Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কাউন্সিলে বেগম জিয়ার ভাষণের তাৎপর্য

প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমেদ জামিল
গত ১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দেশের মূলধারার দুই রাজনৈতিক দলের অন্যতম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। শুধু ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন নয়, এই কাউন্সিল অনুষ্ঠান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের আগে নি¤œস্তরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ তাচ্ছিল্য ও উপহাস করে বলেছিলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাউন্সিলে লোকসমাগম করার মতো সাংগঠনিক শক্তি বিএনপির নেই। কিন্তু বিএনপি দলীয় কাউন্সিলে বিশাল লোকসমাগম করে ওইসব আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্যকে শুধু মিথ্যাচারই প্রমাণ করেনি, সেই সাথে দেখিয়ে দিয়েছে দ্বিদলীয় মূলধারার রাজনীতিতে তারাও অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। কাউন্সিল পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে ঝিমিয়ে পড়া এবং দিশাহীন বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা ও উজ্জীবন সঞ্চার করেছে তাতে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন করে এক ধরনের গতিময়তা যে এনে দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যা হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের জন্য সহায়ক হতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যতই বাগাড়ম্বর করুন না কেন বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নতুন করে উজ্জীবিত হতে দেখে তারা যে মনে মনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন তা সহজেই অনুমেয়।
আরেক তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রশংসনীয় বিষয় হলো, গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিস্ট চরিত্রের সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন ও সংগ্রামে যেসব নেতা-কর্মী আত্মবিসর্জন দিয়েছেন তাদেরকে স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে ২০ মার্চ ২০১৬ দৈনিক ইনকিলাবে ‘বিএনপির ভিশন-২০৩০’ শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টের এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়Ñ “মূল মঞ্চের পেছনে খালেদা জিয়ার পাশাপাশি জিয়াউর রহমান ও তারেক রহমানের ছবি রাখা হয়। মঞ্চের বাম দিকে গুম ও হত্যাকা-ের শিকার নেতাদের ছবি সম্বলিত ‘হিরোজ-নেভার ডাই’ শিরোনামে বিশাল ডিজিটাল ব্যানার। সেখানে নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর ছবিও রাখা হয়।” নিঃসন্দেহে এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে শহীদ ও নিখোঁজ হওয়াদের পরিবার-পরিজনের জন্য শুধু সান্ত¦নার বার্তাই বয়ে আনেনি, সেই সাথে তাদের মধ্যে শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রেরণাও জুগিয়েছে। অনুপ্রাণিত করেছে দৃঢ় ও সাহসী হতে। যাহোক ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিএনপির কাউন্সিলটি ছিল ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে জাতীয় ঐক্যে গড়া এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও দেশের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক অখ-তা রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রকৃত ধারক-বাহক হিসেবে বিএনপির জন্ম। দ্রুত দলটি আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে মূল ধারার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্থান করে নেয়।
রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিএনপির বয়স এখন ৩৭। সেক্ষেত্রে বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১২টি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এ নিয়ে হয়েছে ছয়টি। এর আগে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। এবার বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন করল। ক্ষমতাসীনদের তরফ হতে সৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝে গত ১৯ মার্চ বহুলাংশে সফল জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত করতে পারাটা বিএনপির জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক অর্জন বলতে হবে। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিএনপির মধ্যে বেশ কিছু গুণগত রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সাহসের সাথে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
এ দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাদের বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী এবং বিশ্বাসঘাতক নেতাদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। বিএনপিতে এখন এক নেতার এক পদ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে কতিপয় ব্যক্তির দল ও সংগঠন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব খর্ব করা হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের এবারের জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে বক্তব্যের শুরুতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনৈতিক উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। যা প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের মধ্যে অনুপস্থিত।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণাকে রাজনৈতিক বোদ্ধা মহল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সৃজনশীলতা বলে উল্লেখ করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা দেশের টেকসই গণতন্ত্রের বিকাশ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ সহায়ক হতে পারে। বেগম জিয়া বলেছেন, আমরা এমন এক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাই, যেখানে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন আরো বলেছেন, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক ও আধাসাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণ মুক্ত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আরো বলেনÑ সততা, দক্ষতা, দেশপ্রেম ও বিচার ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসন ও পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হবে। সততা ও সৃজনশীলতা হবে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে যোগ্যতার মাপকাঠি। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক, আধাসাংবিধানিক এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণ করার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছেন। নিরপেক্ষতা হারিয়ে স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে অক্ষম হয়ে পড়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে গণমানুষের আস্থা প্রায় উঠে গেছে। বেগম জিয়ার এতদসংক্রান্ত বক্তব্য জনমনে আশার সঞ্চার করেছে।
বেগম খালেদা জিয়া স্বেচ্ছাচারী শাসনে দেশের অবস্থা শোচনীয় বলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে সংলাপে বসার জন্য সরকারকে জোর তাগিদ দিয়েছেন। প্রতিশোধের রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন তার ভাষণে দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে কারো প্রতি অবিচার করা হবে না। তার বক্তব্যে এদিকটির মধ্যে অসুস্থ ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দূরীভূত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার অঙ্গীকার প্রস্ফুটিত হয়েছে। সুস্থ ধারার রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য যা অপরিহার্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, বিএনপি চেয়ারপাসরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিএনপি ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফিরতে চায়।
অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে শেখ হাসিনাকে ছাড়াই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে আভাস দিয়েছেন তা হেলায় উড়িয়ে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। সবার অংশগ্রহণে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সরকারের ওপর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সরকারের শেষ ভরসা হলো ভারত। সেই ভারতের শাসক দল বিজেপির থিঙ্ক ট্যাংকগুলো অজনপ্রিয় শেখ হাসিনা সরকারের বোঝা না বইবার পরামর্শ দিচ্ছেন। ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিক এবং সেসব দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিতি এবং ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির তরফ হতে শুভেচ্ছা বাণী প্রেরণ ইত্যাদি যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করতে পারে বেগম জিয়ার ওই ধরনের বক্তব্যের ক্ষেত্রে। যাহোক, ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে দল হিসেবে বিএনপির অনেক অপ্রাপ্তি থাকলেও, অর্জনের পরিধি আরো ব্যাপক ও বড়।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাউন্সিলে বেগম জিয়ার ভাষণের তাৎপর্য
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ