Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিক্ষাব্যবস্থার বিপর্যয় রুখতেই হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিভিন্ন ধর্মের প্রর্বতক ও নবী-রাসূলরাই হচ্ছেন মানবজাতির প্রথম শিক্ষক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই হচ্ছে মানব জাতির আদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বার্তাবাহক ফেরেশতা হযরত জিবরাইল(আ.) এর মাধ্যমে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ(সা.)এর কাছে যে ওহি আসত তাই শিক্ষার আদি ও অনন্ত উৎস। অর্থাৎ রাসূল মুহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষক সরাসরি আল্লাহ সুবহানাহু তা আলা স্বয়ং। কোরআন- হাদীস, বেদ-বাইবেল, ত্রিপিটক’র আলোকে পীর দরবেশ, ওলি আওলিয়া ও আধ্যাত্ম্যিক সাধকদের মাধ্যমেও বিশ্বের বহু স্থানের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে। গ্রীস. রোমে দার্শনিক সক্রেটিস, অ্যারিস্ট্যাটল, প্লেটোর মত প্রাচীন দার্শনিকরাও গড়ে তুলেছিলেন নিজ নিজ শিক্ষাবলয়। কালের পরিক্রমায় আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা আজকের পর্যায়ে আসীন হওয়ার আগে আমাদের সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনানুষ্ঠানিক যা গুরুকেন্দ্রিক শিক্ষা নামেও পরিচিত হতে পারে। মূলত: ধর্মীয় ও লৌকিক সংস্কৃতিকে ধারণ করেই সে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হত। অত:পর ফারসী ও আরবী মাদরাসা ও সংস্কৃত টোলের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের হাতে গড়ে ওঠা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে উনবিংশ শতকের শুরুতে বৃটিশরা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রথম যে শিক্ষাকমিশন গঠন করেছিল সে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে ভারতে শত শত বছর ধরে চলে আসা মাদরাসা ও টোলের শিক্ষার ভিত্তিকে অক্ষুন্ন রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে পরবর্তিতে তারা যে শিক্ষাব্যবস্থা এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তা’ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও বস্তুবাদি শিক্ষাব্যবস্থা। আধুনিক আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাবোর্ড, গ্রন্থাদি, কারিকুলামসহ প্রযুক্তিগত সাজ সরঞ্জামের পাশাপাশি সবচে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হচ্ছেন একজন সুযোগ্য শিক্ষক। শিক্ষায় যদি নৈতিক মানদন্ড ও শিক্ষকের অবস্থান অক্ষুন্ন থাকে, সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে গুরু-শিষ্যের একটি পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন তখনো ঘুচানো যাবেনা। পিতা সন্তানের জন্ম দেন আর শিক্ষক সেই সন্তানকে সত্যিকার মানুৃষরূপে গড়ে তোলতে সবার্ত্মক ত্যাগের স্বাক্ষর রাখেন, এটাই হচ্ছে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ঐতিহ্যগত প্রাচীন লৌকিক ধারনা। কবি কাদের নওয়াজ শিক্ষকের মর্যাদার বর্ননা দিতে গিয়ে দিল্লীর বাদশা আলমগীরের পুত্রকে দিয়ে তার শিক্ষকের অজুর সময় পায়ে পানি ঢালা এবং প্রতিক্রিয়ায় ওস্তাদের প্রতি বাদশার প্রশ্ন ছিল শাহজাদা কেন তার শিক্ষকের পায়ের ধুলি নিজ হাতে পানি দিয়ে ধুয়ে দিলনা। পিতা-প্রপিতামহের যুগ পেরিয়ে আমাদের স্কুল জীবনেও শিক্ষকের সেই মর্যাদার ধারবাহিক উত্তরাধিকারের কিছুটা অবশিষ্ট্য ছিল। শিক্ষকের ত্যাগ ও আত্মমর্যাদার সেই ধারা অতি ক্ষীণভাবে হলেও প্রবাহিত আছে বলেই ঔপনিবেশোত্তর ভগ্ন ও বস্তুবাদি শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমক্ষয়িষ্ণুতার মধ্যে অবক্ষয়ের শিকার হাজার হাজার মধ্যে সমাজে এখনো দু’চারজন ত্যাগী ও আদর্শ শিক্ষক ও মানবহীতৈষীর দেখা পাওয়া যায়। যাদের দেখে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের শিকার অন্য শিক্ষক ও পেশাজীবীদের বৈসাদৃশ্য তুলনা করা যায়। 

্আজকের সমাজ বাস্তবতা থেকে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চরম সীমায় পৌছে গেছি আমরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশকে চিরস্থায়ীভাবে পঙ্গু পরনির্ভরশীল করে রাখতে আমাদের আগামী প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা এবং অর্থব্যবস্থা ব্যর্থ বা অচল হয়ে গেলে কোন রাষ্ট্র তার স্বাধীন সত্ত¡া নিয়ে ঠিকে থাকতে পারেনা। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ও পর্যায়ে যে ব্যর্থতা ও অচলাবস্থা চলছে। সরকারী বেসরকারী বিনিয়োগ পরিস্থিতি, ব্যাংকিং সেক্টরে ধস ও দেউলিয়াত্ব, অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতা, অস্বচ্ছতা ও লুটপাটের যে মচ্ছব চলছে তাতে দেশের নিকট ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদি হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। দেশের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক ভ’-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক বানিজ্য, বিনিয়োগ ও ক’টনৈতিক সম্পর্কের প্রতিটি ধাপে বাংলাদেশ এখন তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে থাকলেও সরকার কিন্তু অনবরত উন্নয়নের সবক জারি রেখেছে। শিশুদের জন্য নতুন নতুন পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এসব পাবলিক পরীক্ষাকে ঘিরে কোচিং ও সার্টিফিকেট বাণিজ্য বাড়িয়ে তোলা হেেয়ছে। হাজার হাজার বিদ্যালয়ে প্রয়্জোনীয় শিক্ষক না থাকলেও সে সব পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারি শিশুদের গণহারে পাস করিয়ে দেয়ার সরকারী নির্দেশনা জারি করে এবং উচ্চ গ্রেড বাড়িয়ে দিয়ে তাকে শিক্ষার উন্নয়ন হিসেবে জাহির করার অপরিনামদর্শি তৎপরতাও আমরা দেখেছি। একদিকে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ও গুনগত মানোন্নয়নে নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনসহ নানাবিধ উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান নানামাত্রিক বৈষম্য এবং শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক প্রতিযোগিতাই আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, নতুন শিক্ষানীতির আওতায় এসব বৈষম্য ও প্রতিযোগিতা দূর করার একটি নীতিগত অবস্থান দেখা গেলেও বাস্তব অবস্থার পরিবর্তনে উপযুক্ত কর্মপন্থা তো দেখা যাচ্ছেই না, উপরন্তু পাশের হার বৃদ্ধি ও যেনতেন প্রকারে জিপিএ-ফাইভ, গোল্ডেন জিপিএ বৃদ্ধির জন্য তথাকথিত নামীদামী বিদ্যালয় এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের সমান্তরালভাবে একই প্রকার ভ’মিকায় দেখা যাচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে শিক্ষকদের বেতন কয়েকগুন বেড়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতনস্কেলের শতভাগ সরকার থেকেই পাচ্ছে। এ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, সহশিক্ষাক্রমিক অনুষ্ঠানাদি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য অনুসারে প্রতিষ্ঠানের আয় থেকেও একটি অংশ শিক্ষকদের দেয়া হয় বিধায় এমপিওভুক্ত বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেয়া হয়। তবে দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় যত বেশী, উন্নয়ন যত বেশী হয়েছে সে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বেশী। সেই সাথে একজন শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে ভর্তি থেকেই শুরু হয় তার অনৈতিক পথচলা। গৌণ কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে নামিদামি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাসে শিক্ষাদানে তেমন আগ্রহী নন। কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনিতেই তাদের আগ্রহ ও ব্যস্ততা বেশী। কেউ কেউ শুধুমাত্র শিক্ষক হিসেবে নিজের পরিচয় টিকিয়ে রাখতেই বিদ্যালয়ের শ্রেনী কার্যক্রমে জড়িত রাখেন। তা’ না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তার কাছে পড়তে যেতনা। পরীক্ষায় পাস ফেল নম্বরের এখতিয়ার শিক্ষকের হাতে থাকায় একশ্রেনীর শিক্ষক শিক্ষার্থী ও তার পরিববারকে কার্যত জিম্মি করে রাখে। কখনো কখনো শিক্ষকের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়ে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে বড় ধরনের ছন্দপতনও ঘটতে দেখা যায়।
শিক্ষকদের ব্যক্তিগত লাভালাভের গন্ডি পেরিয়ে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য। যেনতেন প্রকারে পাসের হার বাড়িয়ে, জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির হার বাড়িয়ে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তকমা পাওয়ার অনৈতিক প্রতিযোগিতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সবচে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও সৃজনশীল বিকাশের প্রয়োজনীয়তা অগ্রাহ্য করে সারা বছর তাদেরকে শ্রেনীকক্ষে, কোচিংয়ে, হোমওয়ার্কে আটকে রাখার পরও তারা শতভাগ পাস নিশ্চিত করতে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নম্বরপত্র মূল্যায়নে অসদোপায় অবলম্বনের পথ খুঁজতে থাকে। নম্বর বেশী দিয়ে পাস করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে নিকট অতীতে সরকারীভাবেও অঘোষিত নির্দেশনার কথা শোনা গেছে। পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বেশী দেখানোটাও যেন জনতুষ্টিমূলক রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই কোমলমতি শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনৈতিক কর্মকান্ডের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনি বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যের পরও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আরেকটি ঘৃন্য বাণিজ্যে লিপ্ত থাকে একশ্রেনীর শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। বিশেষত: মেধাবৃত্তি নিয়ে একশ্রেনীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘুষবাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। ধনী অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের খুশি রেখে ফায়দা হাসিলের জন্য তাদের ছেলে মেয়েদের বৃত্তি দেয়ার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার করার মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত সাধারণ পরিবারের প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করার কিছু অভিযোগ ইতিমধ্যেই প্রমানীত হয়েছে। আর্থিক ও সহায়তা ও অনুপ্রেরনা হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাসমাপনী পরীক্ষার যে মেধাবৃত্তিটি পেলে একটি দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হতে পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ্রেনীর নীতিহীন ও মুনাফালোভি প্রধানরা ঘুষ ও অনৈতিক সুবিধাবাজির কাছে সে বৃত্তিটি বিক্রি করে দিচ্ছে। সচেতন অভিভাবকদের অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের কিছু ঘটনার তদন্তে সত্য উদঘাটিত হওয়ার পর তা পত্র পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্টরা ধরাছোয়ার বাইরেই থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে অভিযোগ প্রমানীত হওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে কিছু লঘু ব্যবস্থা ছাড়া তেমন কোন শাস্তির দৃষ্টান্ত না থাকায় মেধাবৃত্তি নিয়ে কারসাজি ও জালিয়াতি অব্যাহত আছে। নম্বর বাড়িয়ে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাসের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতার পাশাপাশি চলছে মেধাবৃত্তি নিয়ে কারসাজি। প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়, ২০১৫ সালে রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলার ৬২টি প্রাথমিক শিক্ষাবৃত্তির মধ্যে জনের ক্ষেত্রেই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এসব বৃত্তির সিংহভাগই পেয়েছে বেসরকারী তথাকথিত নামিদামি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরা। অনৈতিক প্রতিযোগিতা, কারসাজি ও ঘুষবাণিজ্য না থাকলেও হয়তো এদের মধ্যে কেউ কেউ জিপিএ-৫ ও মেধাবৃত্তি লাভ করতো। অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কারণে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা যথার্থ মূল্যায়ণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একইভাবে নিয়োগবাণিজ্য, রাজনৈতিক পক্ষপাত, অযৌক্তিক কোটাপ্রথার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ গ্রেড ও ডিগ্রী নিয়ে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চাকুরী থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবীদের বঞ্চিত করার এই ধারাবাহিক প্রবণতার দ্বারা আমাদের সমাজ আজ হতাশা, অবক্ষয় ও দুর্নীতির দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই দুষ্টচক্র থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থাকে বের করে আনতে না পারলে জাতির মুক্তি নেই।
আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক (অষ্টম শেনী পর্যন্ত) শিক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে। আর আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, বছরের শেষদিকে এসে নতুন শিক্ষাবর্ষকে সামনে রেখে নাগরিক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর উপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়। বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ, বার্ষিক পরীক্ষা ও পাবলিক পরীক্ষার খরচ, মেধাবৃত্তি ও নতুন ক্লাসে ভর্তি সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ও খরচাদির চাপের পেছনে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনৈতিক প্রতিযোগিতা, গোপণ আঁতাত ও কারসাজি। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান দুর্নীতি, বৈষম্য, অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য বন্ধ করার কোন উদ্যোগ না থাকায় শিক্ষার মানোন্নয়নে কোন উদ্যোগই কাজে আসছেনা। প্রি প্রাইমারীতে ভর্তির সময় থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্লাসে, প্রতিটি স্তরে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনৈতিক কারসাজি, মুনাফাবাজি ও চক্রান্তের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মানবিক গুনাবলী হারিয়ে নৈতিক মূল্যবোধশুন্য নির্মম হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষাঙ্গণ এবং ছাত্র রাজনীতির অতীত ইতিহাস কিন্তু ভিন্নতর। ক্লাসের সবচে মেধাবী, সম্ভাবনাময় এবং সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বোধ সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা এক সময় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে দেশভাগের সময় একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তার শ্রম ও ত্যাগের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। সেই নেতার আদর্শের অনুসারী বলে দাবীদার ছাত্রলীগের একশ্রেনীর নেতাকর্মীর বর্তমান অবস্থা দেখে দেশের মানুষ এখন উদ্বিঘœ, উৎকণ্ঠিত। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনের সময় পর্যন্ত দেশের ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের তৎপরতা ও জীবনযাত্রায় যতটুকু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অবশিষ্ট ছিল গত তিন দশকে তা পুরোটাই নি:শেষ হয়ে গেছে। যেখানে লাখ লাখ যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও ন্যুনতম বেতনের একটি চাকরীর সন্ধানে হণ্যে হয়ে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে ছাত্রলীগ নেতাদের অনেককে বিলাসবহুল গাড়ী কিনে বেহেসাবি জীবন করতে দেখা যায়। কয়েক বছর আগে ফরিদপুরের এক ছাত্রলীগ নেতার রাজকীয় বিয়ের খবর ছাপা হয়েছিল। যেখানে তিনি ১৫ হাজার লোকের আপ্যায়ণের ব্যবস্থা, রাস্তায় রাস্তায় তোরণ, কণেকে অর্ধকোটি টাকার সোনার গহনা দিয়ে একাধিক হেলিকপ্টারে চরে বরযাত্রা করেছিলেন। সেই ছাত্রলীগ নেতার কোটি কোটি টাকা আয়ের উৎস সম্পর্কে দুর্নীতি দমন বিভাগ বা রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ জানতে চেয়েছিল কিনা তা আমাদের জানা নেই। সম্প্রতি শরিয়তপুরের এক ছাত্রলীগ নেতার লাম্পট্যের কারনে অন্তত ৬ নারীর পারিবারিক সামাজিক জীবন তছনছ হয়ে গেছে। গত সোমবার প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায় দেশের দক্ষিনের জেলা বরগুনার পাথরঘাটায় এক তরুনীকে ধর্ষনের পর হত্যার অভিযোগে ৪ ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। ইতিপূর্বে সিলেটে প্রকাশ্য ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের খাদিজা হত্যাচেষ্টার ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন তুলেছিল। ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-বিশৃঙ্খলায় বিরক্ত হয়ে এক সময় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু অপরাধিদের লাগাম টেনে ধরা এবং বিচারের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই ছাত্রলীগের একশ্রেনীর সদস্যের অপরাধপ্রবণতা আরো বেড়েছে। শুধু ছাত্রলীগ নামধারিরাই নয়, সারাদেশে যুব সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা এবং দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী। ঘুষের বিনিময়ে ভর্তি হওয়া, পিতার ঘুষের টাকায় নামিদামি বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত সন্তানরা ভবিষ্যতে কি ধরনের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা হবেন সেটা সহজেই অনুমেয়। তবে এখন আর সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছেনা। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সিনিয়র জুনিয়র বিরোধ পাকিয়ে শিক্ষার্থী নিহতের একাধিক নজির সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার বাইরেও এর ব্যতিক্রম নেই। কুমিল্লার হোমনায় দশম শ্রেনীর তিনছাত্র মিলে নবম শ্রেনীর আরেক ছাত্রকে অপহরণ করে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে। মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে তাদেরকে ধরার পর নবমশ্রেনীর ছাত্রটিকে হত্যা করে স্কুলের সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়ার ঘটনা উৎঘাটিত হয়। পত্রিকা খুললে প্রায় প্রতিদিনই এমন অনেক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়। কিশোর-যুবকদের এমন বিপথগামিতা ও মানবিক অবক্ষয় দেশে একটি তীব্রমাত্রার সামাজিক অবক্ষয়ের জন্ম দিয়েছে। এই অবক্ষয়, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করে জাতিকে প্রত্যাশিত সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে হলে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থার অনিয়ম-দুর্নীতি, বৈষম্য, অস্বচ্ছতা ও বাণিজ্যিক প্রবণতা রোধ করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ