ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আজকাল হাটে-ঘাটে, বাজারে, অফিসে, ছেলে-মেয়ের স্কুলের সামনে জটলায়, পার্টিতে সব জায়গাতেই এই কথাগুলোই বলছেন একজন অন্যজনকে ‘দূর ছাই! ডায়াবেটিক আমার জীনবটাকে একেবারে তছনছ করে দিল’। বুফে পার্টিতে থলথলে মোটা বয়কাট কেশী সুতনুকা ম্যাডাম হয়তো ডিশ হাতে নিয়ে ক্যাটারার সাদাসিধে ছেলেটাকে বুঝাতে উঠে পড়ে লেগে যান যে, তাঁর ডায়াবেটিস, ডাক্তারের বারণ তাই পনির-পাকোড়াটা তিনি খাবেন না। বলি, এতদিনে কেন হুঁশ হল? আগে থেকেই কেন আপনি পরিমিত খেলেন না। এখন চার্ব-ভূঁড়ি ইয়া বড়ো একটা বানিয়ে বলছেন খাবেন না! নইলে এক বছর ধরে আপনি ডায়েটিং করছেন-সবাইকে জাহির করে বলছেন, অথচ ওজন মাপার যন্ত্রটা আপনার মুখ রক্ষা করছে না। শত্রুতা আছে কিনা তা দেখার যন্ত্রটার সাথে আপনার কী পরিচয় নেই।
পৃথিবী জুড়েই বাড়ছে ডায়াবেটিস। যে ধরনের ডায়াবেটিস বেশি হচ্ছে এদের বলা হয় টাইপ ২ ডায়াবেটিস। এ ধরনের ডায়াবেটিসকে বলা হয় বয়স্কদের ডায়াবেটিস, যদিও আজকাল শিশু ও তরুণদেরও ডায়াবেটিস হচ্ছে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস। জীবনাচরণে পরিবর্তন হওয়া শিশু ও তরুণরা ফাস্টফুড খাচ্ছে, খাচ্ছে কোমল পানীয়। শরীরচর্চা করছে না তেমন, স্থুল হচ্ছে এরা। আর তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিস হলে শরীরে যেমন ইনসুলিন কম তৈরি হতে পারে অথবা যে ইনসুলিন তৈরি হলে সে ইনসুলিন দেহকোষ কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। রক্তের গ্লকোজকে কোষের ভেতর প্রবেশ করানোর জন্য প্রয়োজন হয় ইনসুলিনের। গ্লকোজ দেহকোষে ঢোকার পর এর দহন শুরু হয়। ইনসুলিন যদি কাজ না করতে পারে গ্লকোজও যদি রক্তে জমা হতে থাকে এবং এ অবস্থ চলতে থাকে তাহলে কালক্রমে অনেক জটিলতা হয় যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকল হওয়া, স্নায়ুর ক্ষতি এবং অন্ধত্বের মতো সমস্যা। দেখা যাচ্ছে অনেকেরই টাইপ ২ ডায়াবেটিস রয়েছে অথচ তারা অনেকেই তা জানেন না। ডায়াবেটিস আছে অথচ চিহ্নিত হয়নি এমন লোকের সংখ্যা কম হবে না। সূচনা পর্যায়েই কোনো লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই টাইপ ২ ডায়াবেটিস শরীরে বড়ো ক্ষতি অজান্তে করে ফেলতে পারে। এজন্যই হয়তো ৬০ লাখ আমেরিকান, যাদের তিনজন পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে একজনেরই টাইপ ২, তারা জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সূচনায় উপসর্গ থাকে না এবং উপসর্গ দেখা দিলেও মনে হয় নিরীহ এবং অস্পষ্ট অন্যান্য সমস্যার অনুকৃতি বলে ভ্রম হতে পারে। উপসর্গ দেখা দিলে যা যা হতে পারে- প্রবল পিপাসা, খুব ক্ষুধা, ওজন হ্রাস, অবসন্ন বোধ, ঝাপসা দৃষ্টি, বার বার প্রস্রাব, হাতে ও পায়ে ঝিন ঝিন, যৌন সমস্যা, ক্ষত যা শুকায় না। ডায়াবেটিসের সহজ পরীক্ষা হল রক্তের সুগার নিরূপণ। আঙ্গুলের ডগা থেকে সামান্য রক্তের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা। কখনও খালিপেটে রক্তে গ্লকোজ মাপা এবং প্রয়োজনে গ্লকোজ দ্রবণ পান করিয়ে দু’ঘন্টা পর আবার রক্তের নমুনা নিয়ে গ্লকোজ নিরূপণ। ফলাফল তিন রকম হতে পারে। স্বাভাবিক রক্ত সুগার মান। মধ্যবর্তী অবস্থা বা প্রি-ডায়াবেটিস। এক্ষেত্রে রক্তের সুগার মান স্বাভাবিকের বেশি থাকলেও ডায়াবেটিস হওয়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছায় না এবং ডায়াবেটিস হলে ডাক্তার খাদ্যবিধি পরিবর্তন করতে বলতে পারেন, শরীরচর্চা করার উপদেশ দেবেন এবং ওজন বেশি হলে হ্রাস করার পরামর্শও দেবেন।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন ডায়াবেটিসের জন্য কতবার টেস্ট করানো উচিত। কোনো উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
হ্যাঁ ডাক্তারের পরামর্শে হয়তো আপনার জীবনশৈলী কিছুটা পাল্টাতে হয়েছে। ডায়াবেটিস রোগটা আসলে কী? যখন শরীর যথাযথ ভাবে সুগার বা গ্লকোজ বা শর্করা ব্যবহার করতে পারে না, তখন রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। দেহের কোষগুলোতে সুগারের সহজভাবে প্রবেশের জন্য ইনস্যুলিন নামে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এই পদার্থটি আমাদের পেটের পাকস্থলির বাম দিকে প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয় নামে অঙ্গটি সৃষ্টি করে রক্তে সেটা চালান করে। যখন অগ্নাশয় এবেবারেই ইনস্যুলিন তৈরী যথাযথভাবে করে না (ইনস্যুলিন রেসিস্ট্যান্স) তখন রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়, অথচ কোষগুলো সুগার বঞ্চিত থাকে এবং একটা লিমিটের পর উল্টোপাল্টা রাসায়নিক ক্রিয়া শুরু করে। এই সব কিছুর সমষ্টিকেই ডায়াবেটিস বলে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আগে নিয়ম-নীতি মেনে চললে এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকলে ডায়াবেটিস থেকে রেহাই পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস হয়ে গেলেও খাওয়া-দাওয়া এবং চলাফেরার ব্যাপারে সব নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়লে দিনে একবার করে সবুজ শাকসবজি খান। টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়া আটকায়। যেদিন শাকসবজি খাচ্ছেন না তিন দফায় নানা রঙা ফল মিশিয়ে খান। কপির ডাঁটাপাতা,ডাঁটাশাক, লাউ-কুমড়ো, বেতো, শালগম শাক, মুলোর শাক, সরষে, ছোলা, লেটুস, পার্সলে, পালংশাক, ঢেঁকি শাক, এরকম শাকসবজি খান। প্রতিদিন কোনো না কোনোটি খাওয়াই যায়। টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এমন মানুষদের অভিলম্বে সবুজ শাকসবজি খেতে শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। তুলেন স্কুল অফ পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং হার্ভার্ড স্কুল অব পারলিক হেলথের গবেষক বিজ্ঞানীরা ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সালের নানা ধরনের ডায়েট তথা খাদ্যসামগ্রীর প্রভাব যাচাই করার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তুলেনের মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. লিডিয়া বাজ্জানোর বক্তব্য, ফল খাওয়ার সময় খোসাসহ আপেল খাবেন আস্ত। কলা খাবেন। কমলা খাবেন। তরমুজ-খরমুজ খাবেন। পেয়ারা খাবেন। ফ্রুট জুস খাবেন না কারণ যে, জুস সুগার চড়চড় করে বাড়িয়ে দেয়। পারলে মিল-ছাঁটা ফাইন চালের বদলে ঢেঁকিছাঁটা চাল খান। ময়দা খাওয়া ছেড়ে দিন। আলু যেটুকু খাবেন সবসময় খোসাসহ। এদিকে, কানাডা-হ্যামিলটনের ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ৫০ বছরের গবেষণা প্রতিবেদন যাচাই করে জানিয়েছেন, নিয়মিত শাকসবজি, বাদাম, মাঝে মধ্যে ফলটল মাছও। এরকম চালিয়ে যেতে পারলে হার্টের রোগ ভোগ হবে না সহজে। সাদা পাউরুটি, বিস্কুট, পাস্তা, মিলে ছাঁটা চাল, ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত ফাস্টফুড, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট এসব খাওয়া ছেড়ে দিন। অন্যদকে, আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে জানানো হয়েছে, যাঁরা মাঝেমধ্যেই বার্গার, মুরগির মাংসের চটপট বা মাংস ভাজা খেতে অভ্যস্ত, তাঁদের টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা খুব। বার্গার, ফ্রায়েড চিকেন এসব হাইক্যালোরি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে সংশ্লিষ্টদের ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ ১০ বছর বাদেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে যান।
ডায়াবেটিস চিকিৎসাটা কিন্তু আপনার হাতে। ডাক্তার শুধু আপনাকে ভালোমন্দ খুলে বুঝিয়ে আপনাকে সঠিক রাস্তার সন্ধান দেন। এই রোগের চিকিৎসাটা ধরুন একটি টেবিল, যার চারটি পা আছে। এই চিকিৎসা টেবিলটা যে চারটি পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে এর একটিও যদি নড়েবড়ে হয় তাহলে টেবিলটা কিন্তু সঠিকভাবে থাকতে পারবে না।
প্রথম পা: নিয়মিত রক্তপরীক্ষা করে সঠিক মাত্রায় সঠিক ঔষধ খাওয়া। অপ্রয়োজনীয় ঔষধ বা প্রয়োজনের চেয়ে কম ঔষধ খাওয়া দুটিই ক্ষতিকর। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে বাড়তি কিছু টেস্ট করা উচিত যা দিয়ে আপনার ডায়াবেটিসের বিভিন্ন জটিলতা নিরূপণ করা যায়। এর মধ্যে কিডনি, হার্ট, চোখ, পা-এগুলোর পরীক্ষা করা হয়। একটি জরুরি কথা, যে কোনো ডায়াবেটিস রোগীর নিজের পা দুটোই মুখের মতো যত্ম করা উচিত।
দ্বিতীয় পা: সঠিক পরিমাণে সঠিক খাদ্য। আপনার উচ্চতা, ওজন, দৈহিক শারীরিক পরিশ্রমের কথা মাথায় রেখে আপনার দৈহিক প্রয়োজনীয় ক্যালোরি হিসাব করে আপনার খাদ্য তালিকা তৈরী করতে হবে। আপনার পছন্দের কোনো খাদ্য খেতে হলে তার সম ক্যালোরি মূল্যের অন্য খাদ্য আপনার দৈহিক খাদ্য থেকে বাদ দিতে হবে, লক্ষ রাখতে হবে সেদিনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরি যেন শরীরে বেশি না ঢুকে। ব্যাপারটা একটু কঠিন মনে হচ্ছে, তাই না? অভ্যাস করুন-সহজ হয়ে যাবে। তৃতীয় পা: সঠিক ব্যায়াম, আপনার শারীরিক অবস্থা হাত-পা জয়েন্টের কথা মাথায় রেখে আপনাকে ব্যায়াম করতে হবে। তাতে হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার, সাইক্লিং, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা অন্য ব্যায়াম যেটা আপনার জন্য সঠিক হবে তা নিরূপণ করতে হবে। সাধারণ ভাবে প্রতিদিন কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিট ঘাম ঝরানো ব্যায়াম করা উচিত। মনে রাখবেন আপনি যত ব্যায়াম করবেন, আপনার রক্তে সুগারের পরিমাণ কমবে।
চতুর্থ পা: সুশৃঙ্খল জীবন শৈলী। মনে রাখবেন আপনার ডায়াবেটিস রোগটির জন্য অনেকাংশ দায়ী আপনার অলস বা সেডেন্টারি লাইফস্টাইল। চেষ্টা করতে হবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমস্ত কিছু একটা রুটিনের মধ্যে ফেলা। যখন তখন না খেয়ে রুটিন মোতাবেক খাওয়া-দাওয়া, হাটা ও ঘুমানো উচিত। এছাড়া মদ্যপান, ধুমপান, অলস জীবনযাপন এগুলো আস্তে আস্তে পরিহার করা উচিত ।
লেখক: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।