Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ভুল চিকিৎসা ও কর্তব্যে অবহেলায় কুমিল্লায় বাড়ছে রোগীর মৃত্যু

জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে উদ্বেগ ও চিকিৎসাভীতি

| প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে : বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী মুত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে কুমিল্লায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার শিকার হচ্ছে শিশু, নবজাতক ও প্রসূতি মা। ওইসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সেবার নামে রোগীর সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগও ওঠছে। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা মামলা বা অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। তবে দাউদকান্দির গৌরিপুরের একটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠান মালিককে অর্থদন্ড করেছেন। মামলা বা অভিযোগ করে প্রতিকার পেয়েছেন এমন সংখ্যা নেহাতই কম। কেননা অভিযুক্ত হাসপাতাল বা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেও ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবার অজ্ঞাত কারণে অনেক সময় অভিযোগের বিষয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হন।
মাতৃত্বের স্বাদ নিতে নিজের দেহের ভেতর আরেকটি দেহ তিল তিল করে বড় করে তুলেছেন মমতাময়ী নারী। কিন্তু মায়ের গর্ভে নড়াচড়া করা ছোট্ট দেহটি যদি বের করার পর চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায় নিথর নিস্তেজরূপে দেখা দেয়, তাহলে মাতৃত্বের স্বাদের আশায় দিন মাস পার করা ওই মায়ের ও তার স্বজনদের অবস্থা কী হতে পারে? কেবল নবজাতকই নয়, অনেক সময় ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি নারীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর শূন্যতা একটি পরিবারের স্বপ্নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। আবার একটি নবজাতককে বাবা-মা কোলেপিঠে তুলে একটু বড়ো করে তাকে স্কুলে ভর্তি করায় বা করানোর স্বপ্ন দেখে তখন যদি তার অসুখ-বিসুখের ভুল চিকিৎসা করে শিশুকে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠানো হয় তখন নাড়ি ছেড়া ধন হারানোর পাহাড়সম শোক সারাজীবন তাড়া করে ওই পরিবারে। এমনিভাবে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকসহ রোগী মৃত্যুর খবর প্রতিটি পরিবারে উদ্বেগ ও চিকিৎসাভীতি সৃষ্টি করছে।
কুমিল্লায় গত ১১ মাসে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসকের অবহেলায় ১২ জনের বেশি শিশু, নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষকে কাঁদিয়েছে একটি অনলাইন পত্রিকার ফ্রান্স প্রবাসী সম্পাদক আলমগীর হোসেন অপুর ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্র প্রিতমের অনাকক্সিক্ষত মৃত্যু। চিকিৎসা অবহেলায় ফুটফুটে ওই শিশুটি ফ্রান্স থেকে বাবা-মায়ের সাথে কুমিল্লায় দাদার বাড়িতে বেড়াতে এসে লাশ হতে হয়েছে। গত ১৪ জুলাই শিশু প্রিতম অসুস্থ হলে তাকে কুমিল্লা শহরের মিডল্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট বিলম্বে দেয়াসহ চিকিৎসা অবহেলায় শিশুটির মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেনি। সকল মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসা অবহেলায় শিশু প্রিতমের মৃত্যুর খবর তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। এ ঘটনায় সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। নিহত প্রিতমের বাবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে ক্ষমা করে দিয়ে বলেছেন ‘এই যদি হয় এখানকার চিকিৎসার অবস্থা তাহলে মানুষ কোথায়, কার কাছে যাবে।’ অপরদিকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর দাউদকান্দির গৌরিপুরে লাইসেন্সবিহীন লাইফ হসপিটাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খাদিজা আক্তারের গর্ভে থাকা দুই সন্তানের একটিকে সিজারিয়ান অপারেশন করে আরেক সন্তান পেটে রেখেই সিজার সমাপ্ত করার ঘটনা দেশের উচ্চ আদালতের (হাইকোর্ট) দৃষ্টি কেড়েছে। হাইকোর্টের দুই বিচারপতি সালমা মাহমুদ চৌধুরী ও এ কে এম জহিরুল হক স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই হাসপাতালের মালিক ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে তলব করেন। গত ২৬ নভেম্বর ভুল চিকিৎসায় গর্ভের সন্তান মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিনলাখ টাকা প্রসূতিকে ক্ষতিপূরণ দিতে এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
কুমিল্লায় ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায় রোগী মুত্যুর পাঁচটি ঘটনাই ঘটেছে নভেম্বর মাসে। এর মধ্যে ২ নভেম্বর বুড়িচংয়ের আরাগ আনন্দপুর গ্রামের সাবেক শিক্ষক আলী আকবর বুকের ব্যাথা নিয়ে বুড়িচং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হেলথ অ্যাসিস্টেন্ট ওই রোগীর শরীরে ইনজেকশন প্রয়োগ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী মারা যায়। নিহতের পরিবার ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুললেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলেছেন ‘ভুল চিকিৎসা নয়Ñ হায়াত নেই তাই মারা গেছেন।’ ১২ নভেম্বর নগরীর ঝাউতলা মেডিকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় মারা যায় পাঁচদিন বয়সী এক নবজাতক। ওই নবজাতকের পিতা কুমিল্লার মুরাদনগরের কৃষ্ণপুর গ্রামের গৌতম অধিকারি গণমাধ্যমে এমন অভিযোগই করেছেন। ২২ নভেম্বর ব্রাহ্মণপাড়ার মাদবপুরে রয়েল হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক এম শরীফ আহম্মদের অবহেলায় সোনিয়া আক্তার নামে এক প্রসূতি মা ও তার গর্ভের সন্তানের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ৩০ নভেম্বর তিতাস উপজেলায় ইনসাফ ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড হাসপাতালে পারভীন আক্তার নামে এক প্রসূতির সন্তান ভ‚মিষ্ঠ হলেও চিকিৎসকের গাফালতির কারণে ওই প্রসূতি অধিক রক্তক্ষরণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হতে হয়। তার স্বামী নজরুল ইসলাম চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ তুলেন। গত ১৪ ডিসেম্বর নগরীর রামঘাট এলাকায় কুমিল্লা অ্যাপোলো হসপিটালে সদর দক্ষিণ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের আবু জাফরের মাত্র ২১ দিন বয়সী শিশুপুত্র মেহেদী হসপিটাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মারা যায়। এ ঘটনায় পুলিশ হসপিটাল মালিক মান্নানসহ দুইজনকে আটক করে। নিহত শিশুর পরিবার থানায় মামলা করেছেন।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করে থাকি। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগিরা আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে বিষয়টি দেখে থাকি। আবার কোনো ঘটনায় অভিযোগ না পেলেও পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরে আমরা স্বপ্রণোদিত হয়েই তদন্ত করে থাকি। তবে আমি মনে করি এসব ঘটনারোধে একটা নীতিমালা প্রণয়ন দরকার। যাতে করে যে প্রতিষ্ঠান বা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠবে তাতে যেন জবাবদিহীতার ব্যবস্থা থাকে। তবে আমি বলব, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে যাতে আমাদের কাছে অভিযোগ করা হয়। আর অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ আমরা কোনভাবেই চাই না কুমিল্লার চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হোক।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ