ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে উড্রো উইলসন বলেছেন, কোনো নির্দিষ্ট ভূ-খ-ের মধ্যে আইনের মাধ্যমে সংগঠিত জনসমূহকে রাষ্ট্র বলে। ব্যক্তির যেমন স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই, তেমনি তা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রয়োজ্য। রাষ্ট্রও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রও আছে। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতেই রাষ্ট্রের সবকিছু আবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলোÑ ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা। কাউকে অধিকার বঞ্চিত করা বা অনুরাগ-বিরাগ বা আবেগতাড়িত হয়ে কারো অধিকার বিনষ্ট করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। সরকার এর ব্যতিক্রম করলে তাকে আর যাইহোক আদর্শ সরকার বলার কোনো সুযোগ থাকে না। নাগরিকরা যদি রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতেই পারে।
সুশাসনের জন্য দেশে সাংবিধানিক শাসনের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেলিনেকের মতে, সংবিধান রাষ্ট্রের বিভাগসমূহ নির্ধারণ করে, তাদের গঠন প্রণালী এবং পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করে, কার্যের সীমারেখা চিহ্নিত করে এবং সর্বশেষে রাষ্ট্রর সঙ্গে ওইসব বিভাগ ও শাখসমূহের কি সম্বন্ধ হবে তাও স্থির করে।
‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার’ বলে আমাদের সমাজে একটা কথা বহুল প্রচলিত আছে। সমাজের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মানুষ এই কথাটা কৌতুক ও চটুল হাস্যরস পরিবেশনের জন্য বলে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলায় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ১/১১’র জরুরি সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করে। কিন্তু দেশের মানুষ বিচার বিভাগের সে স্বাধীনতার সুবিধা খুব কমই পাচ্ছে বলে মনে করে। মূলত ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে তাদের ধারণা।
কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হলেও বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে যথেচ্ছ মন্তব্য করছেন, তাতে মনে হতে পারে, সরকার বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবাহী হিসেবেই দেখতে চাচ্ছে। কোনো বিষয়ে আদালতের রায় সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই সরকারের মন্ত্রীরা বিচারক ও বিচারালয় নিয়ে বেফাঁস ও লাগামহীন মন্তব্য করেন। ফলে আদালত থেকে সে বিষয়ে যে রায়ই হোক না কেন তা সরকার প্রভাবিত বলে জনগণ মনে করে।
একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা কখনো কাক্সিক্ষত নয়। রাষ্ট্রের পরিধি ও আওতা সম্পর্কে অধ্যাপক উইলোবি বলেন, রাষ্ট্রের আয়ত্তে প্রচুর ক্ষমতা থাকা উচিত, যার দ্বারা রাষ্ট্র বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। জাতীয় জীবনকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে পারে এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধান করতে পারে। অতীতে এ ধরনের অশুভ প্রবণতা সীমিত পরিসরে হলেও এখন তা বেড়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন, মানুষ ইতর হয়ে জন্মগ্রহণ করে। মানুষের কোনো সহজাত সততা নেই। মানুষ দুর্বলতা, নির্বুদ্ধিতা এবং কপটতার এক সংমিশ্রণ। ফলে প্রকৃতিগতভাবে সে হয় কোনো সুচতুর ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত হবে, না হয় কোনো ক্ষমতাদর্পী শাসকের কবলিত হবে। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে তার উপলব্ধি হচ্ছে, মানুষ অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল, প্রতারক, কাপুরুষ ও লোভাতুর হিসেবে। মানুষ শুধু ভয়ভীতির প্রবণতা, ক্ষমতার মোহ ও আত্মস্বার্থের টানে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। বাধ্য না হলে তারা কোনো ভালো কাজ করতে উদ্যত হয় না।
মেকিয়াভেলির এই দর্শন ষোড়শ শতাব্দীতে বেশ সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তার বাস্তব প্রয়োগ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে সংশিষ্ট সবাইকেই এসব ষড়রিপুর তাড়না থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।