হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
দেশে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির সম্মুখীন। সরকার বলছে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ, এমনকি দেশ থেকে চাল রফতানী হচ্ছে বলে ঢেঁডরা পিটাচ্ছে। একদিকে ধান কাটার ভরা মওসুমে একশ্রেনীর ব্যবসায়ীকে ভারত থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানীর সুযোগ করে দিয়ে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে মোটা চালের দাম অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে বেড়ে গিয়ে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। গত ৬ মাসে চালের দাম গড়ে কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়েছে। তিরিশ টাকার মোটা চাল এখন ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত ৫-৭ বছরে দেশের অর্থনীতিতে, বিনিয়োগে কর্মসংস্থানে, সাধারণ মানুষের আয় রোজগারে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। বরং এ সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান, রেমিটেন্স আয়, বৈদেশিক বানিজ্য(গার্মেন্ট রফতানী ইত্যাদি) দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা ক্রমে তীব্রতর হয়েছে। এক পদ্মাসেতু নিয়ে নানা নাটকীয়তা এবং ঢাকা- চট্ট্রগ্রামে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মান করেই সরকার দেশের মানুষের কাছে উন্নয়নের বার্তা দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পরিসংখ্যানের হিসাবে গত ১০ বছরে মানুষের আয় বেড়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল থেকে স্বল্পোন্নত বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে। কিছু মানুষ রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার মত আয়বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে লাখো মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করে নিজের পকেট ভারী ও শানসওকত বৃদ্ধি করা। একদিকে সরকার বার বার গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে দেশের দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন কর তুলেছে, অন্যদিকে সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজির কবলে ফেলে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করা হলেও দরিদ্র মানুষকে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে চাল-ডাল, তেল-লবণের মত নিত্যপণ্যের বাজারকে লাগামহীন করে তুলেছে। শুধু ভাত-রুটি খেয়েই মানুষ বাঁচেনা। সাথে আরো অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়। যে সব পন্য উৎপাদনে কৃষককে সবচে বেশী বিনিয়োগ, পরিশ্রম এবং প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের উপর নির্ভর করতে হয় তেমন সব কৃষিপন্যগুলো নিয়ে হরহামেশা কারসাজি ও সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজি করে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ করে তোলা হচ্ছে। গত বছর দেশের কৃষকরা বাম্পার আলু ফলিয়েছিল প্রতিকেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছিল কমপক্ষে ১২ টাকা। বিদেশে আলু রফতানীর কোন উদ্যোগ না থাকা এবং আলু সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না থাকায় কৃষকরা লোকসান মূল্যে ফড়িয়াদের কাছে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। আর আলু ব্যবসায়ীরা বছরশেষে লাভের আশায় বস্তাপ্রতি তিন-চারশ টাকা খরচ করে হিমাগারগুলোতে আলু রেখেছিল। বছর শেষ হয়ে গেলেও লাখ লাখ টন আলু রফতানীর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আলুক্রয়ে ও আলুর সদ্ব্যবহারে কোন সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ না থাকায় আলুর দাম বাড়েনি। ইতিমধ্যে বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করেছে। হিমাগারগুলোতে গত বছরের লাখ লাখ টন আলুর কি হবে? যখন চাল-আটার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে তখন দেশের কৃষকদের ফলানো লাখ লাখ টন আলু পঁচে গেলেও এসব আলু বাজারজাত করার কোন উদ্যোগে দেখা যায়নি। বছরের শুরুতে হাওরে বড় আকারের ফসল হানি ঘটেছে। একই সময়ে ধান তলিয়ে গেছে এবং উজান থেকে আসা ঢলের পানির রহস্যজনক দূষণে মাছের মড়কের ঘটনা ছিল নজিরবিহিন। এহেন বাস্তবতায় হাওরের সর্বহারা মানুষগুলোর প্রতি খাদ্য সহায়তার কোন বিকল্প ছিলনা। হাওরের এসব কৃষক-জেলেদের চাল-আটার পাশাপাশি খাদ্য সহায়তা হিসেবে আলু দেয়া হলে আলুর মজুদের অনেকটাই সদ্ব্যবহার সম্ভব ছিল। বছরের মাঝামাঝিতে রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার মুখে স্রোতের মত ধেয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়ের পাশাপাশি খাদ্য সহায়তা দিয়েছি আমরা। এসব রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা হিসেবে আলু সরবরাহ করা হলে আলু নিয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা অনেকটাই লাঘব করা সম্ভব ছিল। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিরলস কাজ করা এসব কৃষক ও বেপারীরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেলে আমাদের সরকারের মন্ত্রী এমপি বা ক্ষমতাবান আমলাদের যেন কিছুই যায় আসেনা।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জীব-প্রকৃতিতে নতুন নতুন নানা ধরনের রোগ বালাই, সুপেয় পানির সংকট এবং ভ’মির উর্ব্বরতা হ্রাস পাওয়ার কারণে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনের সক্ষমতা ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নে নানা ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার, উচ্চফলনশীল হাইব্রীড কৃষিবীজ থেকে মানবদেহের জন্য অপরীক্ষিত জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম(জিএমও) কৃষিবীজ ব্যবহারের পরও খাদ্য সংকট নিরসনে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছেনা। এখনো বিশ্বের প্রায় শতকোটি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হয়। এখনো তৃতীয়বিশ্বের শতকোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার। অন্যদিকে শিল্পোন্নত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্থুলতা নিয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। খাদ্য গ্রহণ ও অপরিমিত ও ত্রæটিপূর্ণ জীবনযাপনের কারণেই এই সমস্যা তৈরী হয়েছে। যদিও বিশ্বের জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্য উৎপাদন কম হচ্ছেনা, খাদ্যের সংকটের মূল কারণ খাদ্য নিয়ে কর্পোরেট মুনাফাবাজি, রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, অপরিকল্পিত বিচারহীন খাদ্যাভ্যাস ও পরিকল্পনাহীন বন্টন বা বাজারব্যবস্থা। অকালবন্যায় বাঁধভেঙ্গে উঠতি ফসল তলিয়ে হাওরে এবং উত্তরের কিছু এলাকায় বন্যা ও বøাস্ট রোগে ফসলহানির কারণ দেখিয়ে দেশে একটি সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের আশঙ্কাকে অতিমাত্রায় প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি লাখ লাখ টন খাদ্যশস্যের গোপণ মজুদ সৃষ্টি করে চালের মূল্য বাড়ানো শুরু করে চালকল মালিক ও চাল আমদানীকারকরা। দেশে প্রায় চারকোটি মেট্টিকটন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় যার আশিভাগই ভাগই ধান-চাল। অন্যদিকে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রথম সারিতে চলে এসেছে। গত মওসুমেও প্রায় এক কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে যার অর্ধেক এখনো অবিক্রিত রয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি, ১২ টাকার উৎপাদন খরচের আলু মওসুমে কৃষকরা ৮-১০ টাকা কেডজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। লোকসান থেকে বাঁচার জন্য এবং লাভের আশায় প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে যারা হিমাগারে রেখেছিলেন তারা এখন ৩-৪ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাৎ আলুচাষি এবং আলু ব্যবসায়িরা তাদের মূলধন হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যেতে বসেছেন। অথচ খাদ্য সংকটের ধোঁয়া তুলে দেশের চাল ব্যবসায়ীরা তিরিশ টাকার চাল ৫০ টাকায় বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। চালের মত নিত্যপণ্যের অস্বভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সরকারের জন্য বিব্রতকর হওয়ায় মূল্য কমাতে সরকার দ্রুত চাল আমদানীর শুল্ক প্রত্যাহার করলেও বাজারে তার কোন প্রভাবই পড়েনি। শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে অন্তত তিরিশ লাখ টন চাল আমদানীর মধ্য দিয়ে সরকার শত শত কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হলেও এই সুবিধার পুরো সুফল আমদানীকারক ও পাইকারী চাল ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। সরকার যেন ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার সুবিধা পাইয়েে দিতেই চাল আমদানীর শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। তা না হলে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানী করা চাল কেন ভোক্তাদের অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে?
ফসলহানির কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় ২০-২৫ লাখ টনের বেশী ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। সরকারের খাদ্য গুদামে খাদ্যের মজুদ তলানিতে থাকার সংবাদ প্রকাশিত হলেও অন্যদিকে হিমাগারে রক্ষিত আছে অন্তত ৪০ লাখ টন আলু। খাদ্যের জরুরী চাহিদা পুরণে আলুর কি ভ‚মিকা থাকতে পারেনা? অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই আলু অন্যতম প্রধান খাদ্য। খাদ্য চাহিদা পুরনে গম, চাল ও ভ‚ট্টার পরই আলুর স্থান।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে খাদ্য সংকটে জরুরী চাহিদা পুরণে আলু বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল। এরপর থেকেই খাদ্য হিসেবে আলুর চাহিদা ও উৎপাদন বাড়তে থাকে। গম,চাল ও ভ‚ট্টার মত আলু দিয়ে হরেক রকমের খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুত করা হয়। বাজারে ২০ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট পটেটো চিপসের দাম কমপক্ষে- ১০-১৫ টাকা। এ হিসেবে এক কেজি প্রক্রিয়াজাত আলুর মূল্য কমপক্ষে ৫০০ টাকা। এককেজি আলু চিপস বানাতে যদি ৫ কেজি আলুর প্রয়োজন হয় তাহলেও প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ১০০ টাকায়। গত বছরের হিসাবে বিশ্বের শীর্ষ ১০ টি আলু উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ৮ কোটি ৫৯ লাখ টন আলু উৎপাদন করে চীন রয়েছে তালিকার শীর্ষে, ৪ কাটি ৫০ লাখ টন উৎপাদন করে ভারত দ্বিতীয়, ২ কোটি ৯৫ লাখ টন উৎপাদন করে রাশিয়া তৃতীয়, এরপর যথাক্রমে ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী ও পোল্যান্ডের স্থান প্রায় ৯০ লাখটন আলু উৎপাদন করে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত তিন দশকে বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ১০গুন। আলুর উৎপাদনের হার সবচে বেশী বাড়লেও ধান এবং ভ‚ট্টার উৎপাদনও এসময়ে কয়েকগুন বেড়েছে। চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখেই দেশে ধীরে ধীরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে। বিশ্বের অন্যতম আলু উৎপাদনকারি দেশ হিসেবে গত দুই দশকে বাংলাদেশ থেকে বর্হিবিশ্বে আলু রফতানীর এক নতুন সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। দেশে ক্রমবর্ধমান আলু উৎপাদনের সাথে সাথে আলু রফতানীও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, সেই সাথে আলুর বহুমুখী ব্যবহার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাণিজ্যিক বহুমুখীকরণেরও নানা রকম ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই তৈরী হয়েছে। যেখানের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি আটার মূল্য ২০-২৫ টাকা, চালের মূল্য ৩০-৫০ টাকা, সেখানে প্রতিকেজি পটেটো ফ্লেক্সের পাইকারী মূল্য ১৫০ টাকার বেশী। বিশ্ববাজারে পটেটো ফ্লেক্সের চাহিদা থাকায় গত এক দশকে বাংলাদেশে অন্তত ১০টি বড় আকারের পটেটো ফ্লেক্স কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এসব উদ্যোগের বেশীরভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যতম আলু উৎপাদক দেশ রাশিয়া, ধান উৎপাদন দেশ ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরসহ অন্তত ৩০টি দেশে বাংলাদেশের আলু রফতানী হলেও সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও প্রণোদনা না থাকায় আলু রফতানীতে প্রায়শ ছন্দ পতন ঘটতে দেখা যায়। রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আলু রফতানী করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি ডলার বা ২৫০কোটি টাকার বেশী আয় হলেও গত তিন অর্থ বছরে আলু রফতানীর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। গত বছরে আলু রফতানী থেকে আয় হয়েছে দেড়কোটি ডলারের কম। বছরে দেশে আলুর চাহিদা ৭০ লাখ টন আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এককোটি টন, বেশীরভাগ সময়ই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়। গত বছরও আলু উৎপাদিত হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে লক্ষাধিক টন বেশী। যে কৃষক ১০ কেজি দরে আলু বিক্রি করছে সে প্রতিদিন ৫০ টাকা দরে চাল কিনছে। অথচ ভাতের চেয়ে আলুর পুষ্টিগুন মোটেও কম নয়। আমাদের সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে খাদ্যমূল্য নিয়ে সিন্ডিকেটেড কারসাজি ও একচেটিয়া মুনাফাবাজি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিশ্বের জ্বালানী চাহিদা এবং খাদ্য নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কর্পোরেট রাজনীতি ও মুনাফাবাজির সাম্রাজ্যবাদি স্ট্রাটেজি রয়েছে। সত্তুরের দশকে মার্কিন পররাষ্ট্রুমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘কন্ট্রোল অয়েল ইউ কন্ট্রোল নেশনস, কন্ট্রোল ফুড অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল পিপলস’। অর্থাৎ দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে জ্বালানী তেলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, আর দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে খাদ্য সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। গত ছয় দশক ধরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাথে জ্বালানী নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ষাটের দশকে বিভিন্ন দেশে খাদ্যাভাবকে পুঁজি করে সবুজ বিপ্লবের শ্লোগান সামনে রেখে বড় বড় ড্যাম, ইরিগেশন প্রজেক্ট, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবসায় থেকে শুরু করে আজকের জিএমও কৃষিবীজ পর্যন্ত বিশ্বের খাদ্যচাহিদা নিয়ে তাদের কৌশলগত অবস্থান অবিচ্ছিন্ন রয়েছে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ ও অস্থিতিশীলতার পেছনেও রয়েছে তাদের জ্বালানীর উপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখার সাম্রাজ্যবাদি নীল নকশা। তবে এখনকার বিশ্ববাস্তবতায় খাদ্য ও জ্বালানী নিরাপত্তার কসরতের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে আঞ্চলিক শক্তিগুলোও সমানভাবেই সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশের পাশের বড় প্রতিবেশী ভারতকে প্রায়শ বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা ও কৃষিব্যবস্থা নিয়ে নানা ধরনের চালবাজি করতে দেখা যায়। কখনো ধান-চালের ভরা মওসুমে ভারত থেকে আমদানী হওয়া চালে বাংলাদেশে ধান-চালের মূল্য পড়ে যাওয়ায় কৃষকের হা পিত্যেশ। কখনো চালের ঘাটতির সময় ভারতের হঠাৎ চাল রফতানী বন্ধ করে দেয়া বা রফতানীশুল্ক দ্বিগুণ করে দেয়া। বাংলাদেশি পাটের উপর এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের মাধ্যমে পাট রফতানী ব্যহত করা, বাংলাদেশে গরু রফতানী বন্ধ করা এবং কোরবানীর সময় কাঁচা চামড়ার বাজারে ধস নামানোর মত ঘটনাবলীর সাথে ভারতীয় ও মধ্যস্বত্বভোগিদের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদার একটি বড় অংশই ভারত থেকে আমদানী করে পূরণ করা হয়। গত আগস্ট মাসে ভারতে পেঁয়াজের মূল্য কমে যাওয়ায় পেঁয়াজ চাষিদের লোকসানের সংবাদ প্রকাশিত হয়। সে সময় ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদনকারি রাজ্যগুলোতে প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য ৯ টাকার নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছিলনা। হঠাৎ করেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য বাড়তে শুরু করে রকেটের গতিতে। ২৫ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ দুই সপ্তাহের মধ্যে একশ টাকায় উঠে যায়। বাংলাদেশে নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলেও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম এখনো ৮০ টাকার নিচে নামছেনা। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু দায়সারা সংবাদ ছাপা হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ নিয়ে এখনো বেশ সরগরম রয়েছে। বাংলাদেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ১০ টাকার ভারতীয় পেঁয়াজ ৮০ টাকায় বিক্রি করার মেকানিজম ভারতীয়দের হাতে থাকলেও বাংলাদেশের চারলাখ আলুচাষিকে বাঁচাতে এবং অন্তত তিরিশ লাখ টন আলুর অপচয় ও পঁচে যাওয়া রোধ করার কোন কার্যকর উদ্যোগ যেন কারো হাতেই নেই। চীন, ভারত, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ৭টি রাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে বেশী আলু উৎপাদিত হয়। এসব দেশের কৃষকরা আলু চাষ করে বা কৃষকের কাছ থেকে লোকসানি মূল্যে আলু কিনে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে এমন কোন তথ্য আমাদের জানা নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।