হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
ভিন্নমত যাই থাকুক, বাংলাদেশে এখন যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট ও সর্বব্যাপী সামাজিক অবক্ষয় গ্রাস করেছে তার পেছনে কাজ করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট। একটি অকেজো-অকর্মণ্য ও নৈতিক মানদন্ডহীন শিক্ষাব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু হওয়া শিক্ষাব্যবস্থার এই সংকট জাতিকে ক্রমবর্ধমান দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত, অসার ও নেতৃত্বহীন করে তুলেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষিত শ্রেনীর বড় অংশই এখন রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণের দিকে ঠেলে দিয়ে দেশকে অবক্ষয় ও সন্ত্রাসের জনপদে পরিনত করছে। তবে দারিদ্র্য ও শিক্ষাবাণিজ্যের কারণে দেশের বেশীরভাগ মানুষ তথাকথিত আধুনিক-উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা কিছু উচ্চশিক্ষিত অসাধু-দুর্নীতিবাজের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই জিম্মি হয়ে পড়লেও এখনো দেশের বেশীরভাগ মানুষ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করে দেয়নি। অন্যদিকে ক্ষীনধারায় হলেও দেশে এখনো প্রজ্ঞাবান সুশিক্ষিত প্রজন্মের অস্তিত্ব রয়েছে, যারা ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নৈতিক ধারাকে সমন্নোত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক প্রতিক‚লতা ডিঙ্গিয়ে, কোনঠাসা হয়ে ,নানা অপঘাত সহ্য করে এখনো আমাদের সিভিল প্রশাসনে, সরকারী-বেসরকারী অফিস আদালতে, ব্যবসায়ী মহলে, পুলিশ বাহিনীতে, সেনাবাহিনীতে সেই সব সৎ ও সুশিক্ষিত মানুষদের পেশাদার অবস্থান রয়েছে বলেই সভ্য সমাজ হিসেবে আমরা এখনো টিকে আছি। উপনিবেশোত্তর সত্তুর বছর ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভারসাম্যহীনভাবে এক ধরনের এড-হক ভিত্তিক নীতির উপর পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের কোন জোরালো অবস্থান না থাকা, শাসকশ্রেনীর কোন রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকায় পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত সমাজ বদলের হাতিয়ার শিক্ষাব্যবস্থাকে ভোটের রাজনীতিতে সস্তা জনতুষ্টিমূলক বিষয়ে পরিনত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পর প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও পুর্নগঠনের লক্ষ্যে একটি ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবতা নিয়ে কিছু দ্বিমত বা মতপার্থক্য সত্বেও সর্বমহলই এই শিক্ষানীতিকে মেনে নিয়েছিল। প্রথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পূর্নবিন্যাস, সৃজনশীল পরীক্ষণ পদ্ধতি,গ্রেডিং সিস্টেমের আধুনিকায়ণ ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তুরের শিক্ষার মানোন্নয়নে যথেষ্ট কার্যকর ভ’মিকা রাখবে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। দেশের সচেতন মহলের সেই প্রত্যাশা ও স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বেশী সময় লাগেনি। পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের নামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোসম্পৃক্ত বিষয়গুলো ব্যাপকহারে কাটছাঁট করা, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষাসহ প্রতিটি স্তরের পাবলিক পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই কার্যত ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষাকে নৈতিক মানে উন্নীত করার পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈষম্য ও বাণিজ্যমুক্ত করা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের অন্যতম শর্ত হলেও গত ১০ বছরে এসব ক্ষেত্রে কোন ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি, বরং আরো অবনতি ঘটেছে। এক সময় পাবলিক পরীক্ষায় ব্যাপক হারে নকলবাজি ও গণটোকাটুকি, নানান রকম উপায়ে পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হত। পরীক্ষা হলে নকল করা এবং সহযোগিতার দায়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বহিস্কৃত হওয়ার ঘটনাও ঘটত। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে নকলের সেই চিত্র অনেকটাই পাল্টে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। তবে এখন আর পাবলিক পরীক্ষায় নকল সরবরাহের প্রয়োজনই হয়না, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষার আগেই শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্র পৌছে যায়। এর ফলে যে শিক্ষার্থী সারাবছর কঠোর অধ্যাবসায় ও পরিশ্রম করে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পরীক্ষার হলে যায়, আর যে সারা বছর ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মেরে, ভিডিও গেম খেলে সময় পার করেছে পরীক্ষায় ফল প্রকাশের সময় উভয়ের একই গ্রেডের ফলাফল দেখা যাচ্ছে।
বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনের একশ্রেনীর পরিচালক নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে নামিদামি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যেনতেন প্রকারে শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ পাইয়ে দিয়ে ভর্তি প্রতিযোগিতা ও ভর্তি বাণিজ্য সৃষ্টি করেছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে প্রকাশ্য ও গোপণে ঘুষ-ডোনেশন, বিভিন্ন অজুহাতে উচ্চহারে ভর্তি ফি আদায় করা হয়। সেই সাথে আছে ভর্তির কোচিং বাণিজ্য ও গোপন বোঝাপড়ার বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও পাবলিক পরীক্ষায় ফরম ফিলাপে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ঠেকাতে সরকার সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারি করলেও এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে নানা রকম ফাঁকফোকড় রয়েই গেছে। বেসরকারী ও নিচের স্তরে ভর্তিবাণিজ্যের অভিযোগ থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাণিজ্য বা ভর্তি পরীক্ষায় অসদোপায় অবলম্বনের অভিযোগ ছিল বিরল। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেনীর শিক্ষক এবং ছাত্রলীগের একশ্রেনীর-নেতাকর্মীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। তারা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু আগেই ক্লায়েন্ট পরীক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র পৌছে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিষয়ে যেখানে ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ১০-১৫ ভাগের বেশী উত্তীর্ণ হতে পারছেনা। সোনার হরিণ একেকটি আসনের বিপরীতে অন্তত ১০জন মেধাবী শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে ছাত্রনেতা-শিক্ষকনেতা সিন্ডিকেট লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত মেধাহীনদের ভর্তির সুযোগ করে দিয়ে প্রকৃত মেধাবিদের বঞ্চিত করছে। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশের প্রকৃত মেধাবি সন্তানরা ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে জাতির ভবিষ্যত নেতৃত্ব এবং সম্ভাবনাময়, দক্ষ, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী প্রতিভাসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশ পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। এখন দেশের পাবলিক সেক্টরে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমুহে মেধাহীন, দুর্নীতিপ্রবণ, নীতিহীন ও বেপরোয়া ব্যক্তিদের আস্ফালন দেখা যাচ্ছে তাতে দেশের সামগ্রিক সম্ভাবনা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতির পরিবেশ মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করেছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়ন, মধ্যআয়ের দেশ হিসেবে উন্নীতকরণ ইত্যাদি অভিধায় দেশের উন্নয়নের মানদন্ড নির্ধারনের আগে আমাদেরকে অবশ্যই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক মানোন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনি নির্ভরতা, ভর্তি পরীক্ষা ও পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, সব সেক্টরে নিয়োগ বাণিজ্য, কোটাপ্রথা, রাজনৈতিক দলবাজি বন্ধ না হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে রাাষ্ট্রের কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করার ক্ষেত্রে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশে এমন একটি শিক্ষিত শ্রেনী সৃষ্টি করা যারা হবে ভোগবাদি, বস্তুবাদি এবং পশ্চিমা মূল্যবোধ ও ভাবধারাসম্পৃক্ত দেশীয় মধ্যস্বত্তভোগি। বস্তুগত সমৃদ্ধি লাভ ও সাহেব বনে যাওয়ার মানসিকতায় গড়ে তোলাই ছিল তৎকালীন ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। এরপরও সে সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারি ব্যক্তিত্বদের যোগ্যতা ও মনণশীলতা গড়ে উঠেছিল। মোহনদাস গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আব্দল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মত রাজনৈতিক নেতা এবং স্যার এ এফ রহমান, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল ফজল, কুদরত-ই খুদা, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ আলী আহসানের মত আলোকিত প্রজ্ঞাবান মানুষেরা গড়ে উঠেছিলেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের শিক্ষার আলোয় আরো অসংখ্য জ্ঞানী-গুনী, পন্ডিত ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের দেখানো পথেই আমরা ঔপনিবেশিক শোষন থেকে মুক্তির পথরেখা নির্মান করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং সামাজিক পরিমন্ডলে এখনো তারা সক্রিয় রয়েছেন। কিন্তু তাদের ছায়াতলে তাদের সুযোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে গড়ে ওঠার মত পরিবেশ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষায়তনগুলোতে অবশিষ্ট নেই, একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদের গবেষনা চুরি, অনৈতিক কর্মকান্ড, শিক্ষার্খীদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির ঘটনা এখন প্রায়শ: গণমাধ্যমের আলোচিত বিষয়ে পরিনত হচ্ছে। এক সময়ে শিক্ষকের যে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ছিল তা’ ক্রমশ ম্লান হতে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবাণিজ্য এবং একশ্রেনীর শিক্ষকের মুনাফাবাজি ও দলবাজির কারণে পুরো শিক্ষক সমাজের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও মর্যাদার আসন কলঙ্কিত হচ্ছে। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরেই শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন এবং শিক্ষার্থীদের বিপথগামিতার চিত্র আমাদেরকে উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত করে তোলে। পরীক্ষায় পাস-ফেল শিক্ষকের হাতে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেনীর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে নানা রকম স্বার্থ হাসিলের ধান্দা ফিকিরে লিপ্ত রয়েছেন। এসব শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থীরা যৌণ হয়রাণির শিকার হচ্ছেন এমন অনেক খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও যে সব বিষয়ে শিক্ষকদের হাতে পাবলিক পরীক্ষার প্রাকটিক্যাল নম্বর রয়েছে, সেখানের একশ্রেনীর শিক্ষকের রিরংসা ও খামখেয়ালিপনার শিকারে পরিনত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। গত মে মাসে ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, নরসিংদীর আলীজান জেএম একাডেমীর এক শিক্ষকের প্রতিহিংসার শিকার ৯ শিক্ষার্থী এসএসসি তে ফলাফল বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা গুনধর শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে মেধাবী ৯ শিক্ষার্থীকে সর্বনিন্ম নাম্বার দিয়ে তাদের জিপিএ ৫ থেকে বঞ্চিত করাসহ ফরম ফিলাপের সময় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারের কাছে। এর আগে ঢাকার এক নামিদামী বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর শ্লিলতাহানীর অভিযোগে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুনাফাবাজি, শিক্ষকদের অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে পরিমল জয়ধর সৈয়দ এনামুল হকের মত শিক্ষকদের উদ্ভব ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি অথবা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অযোগ্য ও নীতিভ্রষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে নানাবিধ স্বার্থ হাসিলে জড়িত থাকার কারণে এদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কোন শাস্তি হয়না।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সন্ত্রাসবাদি তৎপরতা মাথাচাড়া দেয়ার আগে থেকেই এক শ্রেনীর মানুষ দেশের মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচারে লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের সাথে মাদরাসা শিক্ষিতদের সম্পৃক্তা প্রমানের প্রানান্ত চেষ্টা করেছে তারা। পর পর কয়েকজন বিদেশি নাগরিকের উপর হামলা, হলি আর্টিজান, কল্যানপুর বা কথিত জঙ্গি আস্তানাগুলোতে অভিযানেও অভিযুক্তরা সাধারণ ও ইংরেজি শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষদের সংশ্লিষ্টতা প্রাথমিকভাবে প্রমানীত হয়। এসব বাস্তবতা সামনে রেখে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেশ কিছুদিন ধরে মাদরাসা শিক্ষার প্রতি ভুল ধারনা প্রসূত অপবাদ খন্ডন করে আসছেন। এ কথা এখন সকলেই স্বীকার করবেন, আমাদের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, রাষ্ট্রে এবং সমাজে যে সর্বব্যাপী অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, যার ফলে সামাজিক অপরাধ-নৃসংশতা, দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা, সন্ত্রাস-মাদকাসক্তি, অশ্লীলতাসহ বেআইনী কার্যকলাপ বেড়ে গেছে তার জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদ। আর শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ হচ্ছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কর্মরত শিক্ষক সমাজ। বিশেষত: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কর্মরত ব্যক্তিদের নৈতিক মান শিক্ষন দক্ষতা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবস্থার সরাসরি প্রভাব পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপর। একজন ভাল প্রধানশিক্ষক,প্রিন্সিপ্যাল বা ভাইস-চ্যান্সেলর নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ ও মূল্যায়ণ করতে সক্ষম। একজন দলবাজ, দর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক আরেকজন দলবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষককেই সহকর্মী হিসেবে বেছে নিতে পসন্দ করেন। গত রমজানে(জুনমাসে) ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড আয়োজিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষকের ভ‚মিকাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, শিক্ষকদের নিবেদিত প্রাণ হয়ে শিক্ষাদান করে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেকে আগে অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রেখে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিকট অনুকরণীয় হয়ে উঠতে হবে। শিক্ষকরা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের নিয়ামক, কিছু অসৎ শিক্ষকের কারণে সার্বিকভাবে শিক্ষকদের ভামমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে, যারা শেনীকক্ষে পড়াননা। টাকার বিনিময়ে বাড়িতে কোচিং করান। এমন ব্যক্তিদের শিক্ষকতার মত মহৎ পেশায় থাকার অধিকার নেই বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। যদিও শিক্ষাব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা, মানহীনতা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোটাপ্রথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পরিচালনায় রাজনৈতিক দলবাজি ইত্যাদির জন্য সরকারের বড় দায় রয়েছে। তবে শুধুমাত্র শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষে এককভাবে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার সম্ভব নয়। পুরো সরকারের কমিটমেন্ট বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
গত ২৭ অক্টোবর ইসলামি আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে স্থাপনা নির্মানে কখনো রডের বদলে বাঁশ দিবেনা, মাদরাসা কখনো এই শিক্ষা দেয়না। পর পর দুই মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর উপলব্ধি হচ্ছে, ‘প্রকৃত শিক্ষা মাদরাসা থেকেই হয়’। এ কারণেই এ দেশের আলেম সমাজের শত বছরের দাবী ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে শিক্ষামন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে চলেছেন। তবে শত বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জমে ওঠা অশিক্ষা, বৈষম্য ও অনৈতিকতার জঞ্জাল অপসারণ করা অনেক অনেক দূরূহ কাজ। এ কাজ সম্ভব হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার আমূল ইতিবাচক পরিবর্তনের চাকা সচল হয়ে উঠবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও শিক্ষার ব্যয়বাহুল্য রাষ্টীয় দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের সূতিকাগার। শিক্ষামন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্খিত পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষনা কার্যক্রম বাড়েনি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। প্রাথমিক স্তরে অপ্রয়োজনীয় পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষা বাণিজ্য বাড়ানো হয়েছে। গতকাল (৩১ অক্টোবর) একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষানীতির আওতায় গত আট বছরেও সৃজনশীল প্রশ্ন ও মূল্যায়ণ পদ্ধতি আত্মস্থ করানো যায়নি। আএমইডি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনো অর্ধেক শিক্ষক এ পদ্ধতি না বুঝেই পাঠদান করছেন। এ খাতে সরকারের ব্যয় করা ৮০০ কোটি টাকাই পানিতে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে শিক্ষকরাই সৃজনশীল পদ্ধতিতে অভ্যস্থ হতে পারছেনা সেখানে সৃজশীল পদ্ধতির দ্বারা শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ ও বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। আটবছর সময় পেরিয়ে এসে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের পর এই বাস্তবতা বিষ্ময়কর ও দু:খজনক। শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়েই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। শিক্ষণপ্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে পাঠ্যসূচি ভিত্তিক কার্যক্রমের সাফল্য নির্ভর করছে শিক্ষকের মেধা ও যোগ্যতার উপর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করে একশ্রেনীর শিক্ষককে শিক্ষাবাণিজ্য ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগ অবারিত রেখে শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়। স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়ণতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু করতে হবে। শিক্ষা নিয়ে অহেতুক প্রতিযোগিতা ও ব্যয়বাহুল্য সামাজিক বৈষম্য ও অগ্রগতির অন্যতম প্রতিবন্ধক। তথাকথিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অবহেলিত সরকারী-বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার বৈষম্য ও পার্থক্য কমিয়ে আনার বাস্তব পদক্ষেপ ও নজরদারি প্রয়োজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।