হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
একটি গোষ্ঠির কোটারি স্বার্থের কাছে রাষ্ট্যব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সর্বত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলো একটি পুঁজিবাদি কর্পোরেট শক্তি ও লুটেরা শ্রেনীর কাছে কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক, খনিজ সম্পদ, ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর জনগনের সর্বোচ্চ সম্পৃক্ততা ও নিরাপত্তা ক্রমে শিথিল হয়ে পড়ছে। মার্কিন সাংবাদিক-অর্থনীতিবিদ পল ক্রেইগ রর্বাটস’র একটি উদ্ধৃতি এ সপ্তাহে আইসিএইচ অনলাইনের হোমপেজে শোভা পাচ্ছে- যেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করছেন। পল ক্রেইগ রবার্টস’র মতে একটি ব্যর্থরাষ্ট্রের প্রধান চারিত্রলক্ষণ হচ্ছে, সাধারণ রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরাধিরা সরকারের বাইরে থেকে সরকার ও জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে, আর ব্যর্থরাষ্ট্রে অপরাধিরা সরকারের ভেতরে থেকেই জনগনের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে। এই বাস্তবতায় বর্তমান মার্কিন সরকারের ভেতর ওয়ালস্ট্রীট গ্যাংস্টারদের প্রভাব ও অপতৎপরতার পূর্ণ আলামত রয়েছে বলে পল রর্বার্টস মনে করেন, যা’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে সামিল করছে। তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলো সত্যিকার অর্থে স্বাধীন সার্বভৌম কিনা এ নিয়ে তথাকথিত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে যুক্তিতর্ক হতে পারে, তবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় অভিষিক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা তাদের রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জন্য শাসকদের দিকে সরাসরি আঙুল তোলতে পারে। বাংলাদেশের মত দেশে তা পারেনা। আর এটাই আমাদের জনগনের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের নামে ভন্ডামির প্রধান মূল দলিল। সরকার বা শাসকগোষ্ঠির চাপিয়ে দেয়া দেশপ্রেম, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের টেবলেট গিলে আমাদের নাগরিকদের অনবরত জয়বাংলা-জিন্দাবাদ শ্লোগান জারি রাখতে হবে। নতুবা যে কেউ এন্টি স্টেট বা স্বাধীনতার চেতনা বিরোধি শক্তি হিসেবে তকমা পেয়ে বসতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের ‘ডিপ স্টেট’থিউরি বেশ আলোচিত হতে দেখা যাচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র ও সরকারের বাহ্যিক অবকাঠামোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা আরেকটি প্রবল শক্তির অস্তিত্ব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তারা কর্পোরেট পুঁজিবাদের শিখন্ডি হয়ে রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, লোকসংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকে সেই ডিপ স্টেটের অনুকুলে পরিচালিত করছে। এ কারণেই অর্থনৈতিক মন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় মার্কিন জনগনকে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে, যারা নিজেদের ৯৯ভাগ মানুষের প্রতিনিধি দাবী করছে। বাকি একভাগের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলন, যারা কর্পোরেট মাফিয়া, মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ধ্বজাধারি। এরাই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ঘুনপোকার মত লুকিয়ে থাকা শক্তি বা ডিপ স্টেট। ভিন্নরূপে ভিন্ন মেজাজে এই শক্তি আমাদের দেশেও সক্রিয় আছে। আমরা যখন শেয়ার বাজার কারসাজিতে দেশের পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়ার পর দেশের অর্থমন্ত্রীকে বলতে শুনি এই কারসাজির সাথে রাঘব বোয়ালরা জড়িত, তাদের নাম বলা যাবেনা। লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারির পুঁিজ হাতিয়ে নিয়ে পথে বসিয়ে দেয়ার পরও রাষ্ট্র এদের বিচারের মুখোমুখি করার সাহস পায়না। জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে ব্যাংকগুলোকে কার্যত দেউলিয়া করে দেয়ার পরও অর্থমন্ত্রীকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভ চুরির পর এ সম্পর্কে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বছরের পর বছর ধরে প্রকাশিত হয়না। এসব ঘটনায় সরাসরি যাদেরকে দায়ি করা হয়, যাদের উপর দায়-দায়িত্ব বর্তায় তাদের কিছুই হয়না। একশ্রেনীর ক্ষমতাবান মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে দিব্যি কোটি টাকা দামের গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে হাজির হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুযোর্গে ফসলহানির কারণে ক্ষুদ্র কৃষিঋণ গ্রহিতা হাজার হাজার প্রান্তিক কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দিয়ে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে কোমরে দড়ি বেঁেধ আদালতের কাঠগড়ায় নিয়ে যাচ্ছে সরকারের পুলিশ বাহিনী। রাষ্ট্রের বৈপরীত্য ও ব্যর্থতার এরচে বড় দলিল আর কি হতে পারে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর ডিপ স্টেট এবং ডিভাইড থিওরি ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের ইতিহাসের সমবয়েসী ব্যাধি। বাণিজ্য ও বাজার দখল করতে এসে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এ দেশে উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিল এ’দেশেরই একটি সুবিধাভোগি ক্ষমতালোভি শ্রেনী। মিরজাফর, জগৎশেঠদের সহযোগিতা না পেলে মাত্র কয়েকশ’ নিরাপত্তা রক্ষি নিয়ে রর্বাট ক্লাইভরা কখনোই নবাবের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে পারত না। বাংলার সাধারণ হিন্দু মুসলমানরা সেই পরাজয় মেনে নিতে পারেনি বলেই পলাশির পরাজয়ের একশ’ বছর পর ১৮৫৭ সালে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলায় এতবড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। সে সময় বাংলায় গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলে ১৮৫৭ সালেই হয়তো ইংরেজদের পাততাড়ি গুটাতে হতো। সেই সেনা বিদ্রোহকে ঐতিহাসিকরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করলেও কেউ কেউ এই ঘটনাকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিদ্রোহী সেনারা দিল্লীতে গিয়ে মোঘল রাজপরিবারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও শত বছর আগে পরাজয়ের পর থেকে বৃটিশদের চাপে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু মোঘলদের মধ্যে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে একটি রাজনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার মত শক্তি অবশিষ্ট্য ছিলনা। এরপরও ইংরেজরা মোঘলদের বংশ পরম্পরায় ধু ধু বালুচরে মরানদীর মত বেঁচে থাকা শেষ মোঘল নবাব বাহাদুর শাহকে ১৮৫৮ সালে বার্মায় নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই মৃত্যু হয় বাহাদুরশাহ্র । এরপর ভারতে কোম্পানী শাসনের স্থলে বৃটিশ রাণীর শাসন জারি হয়। বাংলায় শুরু হয় মুসলিম বিরোধি ব্যাপক ধরপাকড়, সেই সাথে পুরো ভারতজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত প্লিন্সলি স্টেটকে বৃটিশ শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হয়। হাজার হাজার সন্দেহভাজন বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেয়া হয়। ভবিষ্যতে জনগনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আশা-আকাঙ্খার যে কোন সম্ভাবনাকে কঠোর হাতে দমন বা নির্মূল করতে ১৮৬১ সালে পুলিশ অ্যাক্ট বাস্তবায়ন করা হয়। বৃটিশ ভারতের এই পুলিশ বাহিনীর সাথে বৃটেনের বা বিশ্বের অন্য কোন দেশের পুলিশ বাহিনীর কোন মিল নেই। পুলিশ জনগনের বন্ধু, মানুষ বিপদে পড়লে পুলিশের দ্বারস্থ হয়, পুলিশও নাগরিকদের যে কোন সমস্যায় অকৃত্রিম বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দেয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগনের নিরাপত্তা ও সহায়তার ক্ষেত্রে পুলিশ একটি বড় মানদন্ড হয়ে উঠলেও বৃটিশ-ভারতে পুলিশ হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থরক্ষার সবেচ বড় হাতিয়ার। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিপালিত পুলিশ বাহিনীকে স্থানীয় জনগনের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃচিশ বিরোধি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বরাজ আদায় করে নেয়ার পর গত সত্তুর বছরে উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে নানা পরিবর্তন সংঘটিত হলেও দেড়শ বছর আগের বৃটিশ ঔপনিবেশিক পুলিশ আইনে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বৃটিশরা যেভাবে পুলিশ বাহিনীকে স্থানীয় জনগনের যে কোন বিক্ষোভ প্রতিবাদ দমনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার উপযোগি করে গড়ে তুলেছিল তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশগুলোর পুলিশ বাহিনী আজো জনগনের স্বার্থের বদলে শাসকশ্রেনীর রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে সম্ভাব্য সব রকম আইনগত নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। গত চারদশকে শুধুমাত্র বাংলাদেশে যত মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিগৃহিত হয়েছে বৃটিশদের শত বছরেও হয়তো তেমন সংখ্যক মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হতাহত বা নিগৃহিত হয়নি। জনগনের ক্ষমতায়ণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। এখন কোন মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়, সরকারের ভেতরে থাকা একশ্রেনীর মানুষের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে রাষ্ট্রদ্রোহিতা । এমন যে কাউকে যে কোন মুহুর্তে আটক করে নিয়ে যাওয়ার অসংখ্য উপায় তাদের হাতে আছে। এ ধরনের বাস্তবতা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক লক্ষ্যের সম্পুর্ণ পরিপন্থী।
রাষ্ট্রশক্তির এই গণবিরোধি অবস্থান পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে। স্থান ও কালের ব্যবধানে উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে রাষ্ট্রশক্তির এই গণবিরোধি অবস্থানে কিছু মাত্রাগত পার্থক্য থাকলেও সাবেক ঔপনিবেশিক অঞ্চলে জনগনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্পিরিট এবং পুঁজিবাদি স্বার্থের দ্বন্দ যেন জনগনের অমোঘ নিয়তি। গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে ওবামা প্রশাসনের সাবেক সিআইএ ডিরেক্টর জন ব্রেনান বলেছেন, নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য অবলিগেশন বা কর্তব্য হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেপরোয়া(আউটরেজাস) অথবা গণতন্ত্র বিরোধি(এন্টি-ডেমোক্রেটিক) আদেশ বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকা। জন ব্রেনানের এই বক্তব্যকে জনপ্রিয় টিভি টকশো উপস্থাপক রাশ লিমবাফ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে( সাইলেন্ট ক্যু) নিরব অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার উস্কানী বলে অভিহিত করেছেন এমনকি এর সাথে ডিপ স্টেট বা সরকারের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকার শক্তির সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন। রাশ লিমবাফ মার্কিন রাজনীতিতে ডিপ স্টেট শক্তির সক্রিয় তৎপরতাকে ২০১৭ সালের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করলেও পলিটিকো ম্যাগাজিনের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মাইকেল কাউলি’র মতে ডিপ স্টেটের তৎপরতা মিশর, আলজেরিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্কের মত দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় রয়েছে। যেখানে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের পর্দার অন্তরালে সামরিক বাহিনীর জেনারেলরাই সর্বময় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই তালিকায় মিয়ানমারের নাম বিষেশভাবে উঠে আসতে পারে, সেখানে অং সান সুচির দল ক্ষমতার নিরঙ্কুশ অবস্থান পাওয়ার পরও সামরিক বাহিনীই রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। এই ডিপ স্টেট সরকারকে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন, বন্ধুহীন করে তোলার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে সামরিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ন করে তোলে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি দিয়ে মিয়ানমারে অং সান সুচির দল ক্ষমতায় আসার পর সেখানকার সেনাবাহিনী রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী বেপরোয়া মারমুখী হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীদের হাতে রোহিঙ্গা গণহত্যা আধুনিক ইতিহাসের সবচে ঘৃন্য নজির হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে যা’ এখন মিয়ানমারকে আবারো একটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের সাথে সাথে যে মিয়ানমারে বিপুল পশ্চিমা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ডিপ স্টেটের অপরিনামদর্শি হস্তক্ষেপের কারণে সে সম্ভাবনা এখন তিরোহিত। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও স্বচ্ছতার বদলে একপাক্ষিক ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে গত এক দশকে বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনাও অনেক পিছিয়ে পড়েছে। দেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এক অদুশ্য বেড়াজালে আটকে আছে। বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশে তাদের কার্গো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দেশের রেমিটেন্স আয়ের প্রধান খাত বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং তৈরী পোশাক রফতানীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি বাতিলসহ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরী হচ্ছে। এখানে ডিপ স্টেটের ভ’মিকা থাক বা না থাক, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের চর্চা এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকল পক্ষের অংশগ্রহণমুলক নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণেই আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, সমাজ প্রগতি ও জননিরাপত্তা চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং পরবর্তি নির্বাচনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¦বধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সম্ভাব্য সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ঝড়ের আশঙ্কা করে কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশকিছু অপিনিয়ন ও বিশ্লেষন প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বাংলাদেশ ইজ ইন দি ভার্জ অব টারময়েল, ‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিঙ্ক,’ ‘বাংলাদেশ মাস্ট বারি হিজ পাস্ট,’ ইত্যাদি শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধগুলো বাংলাদেশের বন্ধু উন্নয়ন সহযোগি রাষ্ট্রগুলোকে বিচলিত করলেও বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জেনে বুঝেই একটি ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে উঠেছিলেন। আজ আমরা যখন আগামী দশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পর্দাপণ করার স্বপ্ন দেখছি তখন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনাগুলো যেন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। তৈরী পোশাক শিল্পের রফতানী প্রবৃদ্ধি চলতি বছর প্রায় শুন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। এরপরও প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতা জিইয়ে রেখেই জাতিকে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল গড়ার স্বন্ন দেখাচ্ছে সরকার। বিগত নির্বাচনের আগে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার জন্য আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা ধরনের তৎপরতা দেখা গেলেও মূলত: ক্ষমতাসীনদের একগুয়েমির কারণে তা’ সম্ভব হয়নি। একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজন ও মতভিন্নতা থাকবেই। সেই বিভাজনকে একটি সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক বৈরিতায় রূপ দেয়ার ধারাবাহিক রাজনৈতিক হঠকারিতার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। পিলখানা ট্রাজেডি, রানা প্লাজা ট্রাজেডি, জঙ্গিবাদি সন্ত্রাস, হলি আর্টিজান সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সঙ্কট পর্যন্ত গত ৫-৭ বছরে প্রতিটি জাতীয় সঙ্কট ও দুর্যোগে প্রধান বিরোধি দলের তরফ থেকে জাতীয় ঐক্যের জন্য আলোচনার আহ্বান জানানো হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা সরাসরি নাকচ করা হয়েছে। সংলাপ, সমঝোতা ও সহাবস্থানের বিভক্তি, অসহিষ্ণুতা ও নির্মূলের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অতীতের ঐতিহাসিক ভুল ও ক্ষতচিহ্নকে নতুন করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। দেশের বেশীরভাগ মানুষ এখনো দারিদ্রসীমার মধ্যে বসবাস করছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, জগনের জীবনমান এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ড তো বটেই আঞ্চলিক প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। অথচ দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ণ, সংঘাত ও বিভাজনের রাজনীতি ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। দেশের উন্নয়ন সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ শ্রম ও ত্যাগের ফসল। বছরের পর বছর ধরে একটি অবিমৃশ্যকারি রাজনীতির ধারায় দেশের বিপুল উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেকটাই নস্যাৎ হয়েছে। এর সুযোগ নিয়েছে প্রতিবেশি প্রতিদ্বন্দি দেশগুলো।
দেশে আবারো একটি নির্বাচনের আবহ তৈরী হয়েছে। আগামী বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সকল দলের অংশগ্রহনমূলক, অবাধ নিরপেক্ষ ও সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিদ করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা আবারো ঘুরে দাড়াতে পারে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতির দেশত্যাগসহ বাংলাদেশের চলমানবাস্তবতা নিয়ে আবারো নানামুখী বিচার বিশ্লেষন চলছে। এ সপ্তাহে ভারতের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ বাংলাদেশে সরকার এবং বিচার বিভাগের মধ্যকার চলমান অবস্থা উপজীব্য করে ‘সুপ্রীম ডিভাইড ইন ঢাকা’ শিরোনামে বিশ্লেষন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সুপ্রীম কোর্টকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বদলে দিতে বাধ্য করতে দেখা গেছে। পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত, কেনিয়ায় সদ্য সমাপ্ত একটি জাতীয় নির্বাচনকে বাতিল করে দেয়ার মত ঘটনার পরও সেখানকার বিচার বিভাগ বা প্রধান বিচারপতিকে এতটা চাপের মুখে পড়তে দেখা যায়নি। সংবিধান সংশোধনী সব দেশেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সব প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনে গঠিত জাতীয় সংসদ ছাড়াও বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য এবং রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন হয়ে থাকে। সুপ্রীমকোর্ট নি:সন্দেহে সংবিধানের অভিভাবক। সংবিধানের সংশোধনী বাতিলকে কেন্দ্র করে দেশে কোন স্থায়ী সুপ্রীম ডিভাইড দেখা দিলে তা’ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তুলতে পারে। সব ধরনের রাজনৈতিক-সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিভক্তি পরিহার করে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌছানো এখন সময়ের দাবী। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল দলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে আলোচনা শুরুর ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই দিয়েছেন। দেশবাসি এখন তার পরবর্তি উদ্যোগ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।