Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সৈয়দপুরে স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভ‚মিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ বন্ধ

| প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে নজির হোসেন নজু : নীলফামারীর সৈয়দপুরে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভ‚মিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। যদিও একই সঙ্গে গত ২০১৪ সালে স্মৃতিসৌধ ও গোলাহাট বধ্যভ‚মিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু বর্তমানে অর্থাভাবে এ দু’টি স্থাপনার নির্মাণ কাজ অর্ধনির্মিত অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে সৈয়দপুরে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের বর্রবতা ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের কাহিনী নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে না। এতে করে স্থানীয় জনমনে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. একরামুল হক সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের অন্যান্য এলাকায় তুলনায় অবাঙ্গালী (উর্দুভাষী) অধ্যূষিত সৈয়দপুরের দৃশ্যপট ছিল একেবারে ভিন্ন। কারণ ’৪৭ এর দেশ ভাগের পর বিপুল সংখ্যক অবাঙালি (বিহারি) ভারত থেকে এসে সৈয়দপুর শহরে আঁস্তানা গাড়ে। ফলে এখানে তারাই হয়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে এখানে বসবাসকারী বাঙালিরা। মুক্তিযুদ্ধে বিহারিরা সরাসরি পাকবাহিনীর পক্ষ নেয়। তাই মূলত বিহারি ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় এখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষদের। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে এখানে পাকহানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরা নির্মমভাবে হত্যা করে বিভিন্ন পেশা ও বয়সের বিপুল সংখ্যক মানুষকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে এখানে স্বাধীনতাকামী ঠিক কতজন মানুষ শহীদ হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব না মিললেও বিভিন্ন সূত্রেমতে এ সংখ্যা সহস্রাধিক। শুধুমাত্র ’৭১-এর ১৩ জুন একদিনে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরা হিন্দু ও মাড়োয়ারি পরিবারের সাড়ে ৪০০ নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদের ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে একটি বিশেষ ট্রেনে তুলে শহরের অদূরে গোলাহাট এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে সারিবদ্ধভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসে সৈয়দপুরের এটি সবচেয়ে বড় গণহত্যা। শহরের এমনও অনেক পরিবার আছে, যাদের কোনো একজন সদস্যকেও সেদিন বাঁচতে দেয়া হয়নি।
কিন্তু দীর্ঘদিনেও মুক্তিযুদ্ধে সে সব শহীদদের স্মরণে ও তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে এখানকার নতুন প্রজন্মকে জানাতে নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ কিংবা বধ্যভ‚মিতে স্মৃতিস্তম্ভ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্ব প্রথম সৈয়দপুরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের নকশা করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রধান শিল্প নিদেশক জি এম এ রাজজাক। সে সময় স্মৃতিসৌধটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০ লাখ টাকা। এর ২০০০ সালের ৯ অক্টোবর শহরের উপকণ্ঠে ওয়াপদা মোড়ের সড়ত দ্বীপে শহীদদের স্মরণে স্বাধীনতা শহীদ স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আনিছুল হক চৌধুরী সে সময় স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের ভিত্তিফলকও উন্মোচন করেছিলেন। আর ভাস্কর হাবিবা সুলতানা বেলী সরকার এর নকশা তৈরি করেছিলেন। এভাবে কয়েক দফা স্থান ও নকশা পরিবর্তনের পর গত ২০১৪ সালে শহরের বিমানবন্দর সড়কে ডাক বাংলোর বিপরীতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আর একই সময়ে শুরু হয় সৈয়দপুর-চিালাহাটি রেলপথের পাশে গোলাহাট বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজও।
নীলফামারী-৪ আসনের সংসদ সদদ্য ও বিরোধী দলীয় হুইপ আলহাজ মো. শওকত চৌধুরী উপস্থিত থেকে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজের ফলক উন্মোচন করেন। এটি করা হয় ২০১৪ সালের ২২ জুন। এরপর তার উদ্যোগে একটি নির্মাণ কমিটি গঠন করে স্মৃতিসৌধ কাজ শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজের ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সরকারিভাবে বরাদ্দ ও স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজে। এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শেষ করতে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে বলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কমিটির সূত্রে জানা যায়। কিন্তু বর্তমানে অর্থ সঙ্কটে মাঝ পথে এসে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে আছে।
একই অবস্থা বিরাজ করছে গোলাহাট বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রেও। সেটিও অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ অবস্থায় এখানকার মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে স্মৃতিসৌধ ও গোলাহাট বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হতে আর কতদিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে ?
স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রসঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উত্তর জনপদের বাণিজ্য ও শিল্প প্রধান শহর সৈয়দপুর। এখানে রয়েছে শতাধিক কোটিপতি ব্যবসায়ী। আছেন অনেক শিল্পপতি। অথচ অর্থাভাবে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকবে এটি মেনে নেয়া যায় না। তা ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দর হয়ে প্রায় প্রতিদিনই সরকারে অনেক বড় বড় মন্ত্রী, এমপিরা আসা যাওয়া করছেন। তাদের সামনে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরতে পারলে এতো দিনে এর নির্শাণ কাজ শেষ হয়ে যেত। তিনি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ আটকে থাকার জন্য জড়িত সংশ্লিষ্টদের গাফলাতি ও উদাসীনতাকে দায়ী করেন।
তবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কমিটির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দুইটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে উদ্যোগ গ্রহন হয়েছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সংসদের উপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত একটি সভাও করা হয়েছে।
স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কমিটির অন্যতম একজন সদস্য ও সৈয়দপুর পৌরসভার সাবেক কমিশনার মো. আকতার হোসেন খান। তিনি জানান, সরকারি বরাদ্দের অভাবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে পড়েছে। তাই কাজ শেষ করার জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দের আশায় আর না থেকে স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে আগামী বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ