ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
দেশের বস্ত্রশিল্প বড় সঙ্কটের মধ্য দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প ও বস্ত্রখাতের বিকাশের ফলে ধীরে ধীরে দেশ উন্নতির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্পখাত।
প্রায় ৪০ লক্ষের অধিক শ্রমিক, কর্মকর্তা তৈরি পোশাকসহ বস্ত্রখাতে কাজে নিয়োজিত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে তৈরি পোশাক শিল্প তথা বস্ত্রখাতের বিকাশ অনেকটা থেমে গেছে। নানা সমস্যায় শিল্পবিকাশ ধীর গতিতে চলছে। জ্বালানি সঙ্কটই প্রধান কারণ। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাস না পাওয়ার কারণে শিল্প বিকাশ প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও শিল্পবিকাশে বাধার সৃষ্টি করছে। সুশাসন শিল্পবিকাশের প্রধানতম বিষয়। দেশে পরিপূর্ণ সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারার কারণে শিল্প স্থাপনের হার অতি কম।
দুই বছর আগে প্রকারভেদে এক কেজি সুতার গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২ ডলার ৬০ সেন্ট। গত বছর সেপ্টেম্বরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে ব্যয় বেড়ে হয় ২ ডলার ৮৫ সেন্ট। চলতি বছরে গত মার্চ এবং জুনে দাম বাড়ানোর পর উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ ডলার ৩০ সেন্ট। তৈরি পোশাক উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে সুতা ব্যবহার হয়ে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মাত্র ১ সেন্টের ব্যবধানই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন ক্রেতারা। এই দরের কারণে চাহিদা কমেছে দেশি বস্ত্রের। ভালুকায় অবস্থিত মেট্রো স্পিনিং মিলে এ পর্যন্ত অবিক্রীত সুতার পরিমাণ ৯০০ টন। মিলের এমডি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, গোডাউনে বিশাল পরিমাণ সুতা নিয়ে বিপদে আছেন তিনি। তার হিসাবে এই পরিমাণ সুতার মূল্য বাবদ ৩০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। জ্বালানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বস্ত্রখাতের সংকট আরও বেড়েছে। সুতা ও বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্রে জানা গেছে, সমিতির সদস্য প্রায় সব স্পিনিং কারখানায় বিপুল পরিমাণ সুতা অবিক্রীত পড়ে আছে। দেশে বর্তমানে স্পিনিং মিলের সংখ্যা ৮৩০। ফেব্রিক্স কারখানা ৭৯৪ ও ডায়িং কারখানার সংখ্যা ২৪১। এসব কারখানার প্রধান জ্বালানি হচ্ছে গ্যাস।
উদ্যোক্তারা শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ক্যাপটিভ পাওয়ারে গত দুই বছরে তিন দফায় গ্যাসের মূল্য ২২২ শতাংশ বাড়ানোর ফলে বছরে গড়ে ২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে মিলগুলোকে। তারপরও নতুন ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। গ্যাসের সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। এলএনজির দাম কত নির্ধারণ করা হবে তা এখনও জানা যায়নি। শোনা যাচ্ছে, বর্তমান দামের দ্বিগুণ করা হবে। এ হারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বস্ত্রকলগুলো নির্ঘাত বন্ধ হয়ে যাবে। বড় আকারের স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং ও প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলে তুলা আর গ্যাসই শেষ কথা। একটি বস্ত্রকলের ২৫ শতাংশই বিনিয়োগ হয় গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ পাওয়ারে। সর্বশেষ দাম বাড়ানোর ফলে ক্যাপটিভে গ্যাসের দর এখন ঘনমিটার প্রতি ৯ টাকা ৬২ পয়সা। এতে কারখানাগুলোকে অতিরিক্ত ২২ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। বস্ত্রখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকও সংকটে পড়বে। পোশাকের কাঁচামালের দেশি উৎস বন্ধ হয়ে গেলে তুলা, সুতা এবং কাপড়ের দর বাড়িয়ে দিলে পোশাক খাতও প্রতিযোগিতামূলক দর থেকে ছিটকে পড়বে। গত প্রায় দুই দশকে পোশাক খাতের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প শক্তিশালী হয়েছে। তবে গত বছর বস্ত্র ও পোশাক খাতের সহযোগিতায় প্রণোদনা বাড়িয়ে আরও ছয় হাজার কোটি রুপি অনুমোদন করেছে আমাদের প্রতিবেশী ভারত। নিজস্ব তুুলাসহ অন্যান্য কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি মিলিয়ে ভারত শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্থানীয় সুতার কাপড়ের দর বেশি হওয়ায় পোশাক ক্রেতারা কম দামের ভারতীয় সুতা ব্যবহার করতে বলছেন। এতে মার খাচ্ছে দেশের বস্ত্র কারখানাগুলো। রফতানিমুখী তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল সুতা এবং কাপড়ের মোট চাহিদার বড় একটা সরবরাহ করে থাকে বস্ত্রকলগুলো। রফতানিমুখী পোশাকের বাইরে দেশি শাড়ি, লুঙ্গি এবং অন্য সব কাপড়ের যোগান দিচ্ছে দেশি বস্ত্রকলগুলো। এ ছাড়া কিছু পরিমাণে সুতা এবং কাপড় সরাসরি রফতানি হয়ে থাকে।
গ্যাস সংকটের আপাতত একটা বিকল্প হতে পারে ফার্নেস অয়েল। কিন্তু বিদ্যমান দরে সেটা সম্ভব নয়। লিটার প্রতি ফার্নেস অয়েলের দাম এখন ৪২ টাকা। সরকার যদি শিল্প পরিচালনার জন্য শুল্কমুক্ত ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেয় তাহলে আপাতত একটা সমাধান হতে পারে। বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশে ফার্নেস অয়েলসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম বেশি করে রাখা হচ্ছে। দুই দশক আগে শিল্প কারখানা অন্যান্য কাঁচামালের মতো ফার্নেস অয়েলও শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি সুবিধা পেত। জানা গেছে, বিষয়গুলো বিস্তারিত উল্লেখ করে স¤প্রতি জ্বালানিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিটিএমএ নেতারা। তার আগে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে আপাতত শুল্কমুক্ত ফার্নেস অয়েল আমদানির সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।
এখন যা প্রয়োজন :
১. দেশে তৈরি পোশাকশিল্প তথা বস্ত্রখাতের উন্নয়নের স্বার্থে আর কোনভাবে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য বদ্ধি করা উচিত নয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কম মূল্যে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ সরকারকে নিশ্চিত করা উচিত। বস্ত্রখাত সক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তৈরি পোশাকশিল্পও সঙ্কটে পড়বে।
২. অবিলম্বে শিল্পে বিশেষ করে বস্ত্রখাতে শুল্কমুক্ত ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেয়া উচিত। তখন ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বস্ত্রশিল্প স্থাপন করা যাবে। যেহেতু সরকার গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না, তাই ফার্নেস অয়েল শুল্কমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
৩. রাজনৈতিক বিবেচনায় না নিয়ে শিল্পের গুণাগুণ বিবেচনায় শিল্পখাতে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ দেয়া উচিত। এখনও অনেক শিল্প গ্যাসের অভাবে স¤প্রসারণে যেতে পারছে না। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হলে, বস্ত্রশিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। নতুন নতুন অনেক শিল্প স্থাপিত হবে। তাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। বেকারত্বের হার থেকে আমরা মুক্তি পাবো। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথও সহজ হবে।
৪. রাজনৈতিক সহঅবস্থান, স্থিতিশীলতা, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রধানতম শর্ত। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক বাহ্যিক স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার রাজনৈতিক শান্তি বিরাজমান হচ্ছে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দৃশ্যমান করতে হবে। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদেরকে রাজনৈতিক অন্ধ গলি থেকে বের করে আনতে পারে। দেশে দৃশ্যমান, শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। সংসদে আছে নামে মাত্র বিরোধী দল। দেশের গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল কাঠামোর উপর নির্ভরশীল বলে আমাদের মর্যাদা, অবস্থান ও পরিচিতি সঙ্কটে পড়ে রয়েছে। এই অবস্থার উন্নতি করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে গড়ে তোলার পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। বস্ত্রশিল্প দেশের শিল্পের মূল ভিত্তি। তাই মূল ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।