Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বেকার জেলেদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করার তাগিদ

ইলিশসম্পদ উন্নয়নে জাটকা আহরণ ও বিপণনে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর

নাছিম উল আলম : | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের একক প্রজাতির প্রধান মৎস্য সম্পদ ইলিশ রক্ষাসহ অতি সা¤প্রতিক প্রধান প্রজনন মওশুমে নিসিক্ত ডিম থেকে প্রস্ফুটিত পোনা পরিপক্ব মাছে রূপান্তরের লক্ষে গতকাল থেকে ৮ মাসের জন্য জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি মৎস্য অধিদফতরের সুপারিশের আলোকে অন্যান্য বছরের মত এবারও নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেঁতুলিয়া নদীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে এবং পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বর-জানুয়ারী মাসের সময়কালকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখা হবে। এছাড়াও শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকায়ও মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে।
আশ্বিনের বড় পূর্ণিমাসহ এর আগে পরের ২২ দিন ইলিশের প্রধান প্রজনন মওশুম হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১ অক্টোবর থেকে বাইশ দিন উপকূলের ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার প্রধান প্রজনন এলাকাসহ উপকূলের ১২টি জেলার উন্মুক্ত জলাশয়ে সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। পাশাপাশি এসময়ে সারা দেশেই ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ থাকে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে সরকার ১৯৫০ সালের মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আলোকে ২২ দিনের ইলিশের আহরণসহ গতকাল থেকে সারা দেশে অনূর্ধ্ব ১০ ইঞ্চি সাইজের ইলিশ পোনা-জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপন্ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মৎস্য অধিদফতরের মতে ২০০৭ সাল থেকে মূল প্রজনন মওশুমে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞাসহ জাটকা আহরণ বন্ধের ফলে গত এক যুগে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরণ প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোতে যেখানে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে তা প্রতিবছরই ৪%-৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৎস্য অধিদফতরের মতে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন। গত অর্থ বছরে তা প্রায় ৫ লাখ টনে উন্নীত হয় বলে একাধিক সূত্রে বলা হলেও মৎস্য অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত হিসেব নিকেশ করা হচ্ছে। খুব শিঘ্রই এ ব্যাপারে অনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হতে পারে।
মৎস্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ইলিশের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে, অভয়াশ্রম ঘোষণা, ভরা প্রজনন মওশুমে আহরণ নিষিদ্ধ ও জাটকা সংরক্ষণ কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ইলিশ সারা বছরই কম-বেশী প্রজনন করলেও আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার সময়ই ৬০-৭০ ভাগ পরিপক্ব ও ডিম ছাড়ার উপযোগী অবস্থায় পৌঁছে। আর এসময়েই সবচেয়ে বেশী, ৫০-৬০ ভাগ ইলিশ ধরা পরে। নির্বিচারে ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা আহরণের ফলে এ মাছের প্রজনন ও নতুন প্রজন্ম ব্যাহত হবার ফলেই গত এক দশকে মূল প্রজনন মওশুমে আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ করাসহ জাটকা আহরণও বন্ধ রাখা হয়।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে দেশের উন্মুক্ত জলাশয় বা নদ-নদীগুলোতে সারা বছরই কম-বেশী ইলিশ ধরা পরলেও জাটকা ধরার প্রধান মওশুম জানুয়ারী থেকে এপ্রিল। তবে কোন কোন বছর তা মে মাস পর্যন্তও বিস্তৃতি ঘটে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে মোট ধৃত জাটকার ৩০-৪০% এপ্রিল মাসে ও ১৫-২৫% মার্চে লক্ষ্য করা গেছে। আবার উপকূলীয় নদ-নদীগুলোতে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত জাটকার আধিক্য লক্ষ্য করা গেলেও জানুয়ারিতেই সবচেয়ে বেশী জাটকা ধরা পরে। ব্যাপক হারে জাটকা আহরণের ফলে ইলিশের পুন:সংযোগ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছিল। এসব বিবেচনায় মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকেই মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
তবে গতকাল থেকে জাটকা আহরণ ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও দক্ষিণাঞ্চলে এখনো মৎস্য অধিদফতরের তেমন কোন তৎপরতা লক্ষনীয় ছিল না। মৎস্য অধিদফতরের মতে, খুব শিঘ্রই পুলিশ, কোষ্টগার্ড ও নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনকে নিয়ে সভা করে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নসহ বাস্তবায়ন শুরু হবে। তবে এবছরও টানা আট মাস জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে জাটকার ওপর নির্ভরশীল জেলেদের খাদ্য সহায়তা কতটুকু মিলবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। মৎস্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছরই এলক্ষে যে চাহিদা প্রেরণ করা হয়, তা খুব একটা আমলে নিচ্ছে না ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এমনকি গত ১ অক্টোবর থেকে ২২ দিন উপকূলের ১২টি জেলার নদ-নদীতে সব ধরনের মাছধরা নিষিদ্ধ থাকলেও মৎস্য অধিদফতরের চাহিদা অনুযায়ী জেলে পরিবার প্রতি ৪০ কেজি করে চাল দেয়নি ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এমনকি চাহিদার অর্ধেক চাল বরাদ্দের পরে তা নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার শেষ পর্যায়ে জেলেদের হাতে পৌঁছে।
এবারো আগামী মার্চের প্রথম পক্ষে মৎস্য অধিদফতর ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’ পালন করবে মৎস্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়। তবে বিগত দিনে ঐ সপ্তাহের কার্যক্রম অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাদ্ধ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
মৎস্য অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার সময় মূল প্রজননকালে ২০১০ সালে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কেজি, ২০১১ সালে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫শ’ কেজি, ২০১২ ৩ লাখ ৮০ হাজার ৪শ’ কেজি, ২০১৩ সালে ৪ লাখ ৪৭ হাজার কেজি, ২০১৪ সালে ৪ লাখ ১৮ হাজার কেজি ও ২০১৫ সালে ৪ লাখ ৯৪ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়। ২০১৫ সালে আহরণ রহিত ইলিশ থেকে উৎপাদিত ডিমের ৫০% হিসেবে ৩ লাখ ৯ হাজার কোটি রেণু পোনা উৎপাদিত হয়েছে বলে মনে করছে মৎস্য বিজ্ঞানীগণ। যার মধ্যে ১০% বেঁচে থাকলেও গত বছর নতুন ৩০ হাজার ৮৯৭ কোটি রেণু পোনা ইলিশ প্রজন্মে যুক্ত হবার কথা। চলতি বছরও আরো বেশী সংখ্যক ইলিশ পোনা নতুন প্রজন্মে যুক্ত হবার ব্যাপারে আশাবাদী মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।
ফলে আগামী দিনে ইলিশ নিয়ে অনেক সোনালী দিনের আশা করছেন মৎস্য বিজ্ঞানী ও অধিদফতর। তবে দেশের মৎস সম্পদ সমৃদ্ধির লক্ষে নির্বিঘœ ইলিশ প্রজনন ও জাটকা সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল মহল। এক্ষেত্রে সময়োচিত সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইলিশ

২০ নভেম্বর, ২০২২
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ