Inqilab Logo

বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

রাইখালী কৃষি গবেষণার সাফল্য পাহাড়ের বারি মাল্টা দেশজুড়ে ব্র্যান্ডে পরিণত

রাঙ্গামাটি থেকে সৈয়দ মাহাবুব আহামদ | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পাহাড়ের বারি মাল্টা এখন ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম এবং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে এখন পাহাড়ের রসালো বারি মাল্টা রাঙ্গামাটির মাল্টা বলে হরদম বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের গোলপাহাড় মোড়ের ফলবিক্রেতা সাইফুল জানালেন, পাহাড়ের মাল্টা যে একবার কিনেছে, সে বারবার এই মাল্টা খুঁজে নিচ্ছে। এতে তারা দিনের ফল দিনেই বিক্রি শেষ করে নতুনভাবে মাল্টা আনতে পারছে পাহাড় থেকে। ‘এ্যাই রাঙ্গামাটির মাল্টা, রাঙামাটির মাল্টা’ বলে ফল বিক্রেতা সাইফুল হাক ছাড়লেও সে বিক্রি করছে খাগড়াছড়ি থেকে আনা মাল্টা। এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জানাল রাঙ্গামাটির মাল্টা বললেই মানুষ বেশি চেনে, তাই আমরা ওই নামেই বিক্রি করি। এসব মাল্টায় যেমন অনেক রস তেমনি বেশ মিষ্টিও। খেতে কিছুটা টক মিষ্টি হলেও ফরমালিনের ভয় না থাকায়, মানুষ লাইন ধরে কিনছে এসব মাল্টা। নিমিষেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে খাঁচাভর্তি বারি মাল্টা।
রাঙ্গামাটির মাল্টা বলে পরিচিতি পেলেও রাঙ্গামাটি জেলায় মাল্টার চাষ এখনো তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। মাল্টা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে সাফল্য পেয়েছে খাগড়াছড়ির কৃষকেরা। তবে এই মাল্টার জন্ম রাঙ্গামাটিতেই অর্থাৎ রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলাধীন রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বেশ কয়েক বছর আগে রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে মাল্টা চাষ করে সাফল্য পাওয়ার পর রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী এবং খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও সদর উপজেলায় চাষিদের এই ফল চাষে উদ্বুদ্ধ করে। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে মাল্টা চাষ করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে পাহাড়ের চাষিরা।
বহুকাল আগে থেকেই পাহাড়ের কমলা সারাদেশে সমাদৃত হয়ে আসলেও দেশে তেমন মাল্টার চাষ ছিল না। নিরলস গবেষণা চালিয়ে পাহাড়ের মাটিতে মাল্টাচাষের নবদিগন্ত উন্মোচন করে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলাধীন রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। তারা কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে সুমিষ্ট মাল্টা ফল আবাদের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে ২০০৭ সালে। পাহাড়ি মাটি এবং আবহাওয়া মাল্টা চাষের খুবই উপযোগী।
সরেজমিন দেখা যায়, গবেষণা কেন্দ্রের সমতল এলাকায় রয়েছে বিশাল মাল্টা বাগান। হৃষ্টপুষ্ট সতেজ প্রতিটি গাছ আকারে ছোট ও সবুজ। গাছে বেলি ফুলের মতো ফুটে আছে ফুল। বেলি ফুলের গন্ধও তাতে পাওয়া যায়। কয়েকটি গাছে ছোট ছোট মাল্টাও ঝুলছে। আবার একই ধরনের বেশ কয়েকটি গাছে সবুজ রঙের বড় আকারের থোকায় থোকায় মাল্টা দেখা গেছে।
গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন জানান, বর্তমানে বাজারে কমলার মতো দেখতে যেসব মাল্টা পাওয়া যায় সেগুলো দেশীয় ফল নয়। ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব মাল্টা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তারা বলেন, দেশের পাহাড়ি এলাকার মাটি মাল্টা চাষের জন্য উপযোগী মনে করে প্রথমে আমরা পাহাড়েই এই চাষের প্রকল্প হাতে নেই। এতে সাফল্য আসার পর সমতলে চাষের উদ্যোগ নেই, পাহাড়ে ভালো মাল্টা চাষ হলেও সমতলের মাটিতে সাধারণত মাল্টা গাছ হয় না। সমতলে মাল্টা হবে নাÑ এটাই ছিল সবার বদ্ধমূল ধারণা। কিন্তু ওই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আমরা সমতলে মাল্টাচাষ করতে পেরেছি। এখন থেকে যে কোনো সমতল অঞ্চলে মাল্টাচাষ করা সম্ভব হবে।
কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামেও লাখ লাখ একর সমতল জমি অনাবাদি পড়ে আছে। ব্যক্তি ও সংস্থা পর্যায়ে এসব জমিতে কেউ মাল্টাচাষ করতে আগ্রহী হলে গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ সহায়তা দেয়া হবে।
রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সৃজিত বাগানের গাছে গাছে মাল্টা ফল ধরেছে। পাঁচ-ছয়ফুট উচ্চতার গুচ্ছ আকৃতির গাছ মালটা ফলের ভারে প্রায় ন্যূয়ে পড়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে দুই শতাধিক মাল্টা ফল ধরেছে। ফলের আকৃতি ও গঠন আমদানি করা মাল্টা অপেক্ষা পুষ্ট এবং বেশি রসালো।
রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, মাল্টা চাষাবাদে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ও স্থানীয়ভাবে প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এলাকার কৃষকদের মধ্যে মাল্টার আবাদ নিয়ে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আগ্রহীদের মধ্যে মাল্টার চারা সরবরাহ নিশ্চিত করতে গবেষণা কেন্দ্রে কলম তৈরির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো জানান, কম বৃষ্টি ও উষ্ণ জলবায়ু মাল্টা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। বায়ুমÐলের আদ্রতা ও বৃষ্টিপাত মাল্টা ফলের গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। ঢালু উঁচু-নিচু মাটিতে মাল্টা ভালো জন্মে। মাল্টা জলবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। পার্বত্য অঞ্চলের হাজার হাজার একরের পাহাড়ি ভ‚মি মাল্টা চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী। গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানান, দেশের মাটিতে উদ্ভাবিত মাল্টার ফলন ভালো হয় এবং ফলের মানও উন্নত। বাজারের বিদেশি মাল্টা অপেক্ষা মিষ্টি ও রসালো। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত মাল্টা বারি-১ জাতের আবাদে রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গেছে। প্রতিবছর নির্দিষ্ট মৌসুমে এ মাল্টার ফলন দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশে আবহাওয়া উপযোগী বারি মাল্টা-১ নামে জাতটি উদ্ভাবন করে। কাপ্তাইয়ের রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে ২০০৭ সালে শতাধিক গাছের বাগান সৃজন করে। সাড়ে ১০ বছরে বাগানের প্রতিটি গাছে গড়ে ২০০টি করে ফল ধরেছে। প্রতিটি গাছে কমপক্ষে ৩০ কেজি মাল্টা হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, গাছ থেকে ছেড়া মাল্টা ফল কোনো প্রকার প্রযুক্তির ব্যবহার বা ফ্রিজিং ছাড়া একমাস স্বাভাবিক থাকবে। প্রতিটি গাছের উচ্চতা সাত থেকে আট ফুট পর্যন্ত হতে পারে। একবার বাগান করলে প্রতি বছরই ফল পাওয়া যাবে। তকর্মকর্তারা আত্ম বিশ্বাসের সাথে পাহাড়ের যে কোনো অঞ্চলের কৃষকরা মাল্টা চাষ করলে অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে বেশি লাভবান হবে। কারণ পাহাড়ের মাল্টা এখন বেশ জনপ্রিয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ