Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিচার বিভাগ-গণতন্ত্রের জন্য এটা সুখকর নয়

এস কে সিনহা ইস্যুতে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত

মালেক মল্লিক : | প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে নানা অয়িমের অভিযোগ ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিবৃতি দেয়া স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়ে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি এবং গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বিচার বিভাগে সম্প্রতি ঘটনা চরম দুঃখজনক ও লজ্জাজনক ঘটনা। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিও একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এটা শুধু বিচার বিভাগের জন্যই সঙ্কট নয়; দেশের জন্য একটি সঙ্কটাপন্ন ঘটনা। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ ধরনের কোনো বিবৃতি দেয়ার রেওয়াজ নেই। কারণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে আরো বেশি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায়ও তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি বা তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এ রকম ব্যবস্থা থেকে বিরত ছিল। কজেই সেটা নজিরবিহীন। তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলতে রাজি নন; তিনি মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন তো প্রধান বিচারপতির এত সব অনিয়মের বিষয় নিয়ে মুখোমুৃখি আগে হয়নি। তাই বিবৃতি আসে না। তবে ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, প্রধান বিচারপতি অসুস্থের কথা অস্বীকার করা ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিবৃতিসহ নানা বিষয়গুলো জনমনে বিভ্রান্তি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এসব বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।
সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, প্রধান বিচারপতির হঠাৎ ছুটি ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিরল বিবৃতিসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা চরম দুঃখজনক ও লজ্জাজনক ঘটনা, যা শুধু বিচার বিভাগের জন্য নয়, সমগ্র জাতি ও দেশের জন্য। তিনি বলেন, একজন প্রধান বিচারপতি অফিস করলেন, আইনজীবীদের চা-চক্রে দাওয়াত দিয়েছেন। এর মধ্যে বলা হলো তিনি অসুস্থ ও ছুটির সংবাদ এলো। এরপর গৃহবন্দী করে রাখা হলো এটা কি উদ্ভ‚ত ব্যাপার নয়। কারণ সরকারের লোকজন দেখা করতে পারেন অর্থাৎ আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক একজন উপদেস্টা দেখা করলেন। আবার আইনজীবীদের (আমাদের) প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হলো না। এটা কোনো কথা হলো?। তিনি আরো বলেন, একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। কারণ তিনি আর কয়েক দিন পর স্বাভাবিকভাবেই অবসরে যাচ্ছেন। প্রধান বিচারপতিকে হেয় করার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। তিনি আরো বলেন, ১১টি অভিযোগ দুদকে যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের কাছে গেল। কি সব আজব ঘটনা। এগুলো মিথ্যা, হাস্যকর অভিযোগ। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, এসব করে সরকারের কি লাভ হলো। আমার মনে হয় সরকারের ক্ষতি হয়েছে। আমি মনে করি, সরকারের মধ্যে ক্ষতি করার জন্য কিছু ব্যক্তি রয়েছে। যারা উল্টাপাল্টা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আইনমন্ত্রী মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেছেন প্রধান বিচারপতি অসুস্থ, যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, এটা নজিরবিহীন ঘটনা আমি বলব না। কারণ এমন অনিয়মের ঘটনা আগে তো কখনো ঘটেনি। তাই বিবৃতি আসেনি। আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যে ১১টি অভিযোগ তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত হওয়া উচিত। শুধু বিবৃতি দিলে হবে না, এ বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু তদন্ত হবে। এরপর মামলা হবে। নাগরিক হিসেবে সবাই সমান। রাষ্ট্রের বড় পদে থাকবে আর অনিয়ম করবে এতে ছাড় পাবে না। এটাই স্বাভাবিক বিষয়। যেমন পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীসহ বড় বড় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অনিয়ম করছেন পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে রায় হয়েছে। ভারতেও হয়েছে। তিনি আরো বলেন, একমাত্র প্রেসিডেন্ট ছাড়া সকল পদের ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন কি না এতে তিনি আরো বলেন, অব্যশই পাবেন। তা না হলে বিচার বিভাগের কার্যক্রম কে চালাবেন। এসব কি বন্ধ থাকবে? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কে শফিক আহমেদ বলেন, যেহেতু এ বিষয়ে রিভিউ হবে। বিষয়টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে আসবে কি না তা আলোচনার বিষয়। সুপ্রিম কোর্টের অপেক্ষা করা উচিত ছিল কি পদ্ধতিতে আইনটি হবে।
এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, প্রেসিডেন্ট যখন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ সম্পর্কে আপিল বিভাগের বর্তমান পাঁচজন বিচারপতিকে দেখিয়েছেন এবং এই অভিযোগগুলো সবই নাকি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে। যদি তা-ই হয়, আমি বুঝতে পারছি না কেন সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় সর্বসম্মত হয়ে থাকলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে বলে আমি মনে করি। আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনীর রায় যত দিন বলবত থাকবে তত দিন এটা সংবিধান সংশোধন হয়েছে বলে গণ্য হবে। এমন একটি ধারণা আমরা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মধ্যেই খুঁজে পাই। কাজেই আমার এই প্রশ্ন বা কৌতূহল রয়েই গেল।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের বিবৃতির বিষয়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমার জানা মতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ ধরনের কোনো বিবৃতি দেয়ার রেওয়াজ নেই। কারণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে আরো বেশি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায়ও তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি বা তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এ রকম ব্যবস্থা থেকে বিরত ছিল। কাজেই সেটা নজিরবিহীন। বর্তমান অবস্থা দেখে আমি শুধু বলব ড়হব ংযড়ঁষফ নব পড়হফবসহবফ ঁহযবধৎফ.
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ইনকিলাবকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সব দায়িত্ব কার্যাবলী সম্পাদন করতে পারে। যেহেতু ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সাধারণত কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের হয়। সেহেতু অতীতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বড় কোনো কাজ বা প্রশাসনিক রদবদলসহ এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতেন। সেই অর্থে শুধু রুটিন মাফিক কাজ এটা প্রথা হয়ে পড়েছিল। এখন সেই প্রচলিত প্রথার কিছুটা হলেও ব্যত্যয় ঘটেছে। তিনি আরো বলেন, প্রধান বিচারপতির অসুস্থতার কথা অস্বীকার ও সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতি ইত্যাদিতে জনমনে বিভ্রান্তি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সর্বোপরি গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয় বলে মন্তব্য করেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, অতীতে সুপ্রিম কোর্টে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি যে, প্রধান বিচারপতির দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এটা কেউ দেখেনি। বিচার বিভাগে যা ঘটছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের মানুষ আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনো কিছুর জন্য এসব মঙ্গলজনক নয়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবকে বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে বর্তমান ঘটনা নিয়ে আমি আইনজীবী হিসেবে নিজেও বিব্রত। শুধুমাত্র প্রধান বিচারপতি নয়, সম্প্রতি যা ঘটে গেল সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জনগণের মনে বিচার বিভাগের ওপর এক ধরনের আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। আমি মনে করি সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষায় কাজ করতে হবে। অন্যথায় নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো হবে। এমনকি দেশের বাইরে আমাদের বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা শূন্যের কোটায় পৌঁছবে। তিনি আরো বলেন, আজ বিচার বিভাগে একটি সঙ্কটাপন্ন অবস্থা বিরাজ করছে।



 

Show all comments
  • মনির ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ৪:০৯ এএম says : 36
    এই বিষয়টি সরকারের বুঝা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Abduz Zaher ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ২:১৭ পিএম says : 28
    একমত।
    Total Reply(0) Reply
  • nazim uddin ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ২:২১ পিএম says : 25
    শুধুমাত্র প্রধান বিচারপতি নয়, সম্প্রতি যা ঘটে গেল সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জনগণের মনে বিচার বিভাগের ওপর এক ধরনের আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
    Total Reply(0) Reply
  • Binay Sarkar ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ২:২৪ পিএম says : 5
    প্রধান বিচারপতির হঠাৎ ছুটি ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিরল বিবৃতিসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা চরম দুঃখজনক ও লজ্জাজনক ঘটনা, যা শুধু বিচার বিভাগের জন্য নয়, সমগ্র জাতি ও দেশের জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Jahangir Alom ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ২:২৫ পিএম says : 0
    সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষায় কাজ করতে হবে। অন্যথায় নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • গোলাম রব্বানী ১৮ অক্টোবর, ২০১৭, ৮:২৮ পিএম says : 0
    যা ঘটতেছে তাতে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লিগেরই খতি হচ্ছে। দলের ভেতর থেকে কেউ আওয়ামী লিগকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধান বিচারপতি

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ