Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনিয়মই যেখানে নিয়ম!

সরকারি নগরকান্দা মহাবিদ্যালয়

ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ফরিদপুরের সরকারি নগরকান্দা মহাবিদ্যালয়ে সকল অনিয়মই যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, সেবাখাতের অর্থ আত্মসাৎ, সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে লুটপাট।
এ ছাড়া শিক্ষকদের নিয়মিত কলেজে না আসা ও বদলিকৃত শিক্ষক পদে নতুন শিক্ষক নিয়োগ না দেয়ায় কলেজের শিক্ষার মান দিন দিন নেমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটি প্রথমে উচ্চ মাধ্যমিক ও পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে জাতীয়করণের পর সরকারি নগরকান্দা মহাবিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠানটির নবযাত্রা হলেও এলাকাবাসীর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে কলেজটিতে প্রায় আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী, ২২ জন শিক্ষক ও ১৬ জন কর্মচারী রয়েছে।
জানা গেছে, সরকারি নগরকান্দা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ বিজন কৃষ্ণ মৃধা ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি এ কলেজে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। শিক্ষকেরা তাদের ইচ্ছামতো কলেজে আসছেন। মনে চাইলে ক্লাস নিচ্ছেন, আবার চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো শিক্ষক মাসে একদিন কলেজে এসে বেতন বিলে স¦াক্ষর করে চলে যান, এমন অভিযোগও রয়েছে। কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষকরা নিয়মিত কলেজে না আসায় এবং নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা না নেয়ায় আমাদের লেখাপড়ার মান ক্ষুণ হচ্ছে। প্রতিদিন ১২টার পর বেশির ভাগ শিক্ষককে আর কলেজে পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা হলে তারা জানান, শিক্ষার্থীরা চলে গেলে আমরা কাদের নিয়ে ক্লাস করব।
কলেজে মোট ৩৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ইতোমধ্যে ইংরেজি শিক্ষকসহ ১০ জন শিক্ষক অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। সেসব পদে নতুন কোনো শিক্ষক না আসায় ওই বিষয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা তাদের লেখাপড়ার মান নিয়ে চিন্তিত।
এ ছাড়াও কলেজের বিভিন্ন খাতে কাজ না করে ভুয়া ভাউচারে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সেবাখাতে প্রতি বছর আট লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোনো কাজ না করেই অর্থ ভাগ-ভাটোয়ারা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাজ থেকে আরো অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রতি বছর তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। সেই অর্থ ভুয়া ভাউচার বানিয়ে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। যেমনÑ অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া ৪০ টাকা, বহি: ক্রীড়া ৫০ টাকা শিক্ষার্থী প্রতি আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু কলেজে কোনো দিন বা বছরে কোনোরকম ক্রীড়া চর্চা হয় না বা কোনো খেলার সামগ্রী ক্রয় করা হয়নি। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে ৩০ টাকা আদায় করা হয়ে থাকে। কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয় না।
ম্যাগাজিন না ছাপালেও ম্যাগাজিন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নামে ৮০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র না দিয়েও ৩০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় ও উন্নয়ন ফির নামে শিক্ষার্থী প্রতি ৫৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। ল্যাবরেটরি ফির নামে ১০০ টাকা আদায় করা হলেও ল্যাবরেটরিতে কোনো সরঞ্জাম নেই এবং কোনো কার্যক্রম হয় না।
এ ছাড়াও অধিভুক্তি ১০০, ব্যবস্থাপনা ৫০ টাকা, ইনকোর্স ফি ২০০ টাকা, এরপরও বিবিধ খাত নামে আরো ১০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ডিগ্রি পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ অতিরিক্ত ২০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। যারা টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে ফরম পূরণ করেছে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরো ২০০ করে টাকা আদায় করা হয়েছে। আর এ সমস্ত খাতের আদায়কৃত কোনো কোনো খাত রশিদে উল্লেখ করা হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা আরো জানায়, বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সনদ উত্তোলন, রেজিস্ট্রেশন কার্ড উত্তোলন, প্রবেশ পত্র নেয়া প্রভৃতির নামে অর্থ আদায় করা হয়ে থাকে। উপবৃত্তির জন্য আবেদন ফরম ক্রয় বাবদ ৫০ টাকা এবং উপবৃত্তির তালিকায় যার নাম উঠে, তার কাছ থেকে পুণরায় ১০০ টাকা করে আদায় করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক জানান, কলেজের অধ্যক্ষ বিজন কৃষ্ণ মৃধা ও প্রায় সারা বছর ঢাকায় অবস্থানকারী শিক্ষক কাউন্সিলরের সাধারণ সম্পাদক ইসলাম শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক মো. রেজাউল করিমের সিদ্ধান্তে এই সমস্ত টাকা উত্তোলন করা হয়। ভুয়া বিল বানিয়ে সেই টাকা শিক্ষক কাউন্সিলের সবাই ভাগ করে নেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
প্রভাষক মো. রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে মোবাইল ফোনে জানান, ভুয়া বিল বানিয়ে সেই টাকা শিক্ষক কাউন্সিলের সবাই ভাগ করে নেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। তবে ক্রীড়া, ম্যাগাজিনসহ যে সব খাতে শিক্ষার্থীদের টাকা নেয়া হয়, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হয় না। প্রতিষ্ঠানের কিছু অনিয়ম ও বিভিন্ন সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি আরো বলেন, ল্যাবরেটরিতে আশানুরূপ কার্যক্রম হয় না, শিক্ষক সঙ্কটে আমরা জর্জরিত। ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা অন্যত্র চলে গেলেও নতুন কোনো শিক্ষক গত এক বছরে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
এ সব অভিযোগের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ বিজন কৃষ্ণ মৃধা বলেন, বিভিন্ন পরীক্ষার কারণে ক্লাস হয় না, যেমন মাদরাসার জেডিসি, জেএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হওয়ায় ক্লাস বন্ধ থাকে। ক্লাস খোলা থাকলে তা ঠিকমতোই নেয়া হয়। দুপুরে শিক্ষকদের চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শুধু এই কলেজ না, খোঁজ নিয়ে দেখেন, দুই একটি বড় কলেজ ছাড়া সব কলেজেরই একই চিত্র।’ শিক্ষকদের ইচ্ছেমতো আসা-যাওয়া ও হাজিরায় গরমিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্লাসের সময়ে শিক্ষকরা আসেন, ক্লাস শেষ হলে চলে যান, এখানে শিক্ষকদের হাজিরার কোনো খাতা নেই। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে টাকা আদায় করে তা ব্যয় না করা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, ২৩টি খাতে সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী টাকা নেয়া হয়, ব্যয় না হলে সে টাকা ফান্ডেই জমা থাকে। পরিপত্রের বাইরে কোনো টাকা নেয়া হয় না বলেও তিনি দাবি করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ