Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

পঙ্গুত্ব দমাতে পারেনি মির্জাপুরের সুকুমারকে

মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) উপজেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 জীবনের স্বর্ণালী সময়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করলেও সুকুমারকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি তার পঙ্গুত্ব। দুর্ঘটনায় মেরুদন্ডে আঘাত পেয়ে দুই হাত ও পা-সহ সমস্ত শরীর অবশ হয়ে পড়লেও বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম। অন্যের সহায়তায় হুইল চেয়ারে বসে দুর্বল হাতে কম্পিউটার কম্পোজ করে সংসার চালান অদম্য সুকুমার।
সুকুমার মির্জাপুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের বরদাম গ্রামের মৃত চাঁন মোহন সরকারের একমাত্র ছেলে। বর্তমানে তিনি মির্জাপুর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন রেজিস্ট্রি অফিসের পাশে তার কম্পিউটার কম্পোজের ভাড়া দোকানের অর্ধেক অংশে স্ত্রী জোসনা রানী সরকারকে নিয়ে বসবাস করেন।
জানা যায়, ১৯৯১ সালে এসএসসি পাস করার পর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন সুকুমার। বড় বড় গৃহস্থ বাড়ির ধান কিনে নৌকাযোগে তা রাইস মিলে সরবরাহ করতেন তার পিতা। মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজপড়ুয়া ছেলে সুকুমার লেখাপড়ার পাশাপাশি পিতাকে ব্যবসায় সহযোগিতা করতেন। এমনি অবস্থায় ১৯৯৩ সালে এক গৃহস্থ বাড়িতে ধান কিনে মাথায় বহন করে নৌকাযোগে রাইস মিলে নেয়ার সময় ধানের বস্তা শরীরে পড়ে তিনি মেরুদন্ডে গুরুতর আঘাত পান। ধীরে ধীরে তার হাত-পাসহ শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। পরে তাকে সাভার সিআরপিতে ভর্তি করে দীর্ঘ দুই বছর চিকিৎসা দেয়া হয়। এতে হাতে সামান্য বল ফিরে পেলেও পা ও শরীর অবশই তাকে তার। অন্যের সহায়তায় উঠে হুইল চেয়ার বসতে পারেন তিনি। এভাবে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কুমুদিনী, ঢাকা পঙ্গু ও সাভার সিআরপি হাসপাতালে চিকিৎসা করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন সুকুমার। জীবনযুদ্ধে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেও মনোবল হারাননি কখনো। হুইল চেয়ারে বসেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন তিনি। পঙ্গু দেহ নিয়ে ভিক্ষা না করে স্ত্রীর সহায়তায় হুইল চেয়ারে বসে ওজন মেশিনে ঘুরে ঘুরে মানুষের ওজন মেপে রোজগার করতে শুরু করেন সুকুমার। তার অসহায়ত্ব দেখে অনেকে ওজন মাপার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি টাকা দিত। এভাবে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালতে গিয়ে মানুষের ওজন মেপে আয় রোজগার করে সংসার চালাতে থাকেন তিনি। ২০০৫ সালে সিআরপিতে ফলোআপ চিকিৎসা করাতে গেলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন। সেখানে তিন মাসের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি কম্পিউটার কিনেন সুকুমার। শুরু করেন জীবনের নতুন অধ্যায়। মির্জাপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে সেটেলমেন্ট অফিস সংলগ্ন একটি দোকান ভাড়া নেন। তার অসহায়ত্ব দেখে কোন প্রকার জামানত ছাড়ায় দোকান ভাড়া দেন দোকান মালিক। রবি থেকে বৃহস্পতিবার সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিস পাড়ার ওই দোকানে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কম্পিউটারে দলিল লেখা ও নানা ধরনের আবেদনপত্র কম্পোজ করে থাকেন তিনি। গত সোমবার সুকুমারের দুই সাটারের ছোট্ট দোকান ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, দোকানে কম্পিউটার কম্পোজের কাজ করছেন তিনি। দোকানের একপাশে চকি (খাট) ফেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিছানা পাতা চকির উপরে তার অসহায় জীবনের সঙ্গী স্ত্রী জোসনা রানী সরকার সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার জন্য বসে রয়েছেন। সুকুমার জানান, কম্পিউটার কম্পোজ করে কোন দিন ৩ থেকে ৫শ, আবার কোন দিন ২/৩শ টাকা রোজগার হয়। মাসিক দোকান ভাড়া ১৫শ টাকা দেয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর কোন রকমে চলে যায় বলে তিনি জানান। স্ত্রী জোসনা রানী সরকার বলেন, এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না তিনি। প্রেসার ও ডায়বেটিসসহ বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। এমনও দিন আছে কোন আয় রোজগারও হয় না। ছোট্ট দোকান ঘরে থাকতে অসুবিধা হয় কিনা জানতে চাইলে জোসনা রানী বলেন, দোকান মালিক আব্দুল খালেক খুব ভাল লোক। তিনি আমাদের এই দুরাবস্থা দেখে অন্য দোকানের চেয়ে কিছুটা ভাড়া কম নিয়ে থাকেন।
সরকারের দেয়া পঙ্গুভাতা পেলেও কারো কাছে হাত পেতে সহায়তা নেয়ার মানসিকতা কোন দিন ছিল না বলে জানান সুকুমার। তবে কোন সুহৃদ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজ থেকে হাসি মুখে এগিয়ে এসে সহযোগিতা করলে তিনি তা গ্রহণ করবেন বলেও জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ