Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভোগান্তি ও ছাত্রলীগ-আতঙ্কের মধ্যেই শেষ হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা

রাজশাহী ব্যুরো : | প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ২০১৭-১৮ শিক্ষাবষের্র স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া, ভোগান্তি ও আতঙ্কের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে তিন ছাত্রকে দিয়ে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘সি’ ইউনিটের তিনটি শিফটের পরীক্ষায় হলের কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিভিন্ন মহলে অভিযোগ ওঠেছে তিন শিক্ষার্থীকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করানোয় প্রশাসনের অসৎ উদ্দেশ্যই কাজ করেছে। গুঞ্জন ওঠেছে ক্যাম্পাসে সর্বত্রই। কেউ কেউ প্রশ্ন জালিয়াতির অভিযোগও তুলেছেন। তেমনি পরীক্ষা দিতে আসা কয়েক লাখ ভর্তিচ্ছুক ও অভিভাবকদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে প্রশাসনের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এবারের ভর্তি পরীক্ষায় আইন লঙ্ঘন করার রেকর্ড সৃষ্টি করে বাংলাদেশের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। আধিপত্য ও ক্ষমতা জাহির করতে মিছিল-মিটিং, প্রতিপক্ষকে অস্ত্র হাতে ধাওয়া, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করা ও বিভিন্ন ভোগান্তি সৃষ্টির অভিযোগ ওঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে ছাত্রলীগের নাম। আর এই ভোগান্তি ও আতঙ্কর মধ্যেই পরীক্ষা শেষ করতে হয়েছে তাদের। সবারই উৎকন্ঠা ছিল একটাই, পরীক্ষা সঠিক ভাবে শেষ করে বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, শিক্ষার্থী এবং অবিভাবকের সুবিধার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে সকল প্রকার মিছিল-মিটিং, সমাবেশ, সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সকল ধরণের হেল্পবুথ রাখা, ক্যাম্পাসের ভিতর প্রশাসনের গাড়ি ছাড়া সব ধরণের গাড়ি চালানো এবং কোন ধরণের দোকানপাট রাখা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু প্রশাসনের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনটাকেই মানেনি ছাত্রলীগ। বইয়ের স্টলও দিয়েছেন তারা।
সার্বিক বিয়য়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান বলেন, ‘মানবিক কারণে তিন ছাত্রকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা করার জন্য ওই দায়িত্ব দেয়া হয়। অন্যকিছু নয়। তারা ভালোভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় কর্মচারীর দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের দিয়ে পালন করিয়ে প্রশাসন চরম ‘কান্ডজ্ঞানহীনতার’ পরিচয় দিয়েছেন। প্রক্টর আরো বলেন, এবারের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর সুষ্ঠভাবে পরীক্ষা দেওয়া ও অভিভাবকরা যাতে কোন প্রকার ভোগান্তি ও আতঙ্ক ছাড়াই চলাচল করেত পারে তার জন্য কিছু নিয়ম করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন কোন প্রকার নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেনি। ফলে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া বড় ধরণের কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভাবে পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে।
রাবি উপ-ভিসি অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘আমি বিষয়টি শুনেছি। এই কাজটি চরম অন্যায় ও খারাপ হয়েছে। যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে এই কাজ করে থাকে তা খতিয়ে দেখা হবে।’, তবে ভর্তি পরীক্ষার সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়গুলো জানানোর জন্য আমাদের একজন মুখপাত্র আছেন তাকে জিজ্ঞাসা করলে এ বিষয়ে একটি স্টেটমেন্ট জানতে পারবেন। তবে তিনি ছাত্রলীগ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কয়েকজন অভিভাবক ইনকিলাবকে বলেন, প্রশাসন তিন ছাত্রকে দিয়ে পরীক্ষার হলের দায়িত্ব পালন করিয়ে মূলত আইন লঙ্ঘন করা নয় তারা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যই পালন করিয়েছেন। তারা আরো বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক প্রভাবশালী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখানে কোন ধরণের শিক্ষার পরিবেশ নেই। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকা সত্তে¡ও যেভাবে উসকানীমূলক কথাবার্তার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে উসকানী দিচ্ছিলেন তাতে যেকোন সময় বড় ধরণের সংঘর্ষ হতে পারত। আমরা আতঙ্কিত বোধ করছিলাম পরীক্ষা সুষ্ঠভাবে সম্পূর্ণ করে বাড়ি ফিরতে পারবো কিনা।
পরীক্ষার কয়দিনে ক্যাম্পাসের কয়েকদিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, পরীক্ষার প্রথম রাতেই অস্ত্রবাজী দিয়ে শুরু হয় ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের শুভেচ্ছা, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে প্রতিহত করার জন্য পরীক্ষার রাতে হলে হলে অস্ত্র হাতে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ। এরই প্রতিফলন ঘটান ২১ অক্টোবর রাতে ছাত্রদলকে প্রতিহতের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ছাত্রদলের পোস্টার, ব্যানার লাগানো হচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে বের হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আধাঘন্টাব্যাপী ‘হই-হই রই-রই, ধর-ধর, মার-মার’ চিৎকারে গোটা ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়ায় ছাত্রলীগ। তাছাড়া ওই রাতে চাপাতি, রাম-দা ও লোহার রড ঠেকিয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে উচ্চশব্দ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেন তারা। এমনকি এক্সক্লুসিভ’ সাজেশন, ‘ঝটপট ফল’ ইত্যাদি সাজেশনের নামে ভুলে ভরা সাজেশন বিক্রি করে চাঁদাবাজি করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে আতঙ্ক ছড়িয়ে মিছিল-মিটিং, সমাবেশ, মিছিল থেকে ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানোর নামে প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনকে উসকানিমূলক কথাবার্তার মাধ্যমে হুমকি এবং উত্তেজিত করার সব চেষ্টাই করেন নেতারা। ফলে যানজট ও জ্যামের সৃষ্টি হলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ছোটাছুটিও করতে দেখা যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে শিক্ষার্থী ও অবিভাবকদের মধ্যে।
অন্যদিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকা সত্তে¡ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় বুথ বসিয়ে ও ব্যানার টেনে ছাত্রলীগ পরীক্ষার্থীদের রোল ও মোবাইল নম্বর নিলে আতঙ্ক বোধ করেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। এমনকি ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষায় ব্যবহৃত গাড়ি ছাড়া সব ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাইক প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন ছাত্রলীগের নেতারা। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হন কয়েকজন ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া পরীক্ষার আগের রাত থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ১৬টি ছিনতাই-চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে হুমাউন আহমেদ নামে একজন ছুরিকাহতও হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ মদদে স্থানীয় কিছু টোকাই এসব ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত যার মোটা অংশ পান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুকে কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।
তবে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘কে, কীভাবে দেখছে, তা আমাদের চিন্তার বিষয় নয়। আমরা ভর্তিচ্ছুদের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রতিদিন মিছিল করেছি, ভর্তিচ্ছুদের সুবিধার্থে যে ‘ঝটপট ফল’ বুথ বসানো হয়, তাতে প্রতারণা বা জালিয়াতির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না’।
তাছাড়া ভর্তি পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি প্রায় সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষার্থী। তারা নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষার কেন্দ্রে উপস্থিত হতে না পারার কারণে পরীক্ষার রুমে বসতে পারেননি বলে জানা গেছে। এছাড়াও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ‹ই› ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে জালিয়াতি চক্রের এক সদস্যকে আটক, পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে তিনজন ভর্তিচ্ছুকে বহিষ্কার করে করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চতুর্থ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সকল নিয়ম ভেঙে তিন শিক্ষার্থীকে দিয়ে কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করান প্রক্টর। নিজের অজ্ঞতার পরিচয় দিলে ব্যাপক সমালোচনায় মুখে পড়েন নবনিযুক্ত প্রক্টর, আর শেষ দিনে তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভর্তি পরীক্ষা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছাত্রলীগ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ