পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
একাত্তরের ৭ মার্চ যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে যুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার। গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা সোমবার প্যারিসে ইউনেস্কোর কার্যালয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
৪৬ বছর আগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতাকামী সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার ওই ভাষণের ১৮ দিন পর পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
ইউনেস্কো জানিয়েছে, তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডবিøউ) কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল এ্যাডভাইজরি কমিটি গত ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর প্যারিসে দ্বিবার্ষিক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশ দেয়। এরপর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ওই সুপারিশে সম্মতি দিয়ে বিষয়টি ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদে পাঠিয়ে দেন এবং সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তথ্য প্রকাশ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল এ্যাডভাইজরি কমিটির সুপারিশে মহাপরিচালকের সম্মতি পেলেই কোনো দলিলকে ওই তালিকায় যুক্ত করে নেয়া হয় এবং পরে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের দিন
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল ময়দান। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো শ্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমান জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।
বঙ্গবন্ধু বলে চলেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...সৈন্যরা,তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’
উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত আদেশ- ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।
রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের সব বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের স¤প্রচার কার্যক্রম। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ স¤প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।
বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া
ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় দেশের সংস্কৃতি অঙ্গণের বিশিষ্টজনেরা এভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, এটি আমাদের সকলের এবং বাংলাদেশের জন্য খুবই আনন্দের ও গৌরবের কথা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সেদিন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল বলেই এর সুফল আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
বাংলা একাডেমির ডিজি শামসুজ্জামান খান বলেন, ইউনেস্কোর এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক অসাধারণ অর্জন। এ অর্জনের পেছনে বাংলা একাডেমির ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলা একাডেমিই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বই আকারে প্রকাশ করে ইউনেস্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী হাইকমিশন ও দূতাবাসসমূহে প্রেরণ করেছে।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, স্বীকৃতিটি বেশ বিলম্বে এসেছে। তারপরও এ সংবাদ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই আনন্দের ও গৌরবের। এটি কোন সাধারণ ভাষণ ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ভাষণে শুধু বাঙালির নয়, সমগ্র বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কথা উঠে এসেছে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ বাংলাদেশসহ বিশ্বের জনগণের কাছে অলিখিতভাবে বহু আগেই স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ইউনেস্কোর অফিসিয়ালি স্বীকৃতির মাধ্যমে ভাষণটি ইতিহাসে স্থান করে নিল। তিনি বলেন, এ স্বীকৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধেরই স্বীকৃতি অর্জিত হলো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।