Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রয়োজন সচেতনতা

মো.ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশে মৃদু ভূকম্পন অনুভুত হয়েছে। সকাল ১০ টা ৫৫ মিনিটে এই ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা। রিকটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর মাত্রা পাওয়া যায় নি। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূতাত্তি¡ক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, যেকোনো সময় এই এলাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের একদল গবেষকের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এই গবেষণা প্রতিবেদন মতে, শক্তিশালী ভূমিকম্প কখন আঘাত হানবে সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না হলেও ভারত এবং মিয়ানমারের দুটি গতিশীল ভূগাঠনিক প্লেট পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে। এই প্লেটের সংযোগ স্থলে রয়েছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের সরকারগুলোকে আরও ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে আগাম প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় সচেতনতা ও প্রস্তুতিকেই সর্বোচ্চ করণীয় বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্প নিয়ে কোনো আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতিই এখন অগ্রাধিকার। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার জুড়ে অত্যন্ত নির্ভুল কয়েকশ’ জিপিএস রিসিভার স্থাপন করে গত ১০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন গবেষকরা। তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের ভূ-গাঠনিক প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক প্লেটে চাপ সৃষ্টি করে বছরে ৪৬ মিলিমিটার করে ঠেলছে, যাতে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা। যেহেতু এখানে গত ৪০০ বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে, ফলে যেকোনো মুহূর্তে এসব এলাকায় ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশে অপরিকল্পিত দুর্বল ভবন ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকরা।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গভীর পলি জমে বাংলাদেশের যে ভূখন্ড তৈরি হয়েছে, তা সেই ভূমিকম্পের প্রভাবে অনেক বেশি মাত্রায় কেঁপে উঠতে পারে। কিছু কিছু জায়গা তরলে পরিণত হয়ে গ্রাস করতে পারে ইমারত ও রাস্তাঘাট আর মানুষের বসতি।
গবেষক দলের প্রধান নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত¡বিদ মাইকেল স্টেকলার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই ধরনের ভূমিকম্প কবে ঘটতে পারে, আমরা বলতে পারছি না-এখনই, না ৫০০ বছর পরে সেই ভূমিকম্প হবে। সে পূর্বাভাস আরও গবেষণা না করে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে দেখতে পাচ্ছি, ওখানে শক্তি জমা হচ্ছে।
আমাদের দেশে নিয়মনীতি না মেনে বিভিন্ন এলাকায় নদী-খাল বা জলাশয় ভরাট করে যেসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো বেশি ভূমিকম্পঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য আগে থেকেই মাটি পরীক্ষা করে প্রকৌশলী ও স্থপতিদের দিয়ে ভবনের নকশা এবং নির্মাণকাজ করতে হবে। মিস্ত্রি ডেকে কাজ করালেই হবে না। ঠিকাদাররা যাতে যেনতেনভাবে ভবন নির্মাণ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজউক ও অন্য যেসব সংস্থা রয়েছে তাদের আরও কার্যকর হতে হবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে একটা সমন্বয়ের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। পুরনো ভবনের জন্য একটা সমন্বিত পরিকল্পনা করে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর পরামর্শে হয় ভবন রেকটোফাইট (কিছু বাড়তি নির্মাণসামগ্রী যোগ করে ভবন মজবুত করার বিশেষ ব্যবস্থা) অথবা ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হল আগেও ভূমিকম্প হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কখন কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে সেটাও আগে থেকে বলা মুশকিল। সুতরাং আমাদের বেশি আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে এবং ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেতে যা যা করণীয় তা এখনই করতে হবে।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মতে, দুর্যোগ যেকোনো সময় যেকোনো দেশেই হতে পারে। কিন্তু সেটাকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। একটি ভবন তৈরির পর সেটা সঠিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে কি না, তার জন্য একটি সনদ দিতে হবে। সেই সনদ দিয়ে ওই ভবনে বিদ্যুত্, গ্যাস ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। এই জায়গাতে আমাদের কঠোর থেকে কঠোরতম হতে হবে। কিন্তু আমরা পারছি না কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তির কারণে। এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই আমাদের মৃত্যুর কারণ হবেন। তার মতে, শুধু ঢাকা শহরেই ৭০ থেকে ৮০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে রাজউক জড়িত। রাজউক হল বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ ভূমিদস্যু। যখনই এই ভবনের কথা বলবেন তখনই রাজউকের চেয়ারম্যান বা শীর্ষস্থানীয়রা প্রথমেই বলবেন, আমাদের লোকবল নেই। প্রশ্ন হল, জমির ব্যবসা যখন করেন তখন কী সরকারকে বলেছেন, আমাদের লোকবল নেই, জমির ব্যবসা করতে পারব না।
ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তার গবেষণা মডেল বলছে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা-এ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখন্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। তার মতে, টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতি, সিলেটের ডাওকি চ্যুতি, সীতাকুন্ডের টেকনাফ চ্যুতি এবং উত্তর আন্দামান-টেকনাফ সাবডাকশন জোন সক্রিয় হওয়ায় ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ডাউকি চ্যুতিতে সংকোচনের হার হচ্ছে প্রতি একশ’ বছরে এক মিটার। গত পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো রেকর্ড নেই। তার মানে পাঁচ থেকে ছয় মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। যদি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করা হয় তাহলে এটা ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। উলে­খিত মাত্রার ভূমিকম্প যদি সত্যিই হয়, তাহলে তার ক্ষয়ক্ষতি এতটাই ভয়াবহ হবে যে, তার কল্পনা করা কঠিন।বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট সাফল্য দেখালেও ভূমিকম্পের মতো ব্যাপক বিধ্বংসী দুর্যোগ সামাল দেওয়ার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে।
বাংলাদেশের ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের মোকাবেলা এবং ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে সঠিক পরিকল্পনা নেই। সরকার, সিটি করপোরেশন, রাজউক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় খুবই কম। এখানে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যাও খুবই কম। তাই ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশের অভাবনীয় ক্ষতি হবে। এই ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়াবে ভবন নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়িত না হওয়ায়।
জানা যায়, গত ১২০ বছরে আমাদের ভূমিকম্প মোকাবেলা করতে হয়নি। তাই আমাদের এ বিষয়ে সরাসরি জ্ঞান কম। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে স্বীকার করতে হবে। তবে আমরা দুর্যোগ মোকাবেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। ভূমিকম্প মোকাবেলায় যন্ত্রপাতি ছিল না বললেই চলে। গত দুই থেকে তিন বছরে প্রায় ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আগামীতে আরও যন্ত্রপাতি কেনা হবে। ঢাকার অবকাঠামো যেমন দুর্বল তেমনি মানুষের জনসচেতনতা কম। তাই ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা দরকার। ঢাকাতে অপরিকল্পিতভাবে যে বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে সে গুলোতে যদি বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন করা যায়, তবে ৯০ শতাংশ ঝুঁকি কমানো সম্ভব হতে পারে। তাই ভবন নির্মাণ বিধিমালা প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যে ভবনগুলো আছে সেগুলোর ঝুঁকি যদি নিরূপণ না করি, তবে আমাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প হলে কোনোভাবে আতঙ্কিত না হয়ে কাজ করতে হবে। ভূমিকম্পের সময় তাড়াহুড়ো করে সময় নষ্ট না করে ভবনের পিলারের কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে। প্রাথমিকভাবে পারলে টেবিল বা খাটের নিচে অবস্থান করতে হবে; যাতে ভাঙা টুকরো শরীরে না লাগে। আর ভবন থেকে বেরুতে পারলে একটু ফাঁকা এলাকায় অবস্থান করতে হবে। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে আগ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে দেশের মানুষের মধ্যে ব্যপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। প্রয়োজনবোধে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে লোকজন জমায়েত করে তাদের ভূমিকম্পের সময় কি করতে হবে সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। তাছাড়া দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রীদের ভূমিকম্পের সময় কি করতে হবে তা জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মধ্যে যে সমস্ত যে বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে তা সঠিক নিয়মে নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তা তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে যে সমস্ত পাকা বাড়িঘর নির্মাণ করা হয় সেগুলোতে কোন বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। যেহেতু এগুলোর তদারকির কোন ব্যবস্থা নাই, যে যার মনের মতো করে বিল্ডিং নির্মাণ করছে। তাই সে গুলো ভূমিকম্পের সময় ধবসে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।তাই সেখানেও সরকারি ভাবে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভূমিকম্প

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন