ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
হজরত ইমাম কাজী আবু ইউসুফ (রহ.) ছিলেন হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এর শীর্ষস্থানীয় শাগরিদ, হানাফী মাজহাবের অন্যতম স্তম্ভ এবং ইসলামের প্রথম প্রধান বিচারপতি। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি জগত বিখ্যাত। আব্বাসীর খেলাফতের প্রাথমিক যুগে তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। হিজরী ১৮২ সালের ৫ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালে ইমাম আবু ইউসূফের (রহ.)-এর নামে মোহতারাম ওস্তাদ ইমামুল মুরসালিন হজরত আবু হানিফা (রহ.) একখানা ঐতিহাসিক পত্র প্রেরণ করেন, যা সকলের সাথে কীভাবে চলতে হবে, আচরণ করতে হবে, তা বর্ণিত হয়েছে। হেদায়েতনামা নামে খ্যাত এ গুরুত্বপূর্ণ পত্রখানা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। কোনো কোনো আরবী গ্রন্থে এর পূর্ণ বিবরণ রয়েছে যার অনুবাদ-সারাংশ বিভিন্ন ভাষায় সংকলন হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ও প্রিয় ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে হজরত ইমাম আজম (রহ.) বলেন:
সুলতানের নিকট খুব বেশি আসা-যাওয়া করবে না। তার সং¯্রব হতে এমনভাবে দূরে অবস্থান করা উচিত, যেমনিভাবে মানুষ আগুন হতে দূরে থাকে। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত দরবারে গমন না করা উত্তম। যদি দরবারে তোমার কোনো অপরিচিত লোক উপস্থিত থাকে, তবে সেখানে মোটেও যাবে না। কারণ, তার মানমর্যাদা তোমার জানা নেই, হতে পারে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনার সময় এমন কিছু বলে ফেলবে যাতে তাদের মানসম্মান ক্ষুণœ হতে পারে। যদি তারা তোমার চেয়ে সম্মানী বা মর্যাদা সম্পন্ন হয় এবং তুমি তা রক্ষা করতে না পারো, তবে তা হবে তোমার অন্যায় ও বোকামী। যদি সাধারণ লোককে তুমি খুব বেশি সম্মান প্রদর্শন করো, তাহলে সুলতানের দৃষ্টিতে তুমি হেয় প্রতিপন্ন হবে। সুলতান যদি তোমাকে বিচারক নিযুক্ত করতে চান, প্রথমে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি তোমার মতবাদ, চিন্তাধারার সাথে একমত পোষণ করেন কিনা। কেননা, এমনও হতে পারে যে, সুলতানের চাপের মুখে তুমি নিজের মতের বিরুদ্ধে কাজ করে ফেলবে। আর যে কাজে তোমার কোনো যোগ্যতা নেই, তা কখনো গ্রহণ করবে না।
এসব হেদায়েত বা উপদেশ মালায় সুলতানের মর্যাদার বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকলেও বিশেষ সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এতে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই শেষদিকে ইমাম সাহেব লিখেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি শরীয়তে কোনো প্রকারের নতুনত্ব সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়, তবে প্রকাশ্যভাবে এর বিরোধিতা করবে, যেন লোকে এর অণুকরণ-অনুসরণ করতে সাহসী না হয়; চাই ব্যক্তি সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত থাক, কিংবা উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হোক সেদিকে মোটেও ভ্রæক্ষেপ করবে না।
আলোচ্য হেদায়েতনামার পূর্ণ বিবরণ নি¤েœ প্রদত্ত হল:
হে প্রিয় ইয়াকুব !
সুলতানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, তার মানমর্যাদার কথা মনে রাখবে। এবং হ্যাঁ, তার নিকট সব সময় এবং সর্বাবস্থায় যাতায়াত করবে না। যদি তুমি তার নিকট অধিক আসা-যাওয়া করতে থাকো, তাহলে তোমার মর্যাদা ক্ষুণœ হবে এবং তুমি তার দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন হবে। তোমার সম্মান-গুরুত্ব হ্রাস পাবে। আগুন থেকে যেভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়, তেমনিভাবে তার থেকে সাবধানে থাকবে। আগুন দ্বারা উপকৃত হবে, কিন্তু তা হতে দূরে থাকবে, নিকটবর্তী হলে পুড়ে যাওয়ার আশংকাও থাকে এবং হ্যাঁ, তার সামনে দীর্ঘ কথাবার্তা হতেও বিরত থাকবে।
সুলতানের দরবারে যদি তোমার অপরিচিত লোকজন উপস্থিত থাকে, তাহলে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করবে। কারণ যখন তোমার এই কথা জানা নেই যে, তারা কোন মর্যাদা-সম্মানের লোক, তবে তাদের সম্বোধনের সময় তাদের যথাযথ মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ প্রদর্শিত নাও হতে পারে। যদি তারা তোমার চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়, তুমি যদি তার খেয়াল না রাখো এটা হবে অসদাচারণ, আর যদি তারা মামুলি বা সাধারণ লোক হয়, কিন্তু তুমি তাদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করো তাহলে সুলতানের দৃষ্টিতে তুমি অধম ও গুরুত্বহীন প্রতিপন্ন হয়ে যাবে।
ত্বরিত বিচার পদ গ্রহণ করবে না: সুলতান যদি তোমাকে বিচারকের পদ পেশ করেন, তবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা গ্রহণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, তিনি তোমার চিন্তাধারার সঙ্গে একমত, তোমার ইজতেহাদ, চিন্তাধারা মানেন, তোমার মতবাদ সমর্থন করেন, যাতে তোমাকে এমন কথা না বলতে হয়, যা তোমার মত ও রায়ের পরিপন্থী। যে পদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য তোমার নেই, তা কিছুতেই তুমি গ্রহণ করবে না। সুলতানের তল্পী বাহক তোশামোদীদের সঙ্গে বেশি দহরম-মহরম করবে না। লোকদের কেবল প্রশ্নের জবাব দেবে- অতিরিক্ত কিছু বলবে না, কারবার করবে না। কারবারের সঙ্গে অধিক সংযোগ রাখবে না। যেন লোকেরা এইরূপ ধারণা পোষণ না করে যে, তোমার অর্থলোভ আছে এবং তোমাকে ঘুষখোর মনে করতে পারে। সাধারণ লোকজনের সামনে হাসবে না, এমনকি অধিক মুচকি হাসিও না। বাজারে কম যাতায়াত করবে। কমবয়সী ছেলেদের সাথে কথাবার্তা বিনা প্রয়োজনে বলবে না। মেলামেশাও করবে না। কেননা, এটি হচ্ছে একটি বড় ফেতনা ও বিপদের কারণ। তবে বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলাতে পারো এবং তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারো। দোকানে বসবে না। সড়ক পথে উঠাবসা করবে না। বাজারে পানাহার করবে না, মসজিদেও না, বেহেশতিদের (যারা পানি পান করায়) কাছ থেকে চলার পথে পানি পান করবে না।
ইমাম আজম তার ভক্ত ছাত্র ও প্রধান বিচারপতিকে এসব ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান উপদেশ প্রদান করেন, যা নি¤œরূপ: রেশমী কাপড় পরবে না, অলংকার ব্যবহার করবে না। এ দ্বারা ঔদ্ধত্য সৃষ্টি হয়। যদি একাধিক বিয়ে করো তাহলে প্রত্যেক স্ত্রীকে আলাদা গৃহে রাখবে। দ্বিতীয় বিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত করবে না যতক্ষণ না তোমার পূর্ণ বিশ্বাস হবে যে, তুমি অতিরিক্ত ব্যয় বহনে সক্ষম হবে এবং এ ব্যয়ভার সহজে বহন করতে পারবে।
প্রথমে জ্ঞান অর্জন করবে, অতঃপর অর্থ লাভের চেষ্ট করবে, ধন-সম্পদ লাভের পূর্বেই বিয়ে করবে। আল্লাহকে ভয় করতে থাকবে। আমানতে তসরুফ করবে না। আম-খাস তথা সর্বস্তরের লোকদের সৎ পথের দিকে আহŸান করতে থাকবে। সাধারণ লোকদের সঙ্গে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে কথাবার্তা বলবে না, দশ বছরই যদি অর্থহীন ও দারিদ্র্যে অতিবাহিত হয়ে যায় তা হলেও জ্ঞানার্জন হতে বিরত থাকবে না।
যদি বাজারী লোক ও সর্বসাধারণ তোমার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে চায়, তাহলে তাদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হবে না। এভাবে তোমার মর্যাদা হ্রাস পাবে।
সত্য কথা বলতে কাউকে ভয় করবে না, চাই সে সুলতানই হোক না কেন, যা বলবে- যখন বাহাস-বিতর্ক করবে কিংবা মোনাজারা বিতর্কে অবতীর্ণ হবে তখন দলীল প্রমাণ সামনে রাখবে। যাদের সঙ্গে বাহাস-বিতর্কে লিপ্ত হবে তাদের ওস্তাদবৃন্দ ও শায়খদের প্রতি কোনো তিরস্কার বা কটুক্তি করবে না।
নিজের জাহের-বাতেন প্রকাশ গোপন রাখবে। অধিক হাসবে না, এতে অন্তর মরে যায়। চলার সময় ধীরগতিতে চলবে। লাফিয়ে লাফিয়ে চলবে না। তাড়াহুড়া করে বা দ্রæত কাজ করবে না। চিৎকার করে কথা বলবে না। চিল্লিয়ে কোনো কাজ হয় না। উত্তমরূপে কোরআন তেলাওয়াত করবে। অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করবে। সর্বাবস্থায় তার শোকর গুজারী করবে। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।