পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘সোয়া চান পাখি আমার/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’ বারী সিদ্দিকীর গাওয়া এই গান সারাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বাস-ট্রেন-লঞ্চ-স্টীমার এবং গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে কান পাতলেই শিশু-তরুণ-তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষের কণ্ঠ থেকে বাসাতে এই গানের সুর ভেসে আসে। অথচ উকিল মুন্সির লেখা এই গানের সঙ্গে দেশের মানুষের তেমন পরিচয় ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে বারী সিদ্দিকী গানটিতে কণ্ঠ দেন। তাঁরই কণ্ঠে ওই সিনেমার ‘পূবালী বাতাসে’ ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ ও ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ’ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পশ্চিমাদের অনুকরণ-অনুসরণে দেশে ব্যাÐ সংগীতের ডামাডোলের মধ্যে দেশজ ও গ্রামের লোকজ গানকে শোতাদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন শিল্পী বারী সিদ্দিকী। গতকাল ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। নেত্রকোনার বাউল বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন; কিন্তু তার কণ্ঠের যাদু গানগুলো বহুদিন মানুষ হৃদয়ে ধারণ করবে। মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দিন, পল্লীগীতির আবদুল আলিম, বাউল শিল্পী আবদুল করিমের মতো বারী সিদ্দিকীও বেঁচে থাকবেন দেশের মানুষের মধ্যে লোকজ শিল্পী হিসেবে।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের সেরা---- আমার জন্মভূমি’। সত্যিই তাই। বাংলাদেশের মতো দেশ বিশ্বে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় কবি, সাহিত্যিক, লেখক, কণ্ঠশিল্পী, নাট্টকার, অভিনেতা’র সংখ্যা এতো বেশি যে অনেক দেশে তা কল্পনাও করা যায় না। টাকা খরচ করে বই বের করলেই লেখক, কণ্ঠ যাই হোক টাকা খরচ করে ক্যাসেট বের করলেই কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও নাট্টকারদের অবস্থা একই রকম। ইদানিং বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে নিত্যদিন গানের লাইভ অনুষ্ঠান করায় দেশে কণ্ঠ শিল্পীর বাড়বাড়ন্ত এতোই বেড়েছে যে শুমারি করেও তাদের সংখ্যা নির্নয় করা কঠিন। দেশে কাক বেশি না শিল্টী বেশি তা নির্নয় করতে চাইলে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে। হালে পশ্চিমাদের বেখাপ্পা নাচানাচির গান ব্যাÐ সংগীতের অনুকরণে দেশে যে সংগীতের আবির্ভাব ঘটেছে; তা নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো গবেষণা হবে। মাইকেল মধুসুদন দত্ত না পড়ায় বিদেশীদের অনুকরণ করতে গিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে গান গাওয়ার যে রেওয়াজ চলছে তা সত্যিই কি সংগীত?
শিল্পী প্রতিভা শুধু প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় নয়; আল্লাহ প্রদত্ত বিষয়ও বটে। আল্লাহ মানুষকে কণ্ঠ দান করেন। প্রতিভা আল্লাহর দান না হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অল্প শিক্ষিত কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও নবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই নিয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতো গবেষণা হবে কেন? আমরা হুজুগের জাতি। কোনো কিছু নিয়ে হুজুগ উঠলেই সবাই সেদিকে ছোটেন। এখন দেশে চলছে শিল্প-কবি-সহিত্যিক হয়ে নাম কামানোর হুজুগ। কবি শিল্পীর সংখ্যা এতোই বেড়েছে যে রাজধানী ঢাকার কোনো বিল্ডিয়ের ওপর থেকে ইট নীচে পড়লে দেখা যাবে হয় কণ্ঠশিল্পী নয়কো কোনো কবি-লেখকের মাথায় পড়েছে। কণ্ঠ, মেধা, চিন্তা-চেতনা, গানের প্রতি মমত্ববোধ নেই অথচ ‘শিল্পী হবো’ মানসিকতায় ক্যাসেট বের করে এবং টাকা খরচ করে বেসরকারি টিভির লাইভ অনুষ্ঠানে চাঞ্জ নিয়ে গান গাওয়ার নামে কান ফাঁটানো আত্মচিৎকারে শিল্পী হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। দর্শকরা বিরক্ত অথচ জোর করে দাবী করা হচ্ছে গান ভাল হচ্ছে। শিল্পী হওয়ার এই হুজুগ দেশে হয়তো আরো কিছুদিন চলবে। কিন্তু কতজনের গান বেঁচে থাকবে বা কতজনের গান মানুষ মরে রাখবে? যারা গান করছেন তাদের কতজনের গান মানুষ শোনেন? যে গানে তাল সুর লয়ের ঠিক নেই; যে গানে মা মাটি মানুষের গন্ধ নেই; সে গান কি শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করে?
বড় বড় ড্রাম বাঁজিয়ে আর ধোঁয়া উড়িয়ে ব্যাÐ সংগীতের হৈহুল্লোড়ের মধ্যেই যে কজন সংগীত শিল্পীর মা মাটি মানুষের গান নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছে বারী সিদ্দিকী তাদের অন্যতম। বারী সিদ্দিকী মূলত গ্রামীণ লোকসংগীত ও আধ্যাত্মিক ধারার গান করে থাকেন। তিনি পশ্চিমাদের তথাকথিত ব্যাÐ সংগীতের শ্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেয়া বারী সিদ্দিকী বংশী বাদক হিসেবেও হয়েছেন প্রসিদ্ধ। গ্রামীন মানুষের জীবন নিয়ে রচিত তার গাওয়া গানগুলো মানুষের হৃদয়ে সত্যিই নাড়া দিয়েছে। গান গেয়ে আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীম যেমন বাংলা ভাষাভাষি মানুষের হৃদয়ে যায়গা করে নিয়েছেন; বরেণ্য ওই শিল্পীদের গান রেডিও টিভিতে বাজানো হলে মানুষ এখনো কান পেতে শোনেন; বারী সিদ্দিকীর গানও তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়িয়ে উঠা শিল্পীরা যখন ঝাকানাকা গান নিয়ে ব্যস্ত; কেউ কেউ ব্যাÐ সংগীতের নামে পশ্চিমা সংগীতের সুর-তাল লয়কে নকল করতে ব্যস্ত; তখন মাটির গান গেয়েছেন ভাটি অঞ্চলে জন্ম নেয়া বারী সিদ্দিকী। বাউল, ফকির, বৈষ্ণব, বৈরাগীদের কীর্তন, পালাগান, শ্যামাসংগীত, লালন, রাধারমণ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের মতো সাধক বাউলদের গান গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। লোক সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান কবিগান, গাজীর গান, ভাটিয়ালি গেয়ে দেশের লোকসংগীকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আধুনিক সময়ে লোকজ গানের বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে দেশের সংগীতাঙ্গনে আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীম, আবদুর রহমান বয়াতী, আবদুল করিম, মোস্তফা জামান আব্বাসী, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, নীনা হামিদ, ফরিদা পারভীন, আবদুল কুদ্দুস বয়াতী, কাঙালিনী সুফিয়া যেমন স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট তৈরি করেছেন; বারী সিদ্দিকীও তেমনি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করেছেন। খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বংশীবাদক বারী সিদ্দিকীকে গ্রামীণ লোকসংগীত ও আধ্যাত্মিক ধারার গানের জন্যই মানুষ মরে রাখবে বহুদিন। পৃথিবীর নির্মম নিয়মে বারী সিদ্দিকীকে ‘আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’ মতো হাজার ডাকলেও শুনবেন না ঠিকই; কিন্তু তিনি রয়ে যাবেন দেশের মানুষের হৃদয়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।