হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
ইচ্ছা ছিল আসন্ন ছয় সিটি নির্বাচন নিয়ে লিখব এবার। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল মোতাবেক এ বছরের ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি নির্বাচন। ইসি এরপর পর্যায়ক্রমে আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে ভোট দিতে পারে। এতে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ পাবে। সেই নিরিখে এ ছয় সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের দুই প্রধান দলের কোন্টি আগামী সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতায় যাবে তারও একটা মহড়া দেখার সুযোগ পাবে জনগণ।
সেদিক দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও একটা ধারণা করতে পারবে বহির্বিশ্ব। এ কারণে আন্তর্জাতিক মহল থেকে তাগিদ আসছে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন যেন সকল রাজনৈতিক দলের অবাধ অংশগ্রহণে ধন্য হয়- এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। এর অবশ্য বিশেষ কারণও ছিল। সংশ্লিষ্ট সকলেই জানেন, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নয়, অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি কর্তৃক বয়কটকৃত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়।
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি কর্র্তৃক নির্বাচন বর্জনের কারণ ছিল অতীতে দুই প্রধান দলের মধ্যে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যে সমঝোতা হয়েছিল সে সমঝোতা থেকে আওয়ামী লীগের সরে গিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়ায়। ৫ জানুয়ারীর সে নির্বাচন দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি অংশগ্রহণ না করাতে বাস্তবতা-বিচারে হয়ে উঠেছিল একটি নির্বাচনী প্রহসন। ভোট দানের নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ নির্বাচন কেন্দ্র ছিল জনশূন্য, ফাঁকা। সে নির্বাচনী প্রহসনে প্রধান বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতি সুবাদে সরকারী দলের অল্প সংখ্যক নেতাকর্মীরা ইচ্ছামত ব্যালটপত্রে সীল দিয়ে সরকার-দলীয় প্রার্থীদের সপক্ষে বহুগুণ ভোট প্রদানের সুযোগ পান। এভাবেই জনশূন্য ভোট কেন্দ্রে ‘বিপুল ভোটে’ জয়ী হন সরকার দলীয় প্রার্থীরা। এ তো ছিল যেসব আসনে নির্বাচন হয় তার কথা। জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যার অধিকাংশ ১৫৩ আসনে তো কোন নির্বাচনই হয়নি। সরকারী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে নির্বাচনের ইতিহাসে নয়া কলংকের রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এ কারণে জনগণ ৫ জানুয়ারীর সে নির্বাচনী প্রহসনের নাম দিয়েছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন।
ইচ্ছা ছিল পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগাম মহড়া হিসাবে যে ছয়টি সির্টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে লেখা। কিন্তু ইতোমধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি সম্পর্কে প্যারাডাইস পেপার্সে বোমা ফাটানো যেসব তথ্য ফাঁস হয়ে যায় তার কারণে পূর্ব সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। প্যারাডাইস পেপার্সের এই বোমা ফাটানো তথ্যে যেসব বিশ্ব নেতাদের কেলেংকারীর খবর ফাঁস হয়ে পড়েছে তারা কারা? তারা কোন চুনোপুটি নয়, এক ডাকে যেসব বিশ্বনেতাদের চেনা যায়, তাদের নাম উঠে এসেছে এসব কেলেংকারীতে। পানামা পেপাসের্র মাত্র দেড় বছরের মাথায় সারা দুনিয়ায় আলোড়ন তুলেছে প্যারাডাইস পেপারস।
এতে যুক্তরাজ্যের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজসহ বিশ্বের অনেক সাবেক ও বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তির গোপন সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। বারমুডার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ্যাপেলবির গ্রাহকদের ফাঁস হওয়া ১ কোটি ৩৪ লাখ নথি ঘেঁটে ইন্টারন্যাশনাল কনসটিয়াম অব ইনভেস্টিভ জার্নালিষ্টস (আইসিআইজে) গত রোববার তা প্রকাশ করেছে। পানামা পেপার্সের মত এসব নথিও প্রথমে জার্মান দৈনিক সুইডরসে সাইটিংয়ের কাছে আসে। এসব নথি পেয়েছেন বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ ৬৭টি দেশের ৩৮০ জন সাংবাদিক। আইসিআইজে এক বিবৃতিতে বলেছে, অদূর ভবিষ্যতে আরও তথ্য প্রকাশ করার কথা আছে। প্যারাডাইস পেপার্স কেলেংকারীতে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১২০ জন রাজনৈতিক নেতার নাম এসেছে। মূলত রাজনীতিবিদ এবং তাদের স্বজন ও সহযোগী ব্যবসায়ীদের নামই উঠে এসেছে এই তালিকায়। ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে ক্যানাডার সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর তহবিল সংগ্রহকারী, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী টিলারসন ও বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রস এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের জামাতার নামও এসেছে।
২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত পানামা পেপার্সে শুধু রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরাই নন বিশ্বখ্যাত ফুটবলার এবং চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামও ছিল। মোসাক উনমেকা নামে পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন তুলেছেন। এর জেরে পদত্যাগ করতে হয়েছিল পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে।
প্যারাডাই পেপার্সের ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যাচ্ছে, কমপক্ষে ৯ জন বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান কর এড়িয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ, কলাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সন্তোষ, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেতো পেরোসেনকো, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টানবুল, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট জারনেট বডসিবি কাবিলা, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মরিমিও মাকরি এবং আজার বাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও তাঁর পরিবার।
গোপন সম্পদ রাখার তালিকায় বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের পাশাপাশি রয়েছেন সাবেকরাও। গোপন সম্পদ রাখার তালিকায় ক্যানাডার তিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা: ক্রেটিন, পল মার্টিন, ও ব্রায়ান মূলরবি, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউকেও হাতোয়ামা, এল সালভাদারের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কার্লোস কুইন্টাসিলা স্মিথ, ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আয়াদ আওয়ালি, জর্দানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলী আবু আল রাগিব, কাতারের সাবেক আমীর হাসান বিন খলিফা আল সানি ও সাবেক প্রধান মন্ত্রী হাম্মাদ বিন জমির আল সানি, ইউক্রেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পারলো আজরেখো, আইসল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিমমুডুর ডেভিড গানলাগসন এবং মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী সুমবাতরন ব্যাটারসনের নাম ও রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোন্যাল্ড ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার দুই সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেকস টিলারসন, এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ইউলবার রসের বিরুদ্ধে কর এড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে ডোন্যাল্ড ট্রাম্পকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন উইলবার রস। এজন্য তাকে পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যক্তিগত অর্থের প্রায় এক কোটি পাউন্ড অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগ হয়েছে। এসব অর্থে মেসাদ আইল্যান্ড ও বারমুডায় রাণীর নামে আলাদা তহবিল সৃষ্টি করা হয়েছে। ল্যাকোষ্টি নামের একটা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব অর্থ সেখানে গেছে। এই প্রতিষ্ঠান রাণীর ব্যক্তিগত সম্পদ ৫০ কোটি পাউন্ড দেখভাল করে তাঁকে মুনাফা তুলে দেয়। ব্রাইট হাউজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের রাণীর বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে।
ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কর ফাঁকির বিরুদ্ধে এবং আর্থিক স্বচ্ছতা পক্ষে বরাবরই বলে এসেছেন। কিন্তু নির্বাচনে তাঁর সবচেয়ে বড় তহবিল সংগ্রহকারী স্টেফন ব্রফমসনের বিরুদ্ধে কর এড়ানোর অভিযোগ এসেছে। মাত্র দুই ঘণ্টায় ট্রুডোকে আড়াই লাখ ডলার তহবিল তুলে দিয়েছিলেন ব্রফম্যান। গোপন নথিতে দেখা যাচ্ছে ব্রফম্যান ও তাঁর প্রতিষ্ঠান কেম্যান আইল্যান্ডে প্রায় ছয় কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। ট্রুডোর জন্য এটা বড় ধাক্কা।
উপসংহারে বলতে চাই, এই নিবন্ধে প্রধানত পশ্চিম দেশগুলোর বড় বড় নেতা ও ক্ষমতাধরদের ব্যক্তিগত সম্পদের কেলেংকারী সম্পর্কে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের তথ্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বড় নেতাদের মধ্যেও পাওয়া যায়। বিশ্বের গোটা অর্থব্যবস্থাই যেখানে পুঁজিবাদী বৈষম্য ও শোষণভিত্তিক, সেখানে এটাই স্বাভাবিক। সব অঞ্চলের কিছু কিছু নেতা বৈষম্য ও শোষনের পরিবর্তে গণমানুষের কল্যাণের কথা বললেও সারা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শোষণমূলক অর্থব্যবস্থা প্রচলিত থাকাতে তাদের সেসব প্রচেষ্টা বাস্তবে ফলপ্রসূ হতে পারছে না।
পরিস্থিতির বাস্তবতাভিত্তিক পরিবর্তন আনতে চাইলে প্রথমেই শোষণহীন এবং সাম্যভ্রাতৃত্বের আদর্শে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ শুরু করে দিতে হবে। বাস্তবক্ষেত্রে বৃহত্তর ও মহত্তর সামাজিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু দেয়ার কোন বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। অপূর্ণ ও বৈষম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ না করে মহৎ লক্ষ্য অর্জনের আশা করা বাতুলতা মাত্র।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।