পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সীমান্ত ঘুরে এসে এস এম আলী আহসান পান্না
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে রাতের বেলায় ধুমসে চলছে চোরাচালান। বাংলাদেশ থেকে স্রোতের মত যাচ্ছে সোনার বার, ইয়াবা ও মৌসুমী ফসল; আবার ভারত থেকেও পাল্টা স্রোতের বেগে আসছে নানা ধরনের অস্ত্র, মাদক ও যৌন ক্ষমতাবর্ধক ওষুধ। এ চোরাচালানের ভয়াবহ ব্যাপকতা স্থানীয় দেশপ্রেমিক জনগণকে অত্যন্ত শংকিত করে তুলেছে। চোরাচালানের সাথে জড়িতরা এত ক্ষমতাশালী যে, তারা কারোরই তোয়াক্কা করে না। অনেকেই বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের কিছু লোকের পৃষ্ঠপোষকতায় চোরাচালানের রমরমা কারবার চলছে। তাই বিজিবি বা পুলিশ চোরাচালান প্রতিরোধে কার্যকর কিছু করতে পারছে না। সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
গোটা কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে শুধু পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত দৌলতপুর উপজেলার সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলার সীমান্ত রয়েছে। দৌলতপুর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে পদ্মা নদী তীরবর্তী চিলমারির চর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে কাজিপুর পর্যন্ত সীমান্ত রেখার বিস্তৃতি ৫৩ কিমি। এর মধ্যে ২৮ কিমি জুড়ে ভারতীয় অংশে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। বাকি ২৫ কিমি কাঁটাতারের বেড়াহীন অংশ দিয়ে চলে চোরাচালান।
মজার বিষয় হচ্ছে, দিনের বেলায় চোরাচালান হয় না বললেই চলে। সীমান্ত ঘুরে কোথাও দিনের আলোতে চোরাচালানের তৎপরতা দেখা যায়নি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারাদিন সীমান্ত এলাকায় প্রায় সুনসান নীরবতা থাকে। হঠাৎ হয়ত কাউকে সীমান্তের ওপার থেকে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসতে দেখা যায়। কিন্তু রাত হলেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। গোটা এলাকা হয়ে ওঠে জমজমাট। আনাগোনা শুরু হয় অগুণতি ভ্যান, সাইকেল ও মোটর সাইকেলের। উল্লেখ্য, সীমান্ত জুড়ে ৫-৬ কিমি পরপরই রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবি’র সীমান্ত চৌকি। ওপারে রয়েছে বিএসএফ। দু’দিকের সীমান্ত রক্ষীদের অবস্থান ও টহল সম্পর্কে সব খোঁজ-খবর নিয়েই নির্বিঘেœ চোরাচালান চলে।
বলা দরকার, আগে ভারত থেকে আসত প্রধানত শাড়ি, পোশাক ও প্রসাধন সামগ্রী। এখনো তা আসছে। সাম্প্রতিক কালে চোরাচালান পণ্যের চাহিদায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে আসছে অস্ত্র, মাদক ও স্বর্ণালংকার। চলতি বছরে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটাতে ভারত থেকে আসছে পিস্তল, রিভলবার, ভারতে তৈরি রাইফেল, কাটা রাইফেল, পাইপগান, ভারতের লেদ মেশিনে তৈরি ছোট ছোট অস্ত্র। আর মাদক দ্রব্যের মধ্যে আসছে হেরোইন, ফেনসিডিল, ভারতীয় মদ, গাঁজা ইত্যাদি। সে সাথে আসছে তথাকথিত যৌন ক্ষমতা বর্ধক বিভিন্ন ওষুধ ও উপকরণ। আরো আসছে সোনার বার থেকে তৈরি করা স্বর্ণালংকার। অস্ত্র ও মাদক এপারে আসার পর দৌলতপুরে মজুত করে পরে চাহিদামত দেশের নানা স্থানে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছে সোনার বার। এটাই চোরাচালানের প্রধান ও সর্বাপেক্ষা লাভজনক পণ্য। সে সাথে যায় ইয়াবা এবং বিভিন্ন মৌসুমী কৃষিপণ্য। সোনার বার আসে ঢাকা থেকে। জানা গেছে, ঢাকা থেকে সোনার বার সরাসরি দৌলতপুর পাঠানো হয় না। সেগুলো বিভিন্ন যানবাহনে প্রথমে কুষ্টিয়া শহরে এনে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়। সেখান থেকে ভেড়ামারা ও দৌলতপুরের নিরাপদ স্থানে পাঠানো হয়। দৌলতপুর থেকে সময়-সুযোগ বুঝে এ সব সোনা ও ইয়াবা সাইকেল ও মোটর সাইকেল যোগে সীমান্তে নিয়ে সংশ্লিষ্ট লোকজনের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মোটর সাইকেলই বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি মোটর সাইকেলে থাকে তিনজন। চালক ছাড়া বাকি দু’জন চোরাচালানের কাজ করে। চালক ভাড়া বাবদ সন্তোষজনক পরিমাণ অর্থ পায়। ফলে, এ কাজে মোটর সাইকেলের কোনো অভাব হয় না। জানা যায়, চোরাচালান কাজে ব্যবহৃত মোটর সাইকেলের অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই। ফলে সেগুলো কখনো আটক হলেও মালিক পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য, ইয়াবা আসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে। আর মৌসুমী ফসলের মধ্যে বর্তমানে পাচার করা হচ্ছে কালাই ও মুগ। পশ্চিমবঙ্গে এগুলোর বিপুল চাহিদা রয়েছে। জানা যায়, শতাধিক লোক বাহক হিসেবে এ পাচার কাজে জড়িত রয়েছে। তারা প্রতি ট্রিপে ন্যূনতম এক হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে।
দৌলতপুরের বিপরীতে ভারতের করিমপুর ও জলাঙ্গি থানা এলাকা অবস্থিত। দু’থানার বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিল তৈরির কারখানা রয়েছে। তারা প্রকাশ্যেই ফেনসিডিল উৎপাদন করে ও বাংলাদেশে পাঠায়। বাংলাদেশের চোরাচালানিরা ভারত সীমান্তে পৌঁছে। ওদিকে আগে থেকে নির্দিষ্ট স্থানে ওপারের চোরাচালানিরা মালামাল নিয়ে আসে। তারপর দু’পক্ষে বিনিময় ঘটে। জানা যায়, কাঁটাতারের বেড়া বিহীন অংশের চর চিলমারি, আশ্রয়ন, উদয়নগর, জামালপুর, ঠোটারপাড়া, শেওড়াতলা, ধর্মদহ, বিলকাঠুয়া ও কাজিপুর দিয়ে চোরাচালান চলে। এপার থেকে যে সব সোনার বার যায় সেগুলো থেকে নানা ধরনের স্বর্ণালংকার তৈরি করে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিক্রির জন্য আবার এ দেশে পাঠায়। এতে তারা বিপুল লাভ করে। তাই তারা অনেক সময় বাংলাদেশের চোরাচালানিদের বিপুল পরিমাণ টাকার মালামাল বাকি দিতেও দ্বিধা করে না।
রাতের অন্ধকারে এই চোরাচালান চলছে বাধাহীন ভাবে। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশকে এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নিতে দেখা যায় না বলে স্থানীয়রা জানান। তারা চোরাচালানের ব্যাপকতায় উদ্বিগ্ন। কারণ, এতে সরকার যে শুধু রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাই নয়, দেশের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। ভারত থেকে আসা অবৈধ অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গিয়ে অপরাধ বাড়ছে। বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনে এ সব অবৈধ অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে সহিংসতা বৃদ্ধি করছে। অন্যদিকে হেরোইনসহ ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা তরুণ সমাজকে ভয়াবহ নেশাগ্রস্ততার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে তারা ভীষণ শংকিত। উল্লেখ্য, চোরাচালানকে বরাবরই একটি ঘৃণ্য, বেআইনি কাজ বলে গণ্য করা হয়। তবে অপরাধীরা ইদানিং একে আর ঘৃণ্য কাজ বলে মনে করে না। তারা এখন এর নাম দিয়েছে ব্যবসা। কেউ কিছু বললে তারা বলে, আমরা পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছি।
কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকা বিজিবির ৪৭ ব্যাটালিয়নের আওতাধীন। জেলার ৫৩ কিমি সীমান্ত প্রহরার জন্য বিজিবির সর্বমোট ক্যাম্প (বিওপি) আছে ১৫টি। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিজিবি’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলেন, আমাদের লোকবল কম। রাস্তাঘাটও ভালো নয়, যানবাহনও অপর্যাপ্ত। অন্যদিকে আমাদের তুলনায় বিএসএফের ক্যাম্পের সংখ্যা তিনগুণ বেশি। তাদের দিকে রাস্তাঘাট বেশ ভালো। তাদের পর্যাপ্ত যানবাহনও আছে। ওপারে কড়াকড়ি করা হলে চোরাচালান কমত। অন্যদিকে চোরাচালানের সাথে যারা যুক্ত তারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশীর্বাদপুষ্ট। দিনে নিশ্চুপ থাকলেও রাতের আঁধারে তারা জোরেশোরে চোরাচালান করে। তাদের নেটওয়ার্ক এত শক্তিশালী যে তাদের ধরা যায় না বললেই চলে। মাঝে মধ্যে দু’একজন ধরা পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আদালতে পাঠানো হয়।
ব্যাপক চোরাচালানের কারণে সাধারণ মানুষ প্রচ- ক্ষুব্ধ। সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভ এ কারণে যে ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগ) কোনো কোনো প্রভাবশালীর পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে এতে। রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের এক মসজিদের ইমাম আবদুর রাজ্জাক বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগসাজশে রাতের অন্ধকারে চোরাচালান চলছে। সবই হচ্ছে পয়সার বিনিময়ে। সাহেবনগর ইউনিয়নের চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ও বিজিবি’র এক শ্রেণির লোকের সহায়তায় চোরাচালান চলে। আবার ওপারে বিএসএফের সাথেও চোরাচালানিদের যোগাযোগ আছে। কাঠ ব্যবসায়ী আবদুল জলিল বলেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ইন্ধন, বিজিবি-পুলিশের সহায়তা ছাড়া এ রূপ অবাধে চোরাচালান চলতে পারে না।
চোরাচালানের ব্যাপকতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের একাংশের সহ-সভাপতি বলেন, যদি আওয়ামী লীগের নেতারা চোরাচালানের গডফাদার হয়ে থাকে তাহলে তাদের ধরা হোক ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। চোরাচালানিদের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তদবির করা হবে না।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবলীগের এক জাঁদরেল নেতা বলেন, দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে। আওয়ামী লীগের এক অংশ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশের আইন মোতাবেক চোরাচালানিদের গ্রেফতার ও বিচার করা হোক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।