ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং-এর একটি অমর বাণী আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের চেয়ে ভারী, কোনো কোনো মৃত্যু হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।’ কথাটি যে কী বিরাট তাৎপর্যময় এবং এর মর্মার্থ কতটা গভীর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তবিকই কোনো কোনো মৃত্যু মানুষকে ভীষণভাবে শোকে মুহ্যমান করে, বেদনায় নীল করে দেয়। তখন সে মৃত্যু নিছক একজন মানুষের এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ায় সীমাবদ্ধ থাকে না, তা তৈরি করে এক বিশাল শূন্যতা ।
এক সময়ের দাপুটে আমলা এবং মন্ত্রী এম কে আনোয়ারের চলে যাওয়াটা ঠিক এ রকমই। গত ২৪ অক্টোবর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। পেছনে ফেলে গেছেন তার বিশাল কর্মময় জীবন, শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন অগনিত ভক্ত, সুহৃদ, আর সহকর্মীকে। ১৯৩৩ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার ওপারচর গ্রামে জন্ম মোহাম্মদ খোরশেদ আনোয়ারের, যিনি এম কে অনোয়ার নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ সালে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৫৬ সালে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স করার পর একই বছর যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দক্ষতা ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখে একের পর এক ডিঙ্গিয়েছেন সাফল্যের সিঁড়ি। জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, অর্থ সচিব এবং কেবিনেট সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরি জীবন শেষে যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতে। আর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য, হয়েছিলেন মন্ত্রী।
এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন এম কে আনোয়ার। সরকারি প্রশাসনের যে পর্যায়েই ছিলেন, নিজের এলাকার সাথে ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ। আমাদের দেশে বেশিরভাগ আমলাকে দেখা যায় জনসম্পৃৃক্তি এড়িয়ে চলতে। নিজের এলাকার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ রাখেন না। কিন্তু এম কে আনোয়ার ছিলেন এর ব্যতিক্রম। আমলা হিসেবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এলাকার সাথে তার এ নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ তাকে করে তুলেছিল বিপুল জনপ্রিয়। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন জনদরদী ও উন্নয়ন পাগল মানুষ হিসেবে। আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, ক্ষমতা হাতে পেলে বেশিরভাগ মানুষ নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রেও এম কে অনোয়ার ছিলেন ভিন্ন চরিত্রের। ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি তার এলাকাবসীর কল্যাণে কাজ করেছেন, উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। এটা শীর্ষ আমলা হিসেবে যেমন, ক্ষমতাশালী মন্ত্রী হিসেবেও তেমন।
অসাধারণ মেধাবী ছিলেন এম কে আনোয়ার। শিক্ষাজীবনে যেমন তার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনি কর্মজীবনেও তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। এমন কি রাজনীতিতেও তিনি তার সে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। রাজনীতিতে তার আগমনটা ছিল তিনি ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’ ধরনের। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই তিনি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। বিএনপি’র মনোনয়নে ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন এবং সে বছরই বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হন। সেই যে শুরু আর পেছনে তাকাতে হয়নি এম কে আনোয়ারকে। তার এলাকায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্ব›দ্বী জনপ্রিয় নেতা। তার জনপ্রিয়তার কাছে অন্যরা হয়ে পড়েছিলেন ম্লান। মোট পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি।
এম কে আনোয়ারে চরিত্রের আরেকটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাহলো সুদীর্ঘ কর্মজীবনে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকা। সরকারি আমলা হিসেবে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবন এবং সাতাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মওকা খোঁজেননি কখনোই। যেখানে সামান্য ক্ষমতার বাতাস গায়ে লাগলে কোনো কোনো মানুষকে দুর্নীতির সাগরে হাবুডুবু খেতে দেখা যায়, সেখানে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। আর তাই, সারাজীবন তাকে দেখা গেছে অতি সাধারণ জীবন যাপন করতে। সুযোগ পেয়েও দুর্নীতির অগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন এম কে আনোয়ার।
দেশ ও জাতির সেবায় অত্মনিবেদিত ছিলেন এম কে আনোয়ার। এ জন্যই একজন নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর রাজনীতির জটিলক্ষেত্রে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি তার দল এবং দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। রাজনৈতিক অবস্থান এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিত্ত বৈভব গড়ে তোলার মতো অনৈতিক কাজে লিপ্ত হননি।
এম কে আনোয়ার ছিলেন একজন ভালো মানুষ। কোনো অনৈতিক কাজে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা কখনো শোনা যায়নি। অথচ, দুঃখজনক হলো বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তাকে এ সরকারের আমলে। ৮২ বছর বয়সে এসে এমন উদ্ভট অভিযোগ এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে জেলখাটার ঘটনা তাকে খুবই মর্মাহত করেছিল। সারাজীবন পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেছেন তিনি। কিন্তু জীবন শায়াহ্নে এসে মানুষ খুনের হুকুমদাতা হিসেবে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেননি তিনি। মন ভেঙ্গে গিয়েছিল তার। পরিচিতজনদের বলেছেনও সে কথা। তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি, কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কাল্পনিক অভিযোগ আনা যেতে পারে! সারাজীবন নিয়ম-নিষ্ঠার অনুশীলনকারী এম কে আনোয়ার বোধকরি রাজনীতির এ অন্ধকার দিকটি সম্পর্কে একরকম অজ্ঞই ছিলেন। তিনি বোধহয় ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এমন অভিযোগের শিকার তাকে হতে হবে। সে মনোবেদনার বোঝা বুকে নিয়েই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
এম কে অনোয়ার চলে গেলেন। পেছনে রেখে গেলেন সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, কর্তব্যপরায়ণতা ও মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা তাকে জাতির হৃদয়ে চির অমর করে রাখবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।