ্ধ করার জন্য দুদক দৃশ্যমান কিছু কর্মসূচি নিয়েছে, যেমন- দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ। ‘দেশ প্রেমের শপথ নিন, দুর্নীতিকে বিদায় দিন’ এ ধরনের প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে মিটিং সিম্পোজিয়াম র্যালি করা হয়েছে। এসব করেও দুদক জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারছে না একথা দুদক চেয়ারম্যান নিজেও অকপটে স্বীকার করেছেন। দুদকের একপেশে কর্মকান্ড যতদিন পর্যন্ত বন্ধ না করবে, অর্থাৎ সরকারি দলের লোকদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে অনীহা ততদিন আস্থাশীল হবে না, হতে পারে না। সকলেই স্বীকার করেন যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমভাবে আইনের নিখুঁত প্রয়োগের মাধ্যমেই দুদক জনগণের আস্থায় আসতে পারে। ২০০৪ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি পার্লামেন্ট দুদক আইন-২০০৪ পাশ করে। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ তত্ত¡াবধায়ক সরকার দুদক বিধিমালা-২০০৭ প্রণয়ন করে। অতঃপর ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর দুদক সংশোধন আইন-২০১৩ এবং ২০১৬ সালের ২১ জুন আইনটি সংশোধন করে দুদক (সংশোধন) আইন-২০১৬ প্রণীত হয়। তারপরও দুদকের ‘পেটভরে’ না। দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমকে গতিশীল করার অজুহাতে সরকার বার বার আইনটি সংশোধন করলেও সরকার বা দুদক তাদের তথাকথিত সফলতার জন্য জনগণের আস্থা পাচ্ছে না বিধায় ভিন্ন পন্থায় তারা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
‘আইন নিজ গতিতে চলে’ এ ধারণা এখন অচল হয়ে পড়েছে। কোন দিনই আইন নিজ গতিতে চলেনি। বরং আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যার উপর তার ইচ্ছা মাফিক আইন প্রয়োগ হয়েছে। তবে ভাগ্য তার নিজ গতিতে চলে। এ জন্যই আইন প্রয়োগকারীদের স্বেচ্ছাচারিতার পরিমাণ বা পরিমাপ যখন বৃদ্ধি পায় তখনই প্রাকৃতিক নিয়মে আইন অপপ্রয়োগের কারণে তাদেরও আইনের আওতায় আসতে হয়। বিধি বাম না হওয়া পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারীরা ‘আইন’কে তাদের নিজস্ব বাহন মনে করে আইনের অপপ্রয়োগ করে বিধায়ই জনগণের আস্থায় আসতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা জনগণকে ‘বোকা’ বানিয়েই আইনের অপপ্রয়োগ করে ক্ষমতা জাহির করে যাতে জনগণের দুঃখ বাড়লেও ক্ষমতাসীনরা পতন না হওয়া পর্যন্ত সেটা বুঝে না।
জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য দুদককে প্রথমেই বাদুরের মত ‘রাতকানা’ রোগ থেকে মুক্ত হতে হবে। সরকারি ও বিরোধীদের জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। শুনেছি ‘পালং শাক’ খেলে রাতকানা রোগ ভালো হয়, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুদকের রাতকানা রোগ কোন ঔষধে নিরাময় হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটাই জাতিকে আবিষ্কার করতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।