হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
পরিসংখ্যান বা জরিপ সবসময় যথাযথ চিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না। এটি একটি হাইপোথেটিক্যাল বিষয়। এ হিসাবকে ম্যানুপুলেশন বা প্রভাবিত করা যায়। আর সরকারের পরিসংখ্যান বা জরিপ হলে তো কোনো কথাই নেই। বাস্তব চিত্র যাই হোক না কেন, এটাই সত্য এবং অবধারিত হিসেবে ধরে নিতে হবে। এতে সরকারের উন্নয়নের অসাধারণ সব চিত্র থাকে। অবশ্য কোনো সরকারেরই তার উন্নয়নচিত্রের অবনতি দেখাতে চায় না। সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আয়-উন্নতি নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। এই জরিপে পাঁচ বছর অন্তর করা হয়। পাঁচ বছর আগে মানুষের আয়-ব্যয় কেমন ছিল, আর পাঁচ বছর পর কেমন, তাই এ জরিপের বিষয়বস্তু। জরিপে অনেক বিষয় উঠে এসেছে। পরিবারের গড় আয়-ব্যয়, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, পুষ্টিমান, জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব মৌলিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি পরিমাপ করা হয়েছে। সরকারি এই সংস্থাটির হিসাব মতে, দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমে গেছে। এখন দারিদ্র্যের হার ২৪.৩ শতাংশ। বছর দুয়েক আগেও এ হার ছিল ২২ শতাংশের মতো। এ নিয়ে সরকারের গর্বের অন্ত ছিল না। টক শোগুলোতে সরকারের নেতারা গর্ব করে সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারেরই হিসাব মতে, দারিদ্রের হার ২ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর অর্থ দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারের এই পরিসংখ্যানই যখন বলছে, দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এর প্রকৃত চিত্র কি, তা সচেতন মানুষের না বোঝার কারণ নেই। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ৩ কোটি ৮৮ লাখ মানুষ। এরা কেন দারিদ্র্যসীমার নিচে এরও একটি সংজ্ঞা আছে। বিবিএস-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা দৈনিক দুই হাজার ১২২ কিলোক্যালরির কম খায় এবং যারা খাওয়ার বাইরে কম খরচ করে তারা দরিদ্র। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি অন্যরকম। তার মতে, যাদের দৈনিক আয় দুই ডলার বা ন্যূনতম ১৬০ টাকার নিচে তারা দরিদ্র। এ হিসাবে বাংলাদেশে এখনো প্রায় চার কোটি মানুষ দিনে ১৬০ টাকা আয় করতে পারছে না। সরকারের হিসাব মতেই যখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এত, তবে বাস্তবে যে এ সংখ্যাটা আরও বেশি হবে, তা বলা নিস্প্রয়োজন।
দুই.
বর্তমান সরকারের আগের শাসনামলে জিনিসপত্রের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়। পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। সরকার কিছুতেই খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। এ নিয়ে প্রতিদিনই তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রতিদিন এ নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেকটা বিরক্ত হয়েই তিনি বলে ফেলেছিলেন, কম খান। এমনিতেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না, তার উপর সাংবাদিকদের ক্রমাগত প্রশ্নের চাপে তিনি কথাটি বলে ফেলেছিলেন। আর যায় কোথায়! এ নিয়ে শুরু হয় দেশব্যাপী সমালোচনা। কেউ বললো ভাত দেয়ার মুরোদ নাই, আবার বলে কম খান। মন্ত্রী বিপদে পড়ে গেলেন। অথচ তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিকারি সিন্ডিকেটকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। এর সঙ্গে যে রাঘব-বোয়ালরা জড়িত, তা তিনি জানলেও করার কিছু ছিল না। বড় শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট। ফলে অনেকটা ক্ষুদ্ধ হয়েই বলে ফেলেছিলেন, কম খান। আরো একবার এমন হয়েছিল। তখন একটি শ্লোগান দেয়া হয়েছিল, ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর জোর কমান।’ ভাতের বিকল্প হিসেবে আলুকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। এবারও সরকার এ শ্লোগান দিতে পারত। কারণ দেশে আলুর অভাব নেই। গোডাউনে লাখ লাখ টন আলু পড়ে আছে। দামও কম। সমস্যা হচ্ছে, সরকার যখন খাদ্যে বিশেষ করে চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতার শ্লোগান তুলে ফেলেছে, তখন এর পরিবর্তে আলু খাওয়ার শ্লোগান দেয়া তার জন্য অবমাননাকর। এতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবীটিই অসার হয়ে যায়। তবে এ শ্লোগান না দিলেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয়টি যে একেবারে ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সরকারও লাখ লাখ টন চাল-গম আমদানি শুরু করেছে। চালের অভাব এবং অত্যধিক দামবৃদ্ধির কারণে মানুষ কম খেতে শুরু করেছে। এবারের বিবিএস-এর জরিপেই তা উঠে এসেছে। জরিপে বলা হয়েছে, দেশের মানুষ আগের চেয়ে ভাত কম খাচ্ছে। স্বাভাবিক বিবেচনায় এই কম খাওয়াকে মানুষ অভাবের বিষয়টিকেই ধরে নেবে। এ কারণে ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। অবশ্য মানুষের এ ধারণাটি যে ভুল তা এক মন্ত্রী ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভাত খাওয়ার পরিবর্তে মানুষের মধ্যে মাছ, গোশত, শাকসবজি, ডাল ও ডিম খাওয়া বেড়েছে। বিরাট ব্যাপার! মানুষের মধ্যে দামী ও সৌখিন খাবার খাওয়ার হার বেড়ে গেছে। মন্ত্রী বলেছেন, এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়েছে। আগের চেয়ে তারা ভাত কম খাচ্ছে, কার্বোহাইড্রেট কম খাচ্ছে। এতে বেশি দিন বাঁচবে। তার এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, মানুষকে তিনি ডায়েট করার পরামর্শ দিচ্ছেন। ভাত খেলে মোটা হয়ে যায়, কাজেই স্লিম থাকার জন্য ভাত কম খাওয়া ভালো। দারুণ হেলথ টিপস! তার এ কথা আরেকটু সম্প্রসারিত করে বলা যায়, কম খেলে মানুষ মরে না, বেশি খেলে মরে। সুসাস্থ্যের জন্য পরিমিত খাদ্যাভ্যাস এবং ডায়েটের প্রয়োজন। সাথে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে আরও ভাল। মন্ত্রীদের এই টিপস অনিচ্ছা সত্তে¡ও হতদরিদ্র মানুষগুলো মেনে চলেছে। পার্থক্য হচ্ছে, পর্যাপ্ত খাদ্য নিয়ে নয়, খাদ্যাভাবেই তাদের ডায়েট করতে হচ্ছে। মন্ত্রীদের এসব কথা যে হতদরিদ্র ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারি কোটি কোটি জনগণের সাথে তামাশা ছাড়া কিছু নয়, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। আবার মন্ত্রীদেরও বোধ হয় দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ তাদের দৃষ্টি দরিদ্র জনগোষ্ঠী পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাদের ঘিরে থাকা খাদ্য-পুষ্টিতে ভরপুর মানুষের দেয়াল ভেদ করে দৃষ্টি দরিদ্র মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। মন্ত্রী অত্যন্ত গর্বসহকারে আমাদের আরেকটি তথ্য দিয়েছেন। আমাদের দারিদ্র্যের হার কত উন্নত, তা বোঝাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার উদাহরণ টেনেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার দারিদ্র্য হারের সাথে তুলনা করে বলেছেন, আমাদের দেশে হতদরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশ। আর ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৬ শতাংশ। এ এক বিশাল ব্যাপার-স্যাপার! আমেরিকার একটি অঙ্গরাজ্যের চেয়েও আমরা কত উন্নত! এসব পরিসংখ্যানের কথা শুনতে কত ভাল লাগে! আমরা উন্নতির শিখর থেকে মাত্র এক হাত নিচে। আরেকটু ধাক্কা দিলেই উঠে যাব। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারি মানুষ পর্যন্ত এ পরিসংখ্যান পৌঁছেছে কিনা জানি না। পৌঁছলে বা তাদের সামনে এ পরিসংখ্যান তুলে ধরলে, প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা কল্পনা করা যাচ্ছে না। তারা হয়তো পেটে ক্ষুধা নিয়ে এটুকু বুঝবে, সরকার কী আর অসত্য কথা বলবে! সরকারকে তো বিশ্বাস করতেই হবে। যারা এসব পরিসংখ্যান বোঝে, তারাই যত নষ্টের মূল। সরকারের সাফল্য কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। তারা এ তুলনাকে আগরতলা আর চকিরতলার সাথে তুলনা করে বসে। ব্যাখ্যা দিয়ে বলে, ক্যালিফোর্নিয়ার লিভিং স্ট্যান্ডার্ড আর বাংলাদেশের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড আসমান-জমিন ফারাক। ওখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে যে মানুষটি বসবাস করে, তারও ন্যূনতম একটি গাড়ি আছে, তার আয় বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের চেয়েও বেশি। আর তাদের দারিদ্র্যসীমার সংজ্ঞার সাথে আমাদের দারিদ্র্যসীমার সংজ্ঞার তুলনা চলে না। বিবিএসে পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মানুষের খরচের খাতগুলোও পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে মোট খরচের ৫৪ শতাংশই খাবার কেনায় ব্যয় করত। এখন তা কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রথমবারের মতো খাদ্যবর্হিভূত ব্যয় খাদ্যের তুলনায় বেড়েছে, যা উন্নয়নের অন্যতম নির্দশন। বিষয়টি কেমন গোলমেলে। আমরা সাধারণত বুঝি, মানুষ তার মৌলিক চাহিদা খাবারের সংস্থান করার পর অন্যান্য খাতের ব্যয়ে মনোনিবেশ করে। পেট ভরা থাকলে অন্যান্য দিকে মনোযোগ দেয়। না খেয়ে শখ পূরণে বা আনন্দ-ফূর্তিতে ব্যয় করে, এমন কথা শোনা যায় না। বিবিএস হয়তো সেই ডায়েটের কথাই বলতে চেয়েছে যে, কম খান বা পেটে ক্ষুধা রেখেই উন্নতি করুন। বাঙ্গালির চিরকালীন ভোজন রসিকতা বাদ দিন।
তিন.
প্রায় ছয়-সাত বছর আগে খাদ্যমন্ত্রীর ‘কম খান’ মন্তব্য যে আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে, তা মনে হয় দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। এখন তাদের ঠিকই কম খেতে হচ্ছে। অবশ্য বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ যে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে, তারা এই সূত্রের বাইরে। বাকি ৯০ শতাংশকেই এখন কম খাওয়ার অভ্যাস করতে হচ্ছে। এক সময় গর্ব করে বলা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দেশে এখন যে খাদ্য সংকট চলছে, তাতে ১০ শতাংশ মানুষের কিছু যায় আসে না। চাল, ডাল, মাছ, গোশত, তেল, নুন, মরিচ, শাকসবজির কেজি ৫০০ বা ১০০০টাকা হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তারা জিনিসপত্রের দামের খোঁজই রাখেন না। তারা বাজারে যান না বললেই চলে। গেলেও যা প্রয়োজন দোকানিকে পরিমাণ বলেন এবং দোকানিও হিসাব করে কত হলো বলে দেন, এ অনুযায়ী ক্রেতাও দাম দিয়ে দেন। কোনটার কত দাম জানার প্রয়োজনও মনে করেন না। অন্যদিকে এই খাদ্য সংকট এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের কারণে খেটে খাওয়া মানুষ, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের কী দুর্দশা তা কেউ জানে না। মানসম্মানের ভয়ে কারো কাছে কষ্টের কথাও বলে না। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেন বটে, নিজেদের দুঃখের কথা শেয়ার করে না। এই যে চালের দাম বেড়ে গেল, তাতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার খোঁজ কি ঐ ১০ শতাংশ মানুষ, বা সরকার কি রাখে? রাখে না। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, চালের দাম বেড়ে গেলে দরিদ্র মানুষ তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা খায়, আর যারা দুই বেলা খায়, তারা খাওয়া একবেলা কমিয়ে দেয়। এতে তাদের কর্ম ও জীবনশক্তি কমে যায়, অপুষ্ট একটি প্রজন্ম তৈরি হয়। যে মোটা চালের দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, তা হতদরিদ্র মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব হচ্ছে না। একটু কম দামে কেনার জন্য তাদের এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘুরতে হচ্ছে। কোনো রকমে চাল কিনলেও শাকসবজি কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে। এসব মানুষের এ দুঃখের খবর কজনাই বা রাখে! বাধ্য হয়েই তাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইউএসডি তার এক প্রতিবেদনেই বলেছে, চাল কেনা সম্ভব না হওয়ায়, এ বছর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাত খাওয়ার পরিমাণ ১ লাখ টন কমে যাবে বলে। এ কমে যাওয়া এ বছরই নয়, আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি আরও দুই বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, ২০১৫-২০১৬ সালে চালের দাম বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ ২ লাখ টন কমে যায়। অর্থাৎ যখন মৌলিক খাদ্য উপাদানের পরিমাণ কমে যায়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, বাংলাদেশের দরিদ্র ও অতি সাধারণ মানুষ কত কষ্টে জীবনযাপন করছে। তাদের আধবেলা আধপেটে দিন যাপন করতে হচ্ছে। আর এ বিষয়টি জায়েজ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভাত কম খেলে মানুষ বেশি দিন বাঁচে। এ যে কত বড় নিষ্ঠুরতা, তা বলা বাহুল্য। এ কথাটি তখনই জায়েজ হতো, যখন পর্যাপ্ত খাবার এবং মানুষের তা কেনার সামর্থ্য থাকত। এখন যার ভাত খাওয়ারই সুযোগ কম, তাকে কার্বোহাইড্রেট কমানোর কথা বলা চরম রসিকতা ছাড়া আর কী হতে পারে! পরিসংখ্যানের নামে দেশের মানুষের সাথে এমন মশকরা করা কখনো কী দায়িত্বশীল সরকারের কাজ হতে পারে! এখন মানুষের এমন পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, চাল কিনতে গেলে মাছ-গোশত দূরে থাক, শাকসবজি কেনার মতো সামর্থ্য থাকে না। ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে গেলে পকেট সমান জিনিসপত্র নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। আধা কেজি করে যদি চার-পাঁচ পদের শাকসবজি কেনা হয়, তা পলিথিনের একটি বড় ব্যাগও ভরে না। আর এতে পাঁচ থেকে ছয়শ’ টাকা ব্যয় হয়ে যায়। কোনো সবজির কেজি-ই গড়ে ৭০ টাকার নিচে নয়। আধা কেজি সবজি দিয়ে এক দিনের তরকারি রান্না করতেই যদি পাঁচ-ছয়শ’ টাকা লেগে যায়, তবে সীমিত আয়ের একজন সাধারণ চাকরিজীবীর পক্ষে কি তা বহন করা সম্ভব? নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার বা যে মানুষটি দিন আনে দিন খায়, তার পক্ষে কি শাসসবজি অনেকটা চেয়ে চেয়ে দেখার জিনিস নয়? ফলে অনিবার্যভাবেই তাকে কোনো রকমে চাল কিনে পানি দিয়ে ডলে বা একটুখানি ডাল যোগাড় করে পেট ভরানো ছাড়া আর কী উপায় থাকতে পারে।
চার.
দুঃখের বিষয়, সাধারণ মানুষের এই অতি দলিত-মথিত জীবনের মাঝেই আমরা ব্যাপক উন্নয়নের ফিরিস্তি ও পরিসংখ্যান দেখছি। সরকার বুঝতে পারছে না, অনাহারে-অর্ধাহারে, কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন করা মানুষগুলোর কাছে এসব উন্নয়ন দৃশ্য পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। বড় বড় প্রকল্পের উন্নতি তাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলছে না। বরং বিভিন্নভাবে ভ্যাট-ট্যাক্সের মাধ্যমে তাদের টানাপড়েনের জীবন থেকে যে অর্থ নিয়ে নেয়া হচ্ছে, তাই অনেক পীড়াদায়ক হয়ে পড়েছে। কষ্টে থাকা এসব মানুষগুলোর এখন প্রত্যাশা, কবে জিনিসপত্রের দাম কমবে, ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে, পেটভরে তিন বেলা খেতে পারবে। একবেলা খাবার কমানোর কথা চিন্তা করতে হবে না। ভাতের অভাবে না খেয়ে থাকতে পারাকে ‘কার্বোহাইড্রেট’ কমানো হিসেবে গণ্য করা হবে না। তাদের কাছে এখন একান্ত কামনা, বেশি খাওয়ারও প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজনটুকু মিটলেই চলবে। অতি উন্নয়নের পরিসংখ্যান বা ফিরিস্তি নয়, সম্মানের সাথে বেঁচেবর্তে থাকাই তাদের এখন বড় স্বপ্ন। সাধারণ মানুষের এ স্বপ্ন সরকার উপলব্ধি ও অনুধাবন করলেই তারা খুশি। তারা উন্নয়নের ধোঁয়ায় মোহগ্রস্ত হতে চায় না। সাধারণ মানুষের এ চাওয়া সরকার খুব একটা যে অনুধাবন করছে, তা তার আচরণে স্পষ্ট নয়। সে তার ফানুস উড়িয়ে চলেছে। মনগড়া মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিচ্ছে, জিডিপির উলম্ফনের কথা বলছে, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলছে। অথচ সাধারণ মানুষ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে, তাদের পক্ষে জীবনযাপন দিনের পর দিন কতটা কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা মনে করি, সরকার যদি জনগণের হয়ে থাকে, তবে জনগণের এসব সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ক্রয় সাধ্যের মধ্যে রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে মনোযোগী হওয়া দরকার। কীভাবে স্বচ্ছন্দ ও আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।