দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ইমরান হুসাইন (তুষার)
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী। ভয় নাই, ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান। ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই”। কবির এই উক্তিটি চিরন্তন সত্য। যারা সত্যের পথের পথিক তাদের নাই কোনো ভয়। নাই কোনো ক্ষয় তার উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই। যুগ-যুগান্তরে যারা সত্যের সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। এমন মহান পুরুষদেরকে আজো তাদের কৃতকার্যের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। তেমনি একজন অক্ষয় অমর কীর্তিমান মহান পুরুষ হলেন হযরতুল আল্লামা শাহ্ সুফি খাজা আবু তাহের (রহ.)। তিনি একাধারে ছিলেন একজন সফল সংগঠক, ধর্ম প্রচারক, সুবক্তা, দানবীর এবং তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি ছিলেন একজন আশেকে রাসূল (সা.)। যা তা বর্ণাঢ্য জীবন কর্মের মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যা কিনা আজো স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা তাকে একবার দেখেছিলেন। তিনি আল্লামা শাহ আহমাদ রেযাখান (রহ.), আল্লামা শেরে বাংলা আজিজুল হক (রহ.), আল্লামা আবু নসর মুহাম্মদ আবিদ শাহ মুজাদ্দেদী আল-মাদানী (রহ.)-এর ভাবধারার সুযোগ্য উত্তরসূরি। আল্লামা আবু নসর মুহাম্মদ আবিদ শাহ মুজাদ্দেদী আল-মাদানী (রহ.) ছিলেন আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহঃ)-এর আপন ভগ্নিপতি। তাই উভয় জনের মধ্যে ছিল অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) ১৯৪৬ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বংশগতভাবে তার পিতৃকুল ও মাতৃকুলের পূর্ব পুরুষগণ সকলে সুফি সাধক ছিলেন। যতদূর জানা যায়, আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ এবং মহান আধ্যাত্মিক সাধক, পীরে কামেল আল্লামা হাফেজ, কারী আলহাজ খাজা আহমাদ শাহ নকশেবন্দী মুজাদ্দেদী (রহ.)-এর পূর্ব পুরুষগণ মদিনা শরিফ থেকে হিজরত করে প্রথমে ভারতের কাশ্মীরে পরে জৌনপুরে এসে বসবাস করেন। আল্লামা খাজা আহমাদ শাহ (রহ.) প্রথমে তার পিতার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ ও পরে ভারতের রামপুর মাদরাসা-ই-আলিয়া থেকে হাদিস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করেন। এ ছাড়াও এলমে মারেফত অর্জনের জন্য আল্লামা খাজা আহমাদ শাহ (রহ.) বিয়াসাতে রামপুরে আসেন এবং তিনি মুজাদ্দেদীয়া তরিকার অন্যতম বিখ্যাত শায়েখ হযরতুল আল্লামা হাফেজ এনায়েতুল্লাহ খান (রহ.)-এর কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ ও এলমে মারেফত অর্জন করেন। পরে আল্লামা হাফেজ এনায়েত উল্লাহ খান (রহ.) তাকে খেলাফত প্রদান করেন এবং তার নির্দেশে তিনি সেই প্রদেশ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য আসেন। তিনি সর্বপ্রথম নোয়াখালী, ফরিদপুর, তারপর অন্যান্য অঞ্চল সফর করেন এবং অবশেষে চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত ইসলামপুরের গাছতলা নামক গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) ভাইদের মধ্যে পঞ্চম । তারা প্রত্যেকেই এলমে শরিয়ত ও তরিকতের আলেম ছিলেন। আল্লামা খাজা আবুল খায়ের (রহ.), আলহাজ হাফেজ মাওলানা খাজা লোকমান (রহ.), আলহাজ খাজা বাকী বিল্লাহ, পীরে কামেল শাহ সুফী, আল্লামা খাজা তৈয়্যবুল ইসলাম (রহ.) ও নুরুল হুদা খাজা আহমেদুর রহমান। তার ভগ্নিপতিগণও ছিলেন বড় আলেম। আলহাজ আল্লামা শায়খুল হাদিস ইউনুস (রহ.)। আল্লামা খন্দকার মোবারক হোসাইন। ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা সৈয়দ আবিদ শাহ মুজাদ্দেদী (রহ.) ও ৪র্থ জন হলেন আল্লামা মুসলিম উদ্দিন আহমাদ (রহ.)।
আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) তার শ্রদ্ধেয় পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ও তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত মাদরাসা এবং প্রসিদ্ধ আলেম-ওলামার কাছ থেকে উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেন এবং তিনি মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকা থেকে কামিল এবং প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী শিক্ষায় অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপনের পর তিনি সুন্নিয়তের খেদমত ও কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। প্রথমে তিনি শহীদবাগ জামে মসজিদ ও পরে আমৃত্যু কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ৮০’র দশকের শুরুর দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরস্থ খানকায়ে কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়ায় আওলাদে রাসূল আল্লামা তৈয়ব শাহ (রহ.)-এর নিকট তাবারুকান বায়াত গ্রহণ করেন এবং সুফি আহামাদ হোসাইন (রহ.)-এর কাছ থেকে ফয়েজ প্রাপ্ত হন। তিনি ১৯৯১ সালে মুফতিয়ে আজম হিন্দ মোস্তফা রেজা খান (রহ.)-এর খলিফা ভারতের শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন কলম স¤্রাট ও সানীয়ে আ’লা হযরত নামে খ্যাত আল্লামা আরশাদুল কাদেরী (রহ.)-এর নিকট কাদেরিয়া তরিকায় খিলাফত গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি তরিকত জগতে পদার্পণ করেন। তবে তিনি পূর্বে থেকে নকশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদিয়া তরিকার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কারণ তার পিতা রিয়াসাতে রামপুর থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হন। আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) নবী প্রেম ও বেলায়েতের উৎকর্ষ সাধন করে নিঃসন্দেহে একজন পরিপূর্ণ কামেল ওলি আল্লাহর মর্যাদা লাভ করেন। এমনি অনেক নজিরও রয়েছে তার। শাহজাহানপুরস্থ গাউসুল আযম জামে মসজিদ কমিটির সম্মানিত সাবেক সভাপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ এম. এ. হাই সাহেবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে চাই। তিনি একবার হুজুরের সাথে হজে যান। তখন যতদিন তারা মদিনা শরিফে ছিলেন, ঠিক ততদিন হুজুর সবার আগে রওজা শরিফে প্রবেশ করতেন এবং সবার শেষে বের হতেন। সারা দিন নবী পাক (সা.)-এর রওজা শরিফের সামনে কাটিয়ে দিতেন। একদিন দেখা গেল হুজুর রওজা শরিফে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন। এমনভাবে কাঁদছিলেন তার দাড়িগুলো ভিজে চোখের পানিতে জুব্বা ভিজে যাওয়ার মতো। পরদিন তিনি (হাই সাহেব) দেখলেন হুজুর হাসিমুখে রওজা শরিফ থেকে বের হয়ে আসছেন। তখনি তিনি হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, গতকাল কেঁদেছিলেন আর আজ হাসছেন কেন? হুজুর তখন বলেন, আমি আগামীবার হজে আসার জন্য নবীজীর কাছে আরজি করছি। যতক্ষণ আমার আরজি কবুল হয়নি ততক্ষণ আমি কেঁদেছি। আর এখন আমার আরজি কবুল করেছেন নবীজি। তাই আমি হাসছি। এমন আশেকে রাসূল (সা.) খুব কম দেখা যায়। একজন কামেল পীর সাহেব যে শুধু নিজের ভালো-মন্দের খবর রাখেনই না, মুরিদগণেরও ভাল-মন্দের খবরও রাখেন। খাজা হুজুর ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একবার তার এক মুরিদের সাথে স্বপ্নে দেখা দিলেন এবং তাকে বললেন, ‘বাবা আমার মাদরাসায় চাল নাই, আপনি তাড়াতাড়ি চালের ব্যবস্থা করেন।’ পরদিন সে ব্যক্তি মাদরাসায় এসে দেখলেন মাদরাসায় এক বেলা পাক করার মতোও চাল নেই। তিনি তাৎক্ষণিক চালের ব্যবস্থা করলেন। আরেকবার আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-এর আরেক মুরিদ চাঁদপুরের ফায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে বাসে করে যাচ্ছিলেন। লোকটি এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ করে তিনি দেখতে পেলেন আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.) তাকে বলছেন, বাবা আপনি সিট শক্ত করে ধরে বসেন সামনে একটা এক্সিডেন্ট হবে। তখনই লোকটির ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক কিছুক্ষণ পর একটি এক্সিডেন্ট হলো। পরে দেখা গেল অনেকেই আহত-নিহত হলেন। শুধু তিনিই আল্লাহর রহমতে অক্ষত রইলেন।
উপমহাদেশের খ্যাত আলেমে দ্বীন আওলাদে রাসূল (সা.) আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) তার উৎকর্ষ সাধন সম্পর্কে বলেন, খাজা আবু তাহের একজন প্রকৃত আশেকে রাসূল। যা তার চেহারার মধ্যে ভাসমান। তিনি আল্লামা খাজা আবু তাহের (রহ.)-কে সম্পর্কে আরো বলেনÑ আউলিয়ার ছেলে আউলিয়া। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।