বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এস এম মোশারেফ হোসেন মুশু
আগামী ১৯ মার্চকে সামনে রেখে স্বাধীনতার ঘোষক বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা এবং একদলীয় বাকশাল থেকে গণতন্ত্রের পথে ফেরানোর কারিগর শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলটি শাসকদের শত বাধা আর যড়যন্ত্র পেরিয়ে জাতীয় কাউন্সিলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও একদলীয় শাসকগোষ্ঠী কাউন্সিলের ভেন্যু নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে বিএনপি থেকে অভিযোগ আসছিল যে, শাসকচক্র ভেন্যু পাওয়ার ক্ষেত্রে ভেন্যু নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে অপকৌশলের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করছে, যাতে বিএনপি তার কাক্সিক্ষত ভেন্যুগুলোর কোনোটিই না পায়। শেষ পর্যন্ত শাসকরা আইইবিকে ভেন্যু হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। যদিও আইইবি ব্যবহারের অনুমতি সরকারের থেকে পাওয়ার কথা নয়, পায়ওনি। কিন্তু ভেন্যু দেয়ার পর বিএনপির বাধা দেয়ার অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সরকার বাধা দিলে ভেন্যু পেত না’। তাহলে নিশ্চয়ই এতদিন আইইবি কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে উনারাই ভেন্যু বরাদ্দ আটকিয়ে রেখেছিলেন। আর বিএনপির কাক্সিক্ষত ছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক হল সেটিও সরকারের ইশারায়ই বরাদ্দ পায়নি বলে প্রতীয়মান হয়।
সম্প্রতি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি মূল্যবান ও কঠিন সত্য কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন: ‘ওয়ান ইলেভেন সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের যোগসাজশ ছিল এবং ওয়ান ইলেভেনের চেয়েও এই সরকার জঘন্য খারাপ।’ আমরা বলতে চাই, শুধু যোগসাজশই ছিল না, ওয়ান-ইলেভেনের ভূত এই সরকারের কাঁধে আরও ভয়ংকর রূপে ভর করছে। কারণÑ ১. ওয়ান-ইলেভেনের সরকার বিএনপির ভেতরে সংস্কারপন্থী এবং মূলধারা নামে ভাগ করার চেষ্টা করেছিল। এই সরকারও বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে সেটা জিঁইয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তথাকথিত আসল বিএনপি বানানোর নানা যড়যন্ত্র করছে। দল থেকে বহিষ্কৃৃত একজনকে দিয়ে নানা ধরনের জোট গঠনের চেষ্টা করেছে বা করছে। ২. সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের হোতারা তারেক রহমানকে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করতে চেয়েছিল, দেশনেত্রীকে (খালেদা জিয়া) দেশত্যাগে বাধ্য করতে চেয়েছিল। ৩. বেগম খালেদা জিয়াকে বিশেষ জেলে বন্দী করে রেখেছিল। ৪. এই সরকারও খালেদা জিয়াকে নিষিদ্ধ পিপারস্প্রে প্রয়োগ করে হত্যা করতে চেয়েছিল। তিন মাস গুলশান কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। সরকারের মানসিক নির্যাতনের শিকার আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ যেদিন ঢাকায় এসেছিল সেদিন বিকালে একজন সন্তানহারা মা’কে যাত্রাবাড়ী থানায় যড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা মামলার প্রধান আসামি করে রাতের বেলা সান্ত¦না দিতে গিয়েছিলেন প্রধান শেখ হাসিনা, তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চায় অথবা তাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর যড়যন্ত্র করছে সরকার। তাই খালেদা জিয়া যথার্থই বলেছেন, ‘এই সরকার ওয়ান-ইভেনের চেয়েও জঘন্য খারাপ’।
গত ৬ মার্চ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়াইরত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন এবং কালে কালে জাতীয়তাবাদের জন্য নির্যাতিত-নিপীড়িতদের প্রতীক তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। পরের দিন ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই আসামিকে বিএনপির চেয়ারপারসন এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নাটক ইত্যাদি। একেক টেলিভিশন বা পত্রিকায় একেকরকম শিরোনাম করেছে। তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, বিগত দিনে আপনি যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রধান হয়েছিলেন বা ভবিষ্যতে যদি এরকম হয় এটাও কি নাটক বলে ধরে নেব? নাকি আপনার বেলায় সেটা প্রযোজ্য হবে না? নাকি আসন্ন কাউন্সিলে নামকাওয়াস্তে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করাবেন! যতটুকু বিশ্বাস সে সামান্য ঝুঁকিটুকুও নিতে চাইবেন না। আপনার ভুলে গেলে চলবে না যে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় আপনি কতগুলো মামলার আসামি ছিলেন। আপনার কথা দ্বারা আপনি প্রমাণ করতে চান যে, ওই সময় জনগণ একজন আসামিকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। যদিও ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন চলমান। যদি আপনি জনগণকে মনে করিয়ে দিতে চান যে, জনগণ ২০০৮ সালে বহু মামলার একজন আসামিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে বা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে তাহলে আপনি প্রকারান্তরে জনগণকে অপমান করলেন। আর যদি আপনি বলতে চান যে, আপনার বিরুদ্ধে যে মামলা ছিল সেগুলো মিথ্যা, বানোয়াট ও সাজানো ছিল তাহলে জনগণও এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আপনার ভাই শেখ সেলিম সাহেব জবানবন্দী দেওয়া সত্ত্বেও যদি আপনার মামলাগুলো সাজানো হয় তাহলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো শুধু মিথ্যা, সাজানো ও যড়যন্ত্রমূলকই নয়, কাল্পনিকও বটে।
আবার একটু কাউন্সিলের দিকে আসি। ঘুরেফিরে ও পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, কাউন্সিলের প্রস্তুতি বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছে। ব্যবস্থাপনা কমিটি, আপ্যায়ন কমিটি, সেবা ও শৃঙ্খলা কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করছে। পাশাপাশি প্রকাশনা কমিটি, প্রচার কমিটি, অর্থ কমিটি তাদের কার্যক্রম জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে ঘিরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। সারাদেশ থেকে নেতা-কর্মীরা খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিভিন্ন উপ-কমিটিতে নিজেদের পছন্দের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করার একটা প্রতিযোগিতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু এতে কাউন্সিলের শৃঙ্খলা ও ভাবমর্যাদা রক্ষায় প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে দলের পদ-পদবি, বিশ্বস্ততা, ত্যাগ, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির ছোটখাটো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টন করা যেতে পারে।
কাউন্সিল নিয়ে সরকার সর্বশেষ যে পরিকল্পনা হাতে রেখেছে বলে আমাদের বিশ্বাস সেটা এরকম হতে পারে যে, রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সময় কাউন্সিলরদের বক্তৃতার মাধ্যমে মূলধারা এবং সংস্কারপন্থী হিসেবে ভাগ করার চেষ্টা হতে পারে। আমাদের বক্তব্য হলোÑবক্তব্যে ক্ষোভ, বেদনা, দল গোছানো, ত্যাগীদের মূল্যায়ন, নির্যাতন-নিপীড়ন, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা এবং কর্মকর্তাদের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। এটা সংগঠনকে গোছাতে দেশনেত্রীকে ভালো ধারণা দেবে বলে বিশ্বাস। কিন্তু শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা বা ব্যক্তি আক্রোশ থেকে আক্রমণ করা, অথবা এই সরকারকে বাদ দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গকে বড় করে বারবার টেনে আনা দলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ছোট্ট একটা বিষয় লিখে শেষ করি। বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারের বর্ষপূর্তির শুরুতে যে আন্দোলন হয়েছিল ওই আন্দোলনের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হওয়ার পর একদিন সন্ধ্যাবেলা প্রেস কনফারেন্স করতে হবে। প্রথমে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে ফোন করা হলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে আরেকজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অসুস্থ বলে জানালেন। এমনিভাবে চতুর্থ নম্বরে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যানের বাসায় গেলেন একজন সহ-দফতর সম্পাদক, যুবদলের একজন কেন্দ্রীয় সদস্যসহ তিনজন। ওই ভাইস চেয়ারম্যানকে বললেন প্রেস ব্রিফিং করতে পারবেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেনÑ ম্যাডাম বলেছেন? তারা উত্তর দিল হ্যাঁ। ওই নেতা বললেন, পারব না মানে? একটু বসো, নামাজটা পড়ে নিই। তারা একসঙ্গে নামাজ আদায় করে প্রেসক্লাবে এলেন। খালেদা জিয়ার নির্দেশ মতো দলের প্রেস ব্রিফিং করলেন। ততক্ষণে প্রেসক্লাবের সম্মুখে গোয়েন্দা পুলিশের বিশাল বহর হাজির। পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভেতরে গিয়ে ওই নেতাকে বললেনÑ স্যার, আপনি পেছনের গেট দিয়ে চলে যান। অন্যথায় আপনাকে গ্রেফতার করার আদেশ রয়েছে। নেতা বললেন : ‘আমি চোর নাকি? যে পেছনের গেট দিয়ে চলে যাব। আমি শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপির প্রেস ব্রিফিং করতে এসেছি। আমি প্রধান গেট দিয়েই বের হব।’ বের হলেন এবং গ্রেফতার হলেন, কারাবরণ করলেন। ওই দিন গ্রেফতার না হয়ে তিনি পালিয়ে গেলে সরকার বলতে পারত যে বিএনপি নেতারা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছে। ফলে সারাদেশে কর্মীদের মনোবল দুর্বল হতে পারত। যার কথা বলছিলাম তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারপন্থীদের অন্যতম ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনে গুম হওয়ার ভয় ছিল না, তথাপি সংস্কারপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান আমলে গুম হওয়ার ভয় ছিল বিশেষ করে ওই আন্দোলনের সময়। তরপরও খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো প্রেসক্লাবে এসে প্রেস ব্রিফিং করেছেন। এখন কি তাকে তিরস্কৃত করবেন নাকি পুরস্কৃত করবেন? তাই বলছিলাম যে, রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সময় নিজেরা কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে বরং গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে পুরস্কার-তিরস্কারের গুরুদায়িত্ব দেশ-মাতৃকার জন্য নির্যাতিত এবং নির্যাতিতদের মাতা- মা, মাটি ও মানুষের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওপর অর্পণ করাই শ্রেয়।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।