Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

নড়বড়ে বেড়িবাঁধ অরক্ষিত উপক‚ল

| প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জোড়াতালি মেরামতে শত কোটি টাকা লুটপাট : উপযুক্ত মওসুমে সংস্কার কাজের গরজ নেই : দুর্যোগ আতঙ্কে উপকূলবাসীর বুক কাঁপে
শফিউল আলম : দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগের প্রায় সর্বত্র নড়বড়ে ও ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রয়েছে বেড়িবাঁধ। এরফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে উপকূল। এখন কার্তিকের তুফানের মওসুম। বঙ্গোপসাগরে কোন লঘুচাপ-নি¤œচাপ সৃষ্টি হলেই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসের আতঙ্কে দিন গুজরান করেন লাখ লাখ উপকূলবাসী। গতকাল (শুক্রবার) দুর্বল স্থল নি¤œচাপের বর্ধিত প্রভাবে সৃষ্ট সামুদ্রিক প্রবল জোয়ারে চর, উপকূল, দ্বীপাঞ্চলে ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ উপচিয়ে নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়। তবে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস যদি আঘাত হানে তাহলে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় জনপদের অস্তিত্বই হবে হুমকির সম্মুখীন। সাধারণত এপ্রিল-জুন এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দুর্যোগের আতঙ্কে উপকূলবাসীর বুক কাঁপে। প্রতিবছর বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার করা হয়। তবে হরহামেশাই অভিযোগ পাওয়া যায়, বাঁধের কাজ হয়ে থাকে নেহায়েৎ দায়সারা গোছের। খুবই নি¤œমানের। বেড়িবাঁধের কাজে নয়-ছয় শুভঙ্করের ফাঁকি, অনিয়ম-দুর্নীতিই যেন ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। কাজেকর্মে নেই কোন সমন্বয় কিংবা সুষ্ঠু তদারকি। এ কারণে জোড়াতালি মেরামতের পেছনে শত শত কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। আর পকেট ভারী হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ঠিকাদার সিন্ডিকেটের।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুষ্ক সময়ে উপযুক্ত মওসুমে বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজের কোন গরজ নেই। অথচ ভরা বর্ষা ও দুর্যোগের মওসুমকে বেছে নিয়েই তড়িঘড়ি করে জোড়াতালি মেরামত কাজ সারানো হয়। কারণ তখন ‘প্রকৃতির’ উপর দোষ চাপিয়ে বেড়িবাঁধ ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হওয়ার অজুহাতে নতুন নতুন বরাদ্দ আর হরিলুটের আয়োজন চলে ফি-বছর ঘুরেফিরেই। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশের চর, দ্বীপাঞ্চল ও উপকূলভাগে ৩৬ শতাংশ জায়গায় বেড়িবাঁধের চিহ্ন প্রায় মুছে গেছে। উপকূলে প্রায় ৪৫ ভাগ বেড়িবাঁধ কম-বেশি বিধ্বস্ত ও নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। গত ৩০ মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ এবং এর পরবর্তী একধিক নি¤œচাপের কারণে প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের আঘাতে বিস্তীর্ণ এলাকায় বেড়িবাঁধ সাগরের করাল গ্রাসে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে কম-বেশি। তবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে কারচুপি অনিয়ম ও তা নি¤œমানের হওয়ার ফলে বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। এর আগে থেকেই সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে অধিকাংশ এলাকায় বেড়িবাঁধ। ‘মোরা’র কারণে তা আরও ভেঙে ধসে পড়ে। বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বেশিরভাগ জায়গায় বেড়িবাঁধ টিকে আছে নাজুকদশায়। যা উপকূলবাসীর জানমাল, অবকাঠামো, ফল-ফসলের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ।
মোরা, আইলা, সিডর, নার্গিস, কোমেন, রোয়ানুর মতো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস ছোবল হানে একের পর এক। এতে নড়বড়ে বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে উপকূলবাসীর বসতভিটা, ফসলি জমি, ফাউন্দি ক্ষেত-খামার, লবণের মাঠ, চিংড়ি ঘেরসহ জীবিকার অবলম্বনসমূহ উত্তাল সাগরের সাথে মিশে যাচ্ছে। এভাবে বঙ্গোপসাগরের গ্রাসের মুখোমুখি রয়েছে ২১টি উপকূলীয় জেলার অন্তত ৪ কোটি মানুষ। তারা মজবুত টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে অরক্ষিত। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ, পতেঙ্গা, কাট্টলী, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলাসহ বিভিন্ন স্থানে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের নামে শত শত কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। মানসম্মত কাজ হয়না, বাঁধ টেকেনা। ফিরেনা উপকূলবাসীর ভাগ্য। বেড়িবাঁধগুলো হয়না সুরক্ষিত।
উপকূলীয় বেড়িবাঁধ টেকসই না হওয়ার কারণে উপকূলবাসী শুধুই নয়; শহর নগর, দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম, জ্বালানি তেলের স্থাপনা, শিল্প-কারখানা, রফতানিমুখী শিল্পজোন, নৌ ও বিমান ঘাঁটি, পর্যটন কেন্দ্রসহ হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যবান রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন-শাহপরীর দ্বীপ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ, হাতিয়া, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, সাতক্ষীরা অবধি ৭১৫ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগ, চর ও দ্বীপাঞ্চল অরক্ষিত পড়ে আছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এজেএম গোলাম রাব্বানী জানান, উপকূলবাসীর জানমাল ও সম্পদ-অবকাঠামোর রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের পরিকল্পিতভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করতে হবে। তিনি জানান, ‘ফানেল’ বা চোঙা আকৃতির বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর উপকূল হচ্ছে দুর্যোগ-প্রবণ। চর, উপকূল, দ্বীপাঞ্চলে দুর্যোগের ঝুঁকি সর্বাধিক। অথচ বিপদ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত অবকাঠামো, প্রস্তুতি ও জনসচেতনতার অভাব রয়েছে। প্রতিবছর উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনে বৈরী প্রভাব বাড়ছে।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে ধ্বংসযজ্ঞের পর দুর্যোগপ্রবণ সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল, সম্পদ সুরক্ষায় অগ্রাধিকার পরিকল্পনার ভিত্তিতে উপযুক্ত অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এর আওতায় তৎকালীন সচিব এম মোকাম্মেল হকের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চপর্যায়ের সরকারি কমিটি পেশ করে দীর্ঘ প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা। এতে টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞ দল সমন্বয়ে মাঠপর্যায়ে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ শেষে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদে সরকারের করণীয় সম্পর্কে মোকাম্মেল কমিটির দেয়া ১৭ দফা প্রস্তাব ও সুপারিশমালা বিগত ২৬ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। গড়ে উঠেনি নিরাপদ দুর্যোগ অবকাঠামো। কৃষি-খামার, চিংড়িসহ সামুদ্রিক মৎস্য, লবণ, মুক্তা, প্রবাল, ঝিনুক, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদরাজি প্রতিনিয়ত রয়েছে দুর্যোগের ঝুঁকিতে। কার্যত বাসোপযোগী হয়ে উঠেনি বিশাল সম্পদের ধারক উপকূলভাগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ