বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়তে থাকেন। কখনো মুন্সীরহাট, কখনো কেওয়ার, আবার টঙ্গীবাড়ি, আব্দুল্লাহাপুর, লৌহজং, শ্রীনগর, গজারিয়া ও সিরাজদিখান প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধ করেছেন মুক্তি যোদ্ধারা। কখনো স্থল যুদ্ধ আবার কখনো নৌযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা যুদ্ধকালীন সময়ে দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। মুন্সীগঞ্জ, গজারিয়া, টঙ্গীবাড়ি নিয়ে একটি এরিয়া, শ্রীনগর, সিরাজদিখান ও লৌহজং নিয়ে একটি যুদ্ধ এরিয়া। প্রথম অংশের এরিয়া কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন বাবুল। দ্বিতীয় অংশের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তি যোদ্ধা শহিদুল আলম সাইদ। আর মুন্সীগঞ্জ মহকুমার বিএলএফ প্রধান ছিলেন আনিসউজ্জামান আনিস।
বহু মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ নয় মাসের বিভিন্ন সময়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন। এরা হলেন- মোহাম্মদ কলিম উল্লাহ্, গোলাম মর্তুজা চৌধুরী রাজা, এনায়েত উল্লাহ খান সেন্টু, মিনআল ঢালী, মোহাম্মদ হানিফ মোল্লা, আনোয়ার হোসেন অনু, মোশারফ হোসেন সজল, আবু হানিফ, অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান, শামসুজ্জামান মানিক, মোফাজ্জল হক, কাজী আনোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আশা, মোহাম্মদ ইয়াদ আলী, খালেকুজ্জামান খোকা, আবুল কাশেম তারা মিয়া, টঙ্গীবাড়ির সামসুদ্দিন, বজলুর রহমান সেন্টু, আব্দুল হক, মহিউদ্দিন, মতিউল ইসলাম হিরু, মোহাম্মদ মাসুম, মোহাম্মদ খালেদ।
২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মুন্সীগঞ্জ ট্রেজারি লুট হয়। ট্রেজারির চারটি তালা ভেঙে মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ৩০০টি অস্ত্র লুট করেন। এতে নেতৃত্ব দেন আনিসউজ্জামান আনিস, খালেকুজ্জামান খোকা, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, অ্যাড. মুজিবুর রহমান ও আনোয়ার হোসেন অনু, ফজলু, খোরশেদ। মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, কে, কে সরকারি ইনস্টিটিউট ও সোনালী ব্যাংকে ছিল পাক সেনাদের ক্যাম্প। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারা রামপালের ধলাগাঁও, সুখবাসপুর ও বাঘিয়া এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করেন। রামপাল হাইস্কুল মাঠে সব কমান্ডার ও মুক্তি যোদ্ধারা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসউজ্জামান আনিস-এর নেতৃত্বে মুন্সীগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। আক্রমণে যাওয়ার আগে রামপাল মাঠে একজন মাওলানা মুক্তি যোদ্ধাদের দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন। পরে ১০টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুন্সীগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অগ্রগামী গ্রুপ অজিত মোক্তারের বাড়ি থেকে একটি ফায়ার করে। ফায়ারটি করেন মোহাম্মদ হোসেন বাবুল। এর পর ১০টি গ্রুপ একসাথে ১০টি করে মোট ১০০টি ফায়ার করে। পাক বাহিনীর বা পুলিশ কোন প্রতিরোধ করেনি। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শ্লোগান দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর ২টি করে ১০ গ্রুপ হতে এক সাথে ফায়ার করা হয়। থানার কাছে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশকে সারেন্ডার করার কথা বলেন। মুন্সীগঞ্জ থানায় থাকা ১৭ জন পুলিশ আত্মসমর্পণ করেন। এ ১৭ জন পুলিশের মধ্যে ৩ জন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার। মুন্সীগঞ্জ থানা দখলের ৪৫ মিনিটের মধ্যে ধলেশ্বরী নদীতে টহলরত পাক বাহিনী সেল নিক্ষেপ করে, যার একটি শিলমন্দি মৃধাবাড়ির পাশে, অন্যটি রন্ছ মাদবর বাড়ি পাশে আঘাত হানে। এ সংবাদটি বিবিসেতে প্রেরণ করেন সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন। এছাড়াও উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক, বি এল এফ ঢাকার প্রধান মো. মহিউদ্দিন। মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী এসপি (অব.) মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অঃষধং ড়ভ ইধহমষধফবংয ষরনবৎধঃরড়হ ডধৎ ১৯৭১ গ্রন্থে মুন্সীগঞ্জ জেলায় ১৩টি যুদ্ধক্ষেত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রগুলো হলো- ১. মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা, ২. মুক্তারপুর, ৩. মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট, ৪. পুরান বাউসিয়া, ৫. চর বাউসিয়া, ৬. নয়া নগর, ৭. নয়া নগর (দ্বিতীয় দফা), ৮. গোসাইর চর, ৯. ভাটের চর, ১০. মুন্সীগঞ্জ থানা, ১১. লৌহজং, ১২. সিরাজদিখানের সৈয়দপুর এবং ১৩. সিরাজদিখান থানা। এছাড়াও মুন্সীগঞ্জ সদরে আরো দুটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। যুদ্ধক্ষেত্র দুটো হলো- রতনপুর যুদ্ধক্ষেত্র ও মুন্সীরহাট যুদ্ধক্ষেত্র। মুক্তিযোদ্ধা মো. সুরুজ মিয়া এবং মো. বোরহান উদ্দিন জানান, রতনপুর যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীকে মুক্তিবাহিনী পরাজিত করে। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক সরকার নেতৃত্ব দেন। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী হয় রতনপুর যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। সময়টা ছিল ভোর রাত। মুন্সীরহাট যুদ্ধ হয় সকাল দশটায়। মুন্সীরহাটে অবস্থান নেয় পাক সেনাবাহিনী আর খালের দক্ষিণ পাড় চর কেওয়ারে বাইদ্দাবাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী। মর্টার সেল নিক্ষেপ করে পাক বাহিনী, বিপরীতে রাইফেলের গুলি নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দেয় মুক্তিবাহিনী। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী হয় এই য্দ্ধু। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী জয় লাভ করে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেটাসোর্স অনুযায়ী জেলায় ছয়টি বদ্ধভূমি বা সমাধী ভূমি রয়েছে। বদ্ধভূমিগুলো হলো ১. কেওয়ার সাতানিখিল, ২. হরগঙ্গা কলেজ হোস্টেল, ৩. হরগঙ্গা কলেজসংলগ্ন পাঁচঘড়িয়াকান্দি, ৪. চর বাউসিয়া, ৫. নয়া নগর এবং ৬. সৈয়দপুর। এছাড়াও আব্দুল্লাপুরের পালবাড়িতে একটি বদ্ধভূমি রয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৬৭টি শহীদ পরিবার রয়েছে। শাখাওয়াত হোসেন নিলু জানান, ১১ ডিসেম্বর সকালে অ্যাড. শহীদুল আলম সাঈদ গ্রুপের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা সকালে মুন্সীগঞ্জ শহর দখল নেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. মুজিবুর রহমান জানান, বেলা ১১টার সময় তিনি ও তার সহযোদ্ধারা মুন্সীগঞ্জ শহরে অবস্থান নেন। তারিখটি ছিল ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ২৪৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নয় মাস যুদ্ধ করে ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে মুন্সীগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে। ২০০৭ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশের মহামন্য রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংম্বলিত স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। জাতি তাদের বিন¤্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে আজীবন।
য় লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।