Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সর্বজনীন মানবাধিকার ও ইসলাম

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে অবহেলিত প্রসঙ্গটির নাম মানবাধিকার। স্মরণাতীত কাল থেকে এ অধিকারের মীমাংসায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সর্বত্র মানুষ আন্দোলন, লড়াই, আত্মবলিদান করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ম্যাগনাকার্টা থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব হয়, আমেরিকার Bill of Rights এর পথ ধরে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মহাসনদে এসে একটা মোটামুটি পরিণতিতে পৌঁছেছে এ লড়াই। মানুষ পেয়েছে তার আত্মমর্যাদা ও মৌলিক মানবিক অধিকারের একটা চলনসই স্বীকৃতি। এর পরেও ষাটের দশক হয়ে সত্তরের দশক পর্যন্তএ সনদেও হয়েছে অনেক সংযোজন।

ত্রিশটি ধারা সম্বলিত ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত ও ঘোষিত ব্যক্তি মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতা এবং অন্যান্য অধিকারের স্বীকৃতিসূচক সনদটির নাম Charter of Human Rights. এ সনদের অন্তর্ভুক্ত অধিকারসমূহের মধ্যে Civil and Political Rights (দেওয়ানি ও রাজনৈতিক অধিকার) এ গুলোকেই First Generation Rights রূপে চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। Economic and Social Rights (অর্থনীতিক ও সামাজিক অধিকার) এবং Environmental, Cultural and Development Rights (পারিবেশিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নের অধিকার), যেগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে যথাক্রমে Second and Third Generation Rights রূপে যা হয়েছে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। আসলে পশ্চিমা মানুষের দর্শন ও আদর্শ আর অভিজ্ঞতা ও স্বার্থ চিন্তাদ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত এ সনদকে উল্লেখিত ও আরও অন্যান্য দুর্বলতার জন্যই মোটামুটি চলনসই বলে মন্তব্য করা যায়। অন্যদিকে এ চার্টার বা মহাসনদও সব রাষ্ট্রে প্রবর্তনের ও যথার্থ প্রয়োগের জন্য কোনও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, বাধ্য করার মতো কোনও এজেন্সিও নেই। অন্যান্য অনেক কারণের মধ্যে এ কারণেও জাতিসংঘের প্রায় সকল সদস্য রাষ্ট্রে গৃহীত হলেও সর্বত্রই তা লঙ্ঘনের ফিরিস্তিও বেশ বড়। তাছাড়াও মনে রাখা দরকার যে, এ অধিকারগুলো প্রদাতা ও গ্রহীতা দুটো পক্ষ যা রাষ্ট্র/সরকার ও রাষ্ট্রের জনসাধারণ, যেন বিবদমান দুটো গোষ্টি অনেক লড়াইয়ের পর একটা চুক্তিতে পৌঁছেছে যে, চুক্তি বারে বারে নানাভাবে উভয় পক্ষেই লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ চুক্তি যাতে কেউ লঙ্ঘনের সাহস না করে, সেটা নিশ্চিত করার মতো কর্তৃপক্ষেরও রয়েছে অভাব। ইদানীং বিভিন্ন দেশ যা করছে, তাতে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে লঙ্ঘনের কাজটাই বেশি হচ্ছে।
মানুষ অত্যন্ত মহীয়ান জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান, এতে সন্দেহ নেই। তবে মানুষের সমস্ত ইতিহাস অধ্যয়ন করলেও এমন কোনও নজির পাওয়া যাবে না যে এ মহীয়ান, জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাশীল ও বুদ্ধিমান মানুষ শুধু তার প্রজ্ঞা আর বুদ্ধি দিয়ে নিজের বা বিশ্বমানবের সামগ্রিক কল্যাণকর কোনও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মানুষ শুধু মানুষের জন্য নয়। মানুষ সারা বিশ্বের কল্যাণ করতে পারে কেবল তখনই যখন তার সবকিছুকে সকল বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা আর কল্যাণের আকর বিশ্বস্রষ্টার কর্তৃত্বের কাছে সমর্পন করতে প্রস্তুত হয়। ধর্মনিরপেক্ষ ও তথাকথিত মানবতাবাদীরা এ তত্ত¦কে নাকচ করতে গিয়ে অনেক যুক্তিই খাড়া করেছেন। ধর্মকে বিশেষত একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহকে প্রভুত্ববাদী বলে সমালোচনা করেছেন। তাদেরকে অতি সংক্ষেপে জবাব দিতে গেলে এটুকুই বলা যায় যে, ধর্ম অন্তত মানুষকে বানরের সন্তান, অর্থনৈতিক বা যৌনতামূলক জীবনরূপে চিহ্নিত করেনি, সৃষ্টিকর্তার প্রতিমূর্তি বা ইমেজ অব গড (খ্রিস্ট ধর্ম), অমৃতের পুত্র (সনাতন ধর্ম), আল্লাহর প্রতিনিধি (ইসলাম) রূপে আখ্যায়িত করে মর্যাদাবান করেছে। এর পরে অবশ্য মানুষের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাগুলোও নানাধর্মে নানাভাবে চিহ্নিত ও আলোচিত হয়েছে। আর একেশ্বরবাদী ধর্ম, বিশেষত ইসলাম যার একেশ্বরবাদ নিরঙ্কুশ, সে তো কোনও অলীক, কোনও উপচ্ছায়াতে বিশ্বাসের কথা বলে না। কেন না, বিজ্ঞান, যুক্তি কোনও কিছুই একেশ্বরবাদকে নাকচ করে না, কিছুকে যদি নাকচ করা সম্ভবও হয়, তবে তা ধর্ম ব্যাপারটাই একেশ্বরবাদ নয়, বহু দেববাদী ধর্মেও সৃষ্টিকর্তা কিন্তু একজনই।
তাহলে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে- ১. মৌলিক মানবাধিকারের ধারণাটির সঙ্গে শুধু মানবীয় সীমাবদ্ধতা নয়, জড়িয়ে আছে পশ্চিমা মানুষের বিশেষ দর্শন, আদর্শ, অভিজ্ঞতা আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বার্থবুদ্ধিও। ২. বর্তমান রূপে এ অধিকারগুলো যেরকম আছে, মোটামুটি চলনসই হলেও তা প্রবর্তন ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করানোর জন্য কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, কোনও শক্তিশালী এজেন্সিও নেই। ৩. এগুলো লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি না, তা দেখার ও লঙ্ঘিত হলে শাস্তি বিধানের জন্য কোনও সার্বভৌম ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষও নেই। ৪. ধর্ম মৌলিকভাবে মানুষের মহত্ব ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করে। ৫. একেশ্বরবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগও এক ধরনের অজ্ঞতাজনিত বিভ্রান্তি।
ইসলামে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে আমরা এ পর্ব থেকে আলোচনা করতে পারি। ইসলামের একেশ্বরবাদই তার সবকিছুর উৎস ও শক্তি। সর্বশক্তিমানও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী বিশ্বপালক ও বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বাধ্য হয়ে যাই, মানবজাতির ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য আর জীবনের বিভিন্ন বিভাগের ঐক্যের স্বীকৃতি দিতে। এ থেকেই আমরা মানতে বাধ্য হই যে, ভাল ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ, দেশ-জাতি-বর্ণ-বংশ নিরপেক্ষ। যা ভাল একজনের জন্য, তা সবার জন্য ভাল, যা একজন মানুষের জন্য মন্দ, তা সকল মানুষের জন্য মন্দ, যা একজনের জন্য কল্যাণকর, তা সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর, যা অকল্যাণকর তাও এরকম। অতএব এ ব্যাপারগুলো নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী বিধি নিষেধ ও মৌলিকভাবে বিভিন্ন হতে পারে না। তৃতীয় যে কথাটি মেনে নিতে হয়, তা এই যে, এসব বিধিনিষেধ, অধিকার ও দায়িত্বও সকল মানুষেরই সমান। এ ক্ষেত্রে কেউ দাতা আর কেউ গ্রহীতা নয়। এখানে টানাপোড়েন নেই, শাসক ও শাসিত সবাই একই উৎস থেকে আগত বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত। শাসক ইচ্ছে করলেই এ বিধিনিষেধ রহিত করে নিজের বা নিজের শ্রেণীর সুবিধামত আইন তৈরি করতে পারে না। প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা আছে তার জন্যও মূল চরিত্রকে অক্ষুণœ রেখে ইজতিহাদ বা মূল উৎস থেকে প্রয়োগে বিবেক খাটানোর মতো জ্ঞান বুদ্ধিস¤পন্ন অভিজ্ঞ ও স্বীকৃত ব্যক্তিদের ঐক্যমত্যের প্রয়োজন আছে। প্রয়োজনীয় অমৌলিক আইন প্রণয়ন অবশ্য অন্য ব্যাপার। শুধু একেশ্বরবাদ নয়, আইন ও জীবন ব্যবস্থা প্রাপ্তির উৎস রসুলতত্ত¦ও স্বীকার করতে হয়, নতুবা মাঝখানে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা ভরাট করার কোনও সুযোগ থাকে না। আর তারপরই আসে পারলৌকিক হিসেব নিকাশ ও জবাবদিহির কথা। এসব বিশ্বাসও তাকে মনে-মগজে, আচার-আচরণে প্রতিফলিত করার জন্য করণীয় উপাসনা-আরাধনা মিলে যে বোধের জন্ম দেয় মানুষের মধ্যে তা মানুষকে করে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ,কেবল অধিকারের জন্য সংগ্রামী নয়। মানুষের অন্তরাত্মাই আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে তাকে বাধ্য করে সকল মানুষের জন্য ন্যায় ও ইনসাফমূলক ব্যবস্থাটিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে ও তার সুরক্ষার জন্য সদাজাগ্রত প্রহরী হয়ে থাকতে। তবে এ প্রসঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার যে, এটা বায়বীয় তত্ত¡ নয়, বাস্তবক্ষেত্রে যা হয় তা হল একটি ইসলামিক পরিবেশে মানুষ যে আত্মমর্যাদা বোধের অধিকারি হয় যা প্রত্যেকটি ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত আর সামগ্রিকভাবে সমষ্টিগত চেতনায় হয় পরিণত, তাই শাসক ও প্রশাসনকে করে দায়িত্বশীল, নাগরিককে করে সচেতন। মনে রাখা দরকার, শাসকের ও প্রশাসনের জবাবদিহি চূড়ান্তক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে। কিন্তু পার্থিব ক্ষেত্রে করতে হয় প্রত্যেকটি নাগরিকের কাছে। এ দুটো জিনিসকে ইসলামী পরিভাষায় বলা যায় তাকওয়া ও ইহতিসাব-খোদা ভীতি ও আত্মসমীক্ষা বা পারপরিক সমীক্ষা ও সংশোধন।
ইসলামে ন্যায় ও ইনসাফ এবং মানুষ হিসেবে মানুষের যে সব অধিকার থাকার প্রয়োজন, তার সবগুলোই পূর্ণাঙ্গভাবে দেওয়া হয়েছে এবং তা চ‚ড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ। কোনও পরিস্থিতিতে কোনও দুর্বলতার বশবর্তী হয়ে তাতে হেরফের করার অধিকার কারও নেই। আল্লাহ বলেন, কোনও জাতির (অথবা জনগোষ্ঠীর) শত্রুতাচরণ যেন তোমাদেরকে (তাদের প্রতি) ন্যায় না করতে বাধ্য করে, তোমরা ন্যায় কর। তা আল্লাহ ভীতির অতি নিকটবর্তী। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘ন্যায় কর যদি তা তোমার নিকটাআত্মীয়ের বিরুদ্ধে অথবা তোমার নিজের বিরুদ্ধেও করতে হয়। এ নির্দেশগুলো মান্য করে নজির সৃষ্টি করার উদাহরণে পরিপূর্ণ ইসলামের ইতিহাস। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য যে, ইসলাম তার এ সামগ্রিক চেতনার পটভ‚মিকায় মানুষের দ্বারা মানুষের প্রতি ন্যায় ও ইনসাফ করার যে ব্যবস্থা দিয়েছে, তা বর্তমান মানবাধিকারগুলো ছাড়া আরও অনেক কিছুকে বিধৃত করেছে যা আপাতদৃষ্টিতে হয়ত এ পর্যায়ভুক্ত বলে মনে হবে না, যেমন শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো, অর্থাৎ মায়ের দুধের উপর নবজাত শিশুর নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অধিকার। আসলে সেখান থেকে শুরু করে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধবন্দীদের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার সবকিছুই ইসলামী মানবাধিকার সনদের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই কেউ কোনও পশ্চিমা মডেলকে মূল ভিত্তি মনে করে খুঁজে খুঁজে তার সঙ্গে মিলস¤পন্ন কিছু অধিকার চিহ্নিত করতে চায়। তবে তা ইসলামি মানবাধিকারের মেজাজ ও প্রকৃতি মোতাবেক হবে না। যেহেতু ক্ষুদ্র পরিসরে ইসলামে মানবাধিকারের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়, তাই কিছু সংক্ষেপে করতেই হচ্ছে। নিম্নে সংক্ষেপে শুধু এ অধিকারসমূহের ঝাঁকি দর্শন করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রাণের সুরক্ষা: ইসলাম মানুষের প্রাণকে অপরিসীম মূল্যবান বলে ঘোষণা করেছে এবং তাই একজন মানুষের হত্যাকে (অবশ্যই বেআইনিভাবে) সকল মানুষের হত্যা বলে ঘোষণা করেছে। অনুরূপ বলেছে, যে একজন নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের প্রাণ বাঁচালো সে যেন সমগ্র মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করল।
মালের সুরক্ষা: বৈধভাবে অর্জিত মাল থেকে জাকাত, ফিতরা, মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়ের অধিকার আদায়ের পর এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও প্রতিরক্ষার জন্য, অন্যান্য সামাজিক কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র বা সমাজ যে অর্থ দাবি করে তা দেবার সামর্থ্য থাকলে দেওয়ার পর বাকি অংশের সুরক্ষা বাধ্যতামূলক। এ মাল অথবা আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণদান করলে সে ব্যক্তি শহিদ বলে গণ্য হবে। তবে অবশ্যই মালের অপচয় যেহেতু ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর, তাই তা প্রতিরোধ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আত্মমর্যাদার সুরক্ষা: কাউকে অহেতুক সন্দেহ করা, কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা, কুৎসা রটানো, বিনা অনুমতিতে গৃহে প্রবেশ, চিঠিপত্র খুলে ফেলা বা পড়া, এমনকি কোথাও বিবাহের প্রস্তাব থাকলে সেখানে গিয়ে নতুন প্রস্তাব দেওয়া, বিকিকিনির বেলায় অন্যের ঢুকে পড়া-এসবই তার আত্মমর্যাদার খেলাফ। এ মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটা এতটুকু গুরুত্বপূর্ণ যে কেউ তার ঘরে উঁকিঝুঁকি মারলে সে ব্যক্তির চোখ কানা করে দিলেও তা অপরাধ বলে আদালতে গণ্য হবে না। বলা বাহুল্য, প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষাও এ পর্যায়ভুক্ত।
ব্যক্তি স্বাধীনতার সুরক্ষা: ইসলামী রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তিকেই প্রকাশ্য আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্তগ্রেফতার করা যাবে না। কেবল সন্দেহ আর অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতারের সুযোগ ইসলামে নেই। অনুরূপ নজরবন্দি করে রাখা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কারণে প্রতিরোধমূলক গ্রেফতারির দ্বারা কারাবন্দি করে রাখাও ইসলামে বৈধ নয়। আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ দিতে হবে। নির্যাতনের তো প্রশ্নই উঠে না।
একের দোষে অন্যের শাস্তি নয়: কোনও ব্যক্তিকেই তার অন্য কোনও শত্রুপক্ষের লোক বলে তার নিজের ব্যক্তিগত কোনও অপরাধ ব্যতীত কোনওভাবে অভিযুক্ত করা যাবে না।
অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার: ইসলামে জুলুম অত্যাচার তো দূরের কথা, খারাপ গালিগালাজ পর্যন্তকরা অপরাধ। জুলুমের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সমাজের কর্তব্য, তা এমনকি শাসকের দ্বারা হলেও। তুর্কি সুলতান আর্সেনিয়ায় খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচার করলে তুর্কির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা শেয়খুল ইসলাম এ দায়িত্ব পালনেই প্রতিবাদ করে সুলতানকে ভর্ৎসনা ও নিরস্ত করেছিলেন।
বিবেক ও বিশ্বাসের অধিকার: ধর্মে কোনও জোরজবরদস্তি নেই- ক্বোরআনের ঘোষণা। প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের বিবেক বুদ্ধি ও পছন্দ অনুসারে ধর্ম গ্রহণ ও অনুসরণ করার অধিকার আছে।
সমতার অধিকার: আল্লাহর রসুলের বাণী- আরবে আজমে কালো ও গোরায় কোনও ভেদাভেদ নাই। সকল মানুষ সমান, সকলে একে অপরের, সকলে তোমরা মাটির মানুষ আদমের সন্তান। তার সঙ্গে যোগ করুন আল্লাহর বাণী- তোমাদের সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান, যে খোদাভীরু, অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ভয়ে ও আনুগত্যে দায়িত্বশীল। অতএব ইসলামি রাষ্ট্রে জাতি-ধর্ম-বংশ নির্বীশেষে সকলের সকল অধিকারও সমান। যদি কোনও রাষ্ট্রে অমুসলিম থাকেন, তবে তাদের জানমালের সুরক্ষা একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবেই বিবেচিত হয় সরকার ও সমাজের।
ন্যায় বিচারের অধিকার: এ বিষয়টি কয়েকবার উল্লেখ করা হয়ে গেছে। নিরঙ্কুশ ন্যায় বিচারে ইসলামের ইতিহাস অনন্য হয়ে আছে।
পাপ থেকে বেঁচে থাকার অধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের এ অধিকার আছে যে তারা সরকার কোনও অন্যায়, অপরাধ কিংবা পাপমূলক কাজে কাউকে বাধ্য করতে পারবে না। তারা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কিংবা সমষ্টিগত ক্ষেত্রেই হোক, তা প্রত্যাখান শুধু নয়, সরকারকে তার সিদ্ধান্তপরিবর্তন করতে বাধ্য করার জন্য সংগ্রামও করবে।
স্বাধীনভাবে সভা-সমিতি করার অধিকার: একমাত্র অন্যায় ও পাপকার্য চালানোর প্রচেষ্টা ছাড়া বাকি যে কোনও উদ্দেশ্য এ অধিকারও মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত।
রাজনৈতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ: সরকারের প্রতি নির্দেশ জনসাধারণের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকারি কাজকর্ম চালানো। অতএব এ কাজে শরিক হওয়ার জন্য নারীপুরুষ নির্বীশেষে সবার অংশগ্রহণ করার অধিকার রাখে।
স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রের যে কোনও জায়গায় যাতায়াত ও বসবাসের অধিকার: প্রয়োজনে এতে সরকারি সাহায্য পাওয়ারও অধিকার আছে।
শ্রমের মূল্যের উপর অধিকার: শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে তার মজুরি আদায় করে দিতে হবে। তার অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থান ইত্যাদি প্রয়োজনে দেখতে হবে মালিকপক্ষের। তাকে শিল্প চালনায়ও অংশীদার করতে হবে। তার সামর্থ্যরে বাইরে খাটানো চলবে না বরং নিজের আহার-বিহারের মানের সঙ্গে মিল রেখে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা দিতে হবে।
এগুলো ছাড়াও ভ্রুণেরও সুরক্ষার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছে আল ক্বোরআন: নিহত ভ্রণকে জিজ্ঞেস করা হবে শেষ বিচারের দিনে কী অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল? অর্থাৎ হত্যাকারীর শাস্তি অতি কঠোর। অতএব পার্থিব শাস্তিও হবে কঠোর। মা-বাবার অধিকারও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরেই। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার সমান সমান। মহিলাদের স¤পত্তির অধিকার, ভোটাধিকার, সামর্থ্যে কুলোয় এরকম সকল কাজ করার অধিকার, বিনা অনুমতিতে কারও সঙ্গে বিয়েতে রাজি না হওয়ার অধিকার সাব্যস্ত ইসলামে। সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পানীয়জলের বন্দোবস্ত এবং যেখানে কোনও কয়েদি জরিমানা আদায় করতে পারছে না, সেখানে তার জরিমানা সরকারি তহবিল থেকে আদায় করে দেওয়া সরকারের কর্তব্য। ঋণদার ব্যক্তির ঋণ আদায় করে দেওয়াও এরকম।
উপসংহারে একটি জরুরি কথা না বললেই নয়। তা এই যে, ইসলাম ও তার ব্যবস্থায় মানবাধিকারের পক্ষে যা লেখা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয়ত দেখতে পাওয়া যাবে না। তা ইসলামের দোষ নয়। সমাজের পতন হয় এক এক সময়, মুসলমান সমাজেরও পতন হয়েছে, তাদের স^র্ণযুগে-নবী (সা.) ও খোলাফায়ে রাশিদিনের যুগে কাম্য মানে পৌঁছাতে পেরেছিল ইসলামি ব্যবস্থা। পরে রাজতন্ত্র শেকড় গাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতা আসতে শুরু করে ধীরে ধীরে কিসে কী হল সে এক দীর্ঘ কাহিনী। তবে সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজের চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়নি। কোনও কোনও লেখক উল্টো পাল্টা বুঝাতে চান যে, কোনও বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর মানুষ সামগ্রিক অবস্থার মধ্যে ঘুণ ধরার জন্য দায়ী, তাদেরকে গালাগালি দিলেই কেল্লা ফতে। না, আমরা সবাই দায়ী, আর দায়ী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। এই যে আমরা এসব নিয়ে ভাবছি, তা আরও অনেকেই, হাজার জনেই করছেন। গালাগালি, অন্যায় সমালোচনা, অসহিষ্ণুতা ত্যাগ করে শীতল মস্তিস্কে চিন্তাভাবনা করে এগুলে অনেক কিছুরই পরিবর্তন সম্ভব। তবে কোথাও যদি ইসলামের ব্যবস্থার মডেল প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে এ কালের মানুষের সামনে শুধু তত্ত¦ নিয়ে হাজির হলে কোনও কাজ হাসিল হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ