Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চলছি নদীর স্রোতের মতো

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পরিচয় ছিল নিম্ন আয়ের দেশ। সিঁড়ি বেয়ে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এখন ছুটছি মধ্য আয়ের দেশ হতে। শহর-গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে; ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। লাখোপতি এখন আর হিসেবে ধরা হয় না; কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। কানাডায় ‘বেগম পল্লী’ ও মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ তৈরির যোগ্যতম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখায় পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারে নাম উঠছে। সঙ্গতি হলেই মানুষ গাড়ি কিনছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীতে অনেকগুলো ফ্লাইওভার হয়েছে। বড় বড় অট্টালিকা উঠছে। শিক্ষার হার বাড়ছে। বার্ষিক বাজেট ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি বাড়ছে। এগিয়ে চলছি সামনের দিকে। সত্যিই কি আমরা এগিয়ে যাচ্ছি? নব্বই দশকের শেষের দিকে শেয়ারবাজার চাঙা হওয়ায় প্রতিদিন সকালে কুমিল্লা থেকে মোটরবাইকে তরুণ-যুককরা মতিঝিলে এসে শেয়ারের ব্যবসা করে বিকেলে ফিরে যেতেন। তখন ঢাকা থেকে সকালে ময়মনসিংহ বা টাঙ্গাইল গিয়ে বিকেলে ফিরে আসা যেত; এখন সেটা কল্পনা করা যায়? উন্নয়নের জোয়ারে মতিঝিল-গুলিস্তান থেকে সকালে উত্তরা-এয়ারপোর্ট গেলে বিকেলে ফিরতে কঠিন হয়।
১০ বছর আগেও রাজধানীর মতিঝিল থেকে ফার্ম গেইট যেতে সময় লাগত ২০ থেকে ৩০ মিনিট। এখন এই দূরত্ব পার হতে দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। মতিঝিল থেকে গুলশান যেতে সময় লাগত ৪০ থেকে ৫০ মিনিট। এখন সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্ট এক ঘণ্টার রাস্তা এখন অবস্থাভেদে পৌঁছাতে সময় লাগে আড়াই থেকে চার ঘণ্টা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল এক শ’ কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এখন এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা। ঢাকা টু রংপুর যেতে আগে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টা সময় লাগলেও এখন সময় লাগে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা টু চট্টগ্রাম রোডে যাতায়াতেও একই অবস্থা। তাহলে আমরা কি এগিয়ে যাচ্ছি না পিছিয়ে পড়ছি? ২১ অক্টোবর ছেলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য রাজশাহী যেতে হয়েছিল। মহাখালী থেকে রাজশাহী যেতে সময় লেগেছে ২৬ ঘণ্টা। ভাবা যায়!
যোগাযোগ অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, এখন অনেকেই অফিসের কাজ করেন বাড়িতে বসেই। উত্তরা-মীরপুরের পল্লবী এলাকায় যারা থাকেন, অথচ মতিঝিল-গুলিস্তান-পল্টন-কাকরাইল অঞ্চলে অফিস; তাদের অনেকেই সাপ্তাহে দুই-তিন দিন অফিস করেন। কর্মদিবসের বাকি কাজগুলো ঘরে বসেই করতে বাধ্য হন। যানজটের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এভাবেই রুটিন করতে বাধ্য হয়েছেন।
বিজ্ঞানের বদৌলতে চিঠিপত্রের দিন শেষ। এখন মোবাইলে মিনিটেই দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত এবং পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে দূরের মানুষও কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু পথে নামলে যে অবস্থা, তাতে এগিয়ে যেতেই চাইলেই থমকে দাঁড়াতে হয়। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। তাতে কোথাও কোথাও সামান্য উপকার পাচ্ছি বটে; কিন্তু---। মাঝে মাঝে একনেকের সভায় যেভাবে উন্নয়নের জন্য ঢাউস বরাদ্দ করা হয়, তা শুনলে পিলে চমকে উঠে বৈকি। নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান আসতে এখন খুব কম সময় লাগে। ফ্লাইওভারের কারণে দ্রæত আসা যায়। কিন্তু গুলিস্তানে গাড়ি নামার পর কি অবস্থা হয়? ফ্লাইওভারে যাতায়াতে কিছু মানুষের সুবিধা হচ্ছে। কিন্তু ফ্লাইওভারে ওঠার জন্য এবং নামার জন্য মাইলের পর মাইল যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে কেন? বিশ্বব্যাংক এক সমীক্ষায় বলেছে, ‘যানজটে ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এই যানজটের বার্ষিক ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা’। যানজটে লাখ লাখ গ্যালন জ্বালানিও খরচ হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বায়ু দূষণে রাজধানী ঢাকা শহর ক্রমান্বয়ে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। চলাচলের রাস্তা খারাপ হওয়ায় যানজট হচ্ছে নিত্যসঙ্গী। উন্নয়নের ধামাকায় এখন চলছে ফ্লাইওভার বানানোর মহাধুম। রাজধানীর যেদিকে তাকাবেন, শুধু ফ্লাইওভার আর ফ্লাইওভার। বিদেশি ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ হচ্ছে। র‌্যাংগস ভবন ভেঙে ফ্লাইওভার হলো; হাতিরঝিল থেকে সোনারগাঁও হোটেলের কাছে ফ্লাইওভার হলো, মগবাজার হয়ে বাংলামোটরে হলো ফ্লাইওভার। সবগুলো ফ্লাইওভার ভিআইপি সড়কের আগে নামিয়ে দেয়া হলো। এখন ভিআইপি সড়কের যানজটের কী অবস্থা? ঢাকার উন্নয়ন এবং নগরায়ণ নিয়ে প্রায় টিভি টকশোতে পরামর্শ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। এই নগরবিদ রাজধানীর উন্নয়নের বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করছেন। কিন্তু নীতি নির্ধারকরা কি সে কথা শুনছেন? কয়েক বছর আগেও রাস্তাঘাটের যানজট নিরসন ও রাস্তা যান চলাচলের সময়োপযোগী করার দাবিতে আন্দোলন করতে দেখা গেছে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে। কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, নাসিউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চুসহ প্রখ্যাত ব্যক্তিদের দেখা গেছে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বন্ধ এবং রাস্তাঘাট চলাচলের উপযোগী করার দাবিতে মানববন্ধন করতে; কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে। নাগরিকের স্বার্থের পক্ষের এসব দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন ছিল। তারা যখন কর্মসূচি করতেন তখনকার চেয়ে এখন রাস্তাঘাট এবং যানজটের অবস্থা আরো খারাপ। অথচ ওই সব জনদরদীদের প্রায় দেখা যায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে টিভি ক্যামেরায় পোছ দিচ্ছেন। সময় যেমন কারো জন্য বসে থাকে না; তেমনি নদীর স্রোতও কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমরা সেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদীর স্রোতের মতোই এগিয়ে চলছি।



 

Show all comments
  • নিঝুম ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৪:২৩ এএম says : 0
    যেভাবে চলছি তাতে নদীর এই স্রোত ডোবার পানিতে পরিণত হবে
    Total Reply(0) Reply
  • নাসির ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৪:২৪ এএম says : 0
    দেশ, দেশের মানুষ বা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার লোকের খুব অভাব
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদীর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ