Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চরম অব্যবস্থাপনায় বেসরকারি আইসিডি

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অদক্ষতা হয়রানি যন্ত্রপাতির অভাব : আমূল সংস্কারে নেই অফডক নীতিমালা : ২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম বন্দর সচলে সহায়ক নয়
২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও কাস্টম হাউস সচল রাখা হয়েছে। তবে বন্দর-কাস্টমস-শিপিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ের অভাব, সমস্যা-সঙ্কট কাটেনি। এ কারণে সরকারের এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সমস্যা বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোসমূহ (আইসিডি) তথা অফডক খাতের চরম অব্যবস্থাপনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিগত ১ আগস্ট থেকে সার্বক্ষণিক (২৪/৭) চট্টগ্রাম বন্দর সচল করা হয়। তবে বেসরকারি আইসিডিসমূহ সমান গতিতে এগিয়ে যেতে পারছে না। আইসিডিসমূহে কন্টেইনার জটের বিরূপ প্রভাব পড়ছে বন্দরের পণ্যজট ও জাহাজজটে। সমগ্র অফডক ব্যবস্থাপনাকে যুগোপযোগী আমূল সংস্কার করে ঢেলে সাজানোর জন্য আমদানি-রফতানিকারক ও শিল্পেদ্যোক্তারা তাগিদ দিয়েই আসছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। অদক্ষতা, হয়রানি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে বেসরকারি আইসিডিসমূহ গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে পারছে না। আইসিডি তথা অফডক পরিচালনায় নেই কোন সুষ্ঠু নীতিমালা। এরফলে ২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস সচলে সহায়ক বা পরিপূরক হয়ে উঠতে পারেনি বেসরকারি আইসিডি খাত।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরভিত্তিক আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী উঠানামা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কন্টেইনারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ। গত অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয় ২৪ লাখ টিইইউএস’রও বেশি। দেশের মোট আমদানি-রফতানি প্রবাহের ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। একই সাথে বন্দর-শিপিং-কাস্টমস নির্ভর বেসরকারি স্থল কন্টেইনার ডিপোসমূহ (আইসিডি) বা অফডক খাতের উপর চাপ ও এর চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাহিদার সমানুপাতে যন্ত্রপাতি ও দক্ষতার অভাবে আমদানি-রফতানি পণ্যের চাপ সামাল দিতে গিয়ে বেসরকারি আইসিডিসমূহ হিমশিম খাচ্ছে। এই খাতে ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে। অথচ চরম অব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি আইসিডি অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মের ডিপোতে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে কার্যত নির্বিকার।
আইসিডিগুলোতে প্রতিদিন শত কোটি টাকা মূল্যের শিল্প কাঁচামাল, শিল্পের যন্ত্রপাতি, ভোগ্য ও সেবাপণ্য হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। অথচ আধুনিক যুগোপযোগী ও সুদক্ষ ব্যবস্থাপনায় কোন নীতিমালা আজও হয়নি। এসব কারণে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোসমূহেরর (আইসিডি) অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, হয়রানি ও বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলেছে। আমদানি ও রফতানিকারক, ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগের শেষ নেই। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে মহানগরীতে ও বাইরে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আইসিডিসমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের অভাব প্রকট। অফডক খাতে কার্যত নেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। এতে করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে আইসিডিসমূহের কর্মকান্ড। চট্টগ্রাম মহানগরীর জনবহুল ও কর্মব্যস্ত বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বেসরকারি আইসিডিসমূহকে অন্যত্র সুবিধাজনক স্থানে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অনেক আগেই। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। আইসিডিসমূহের চরম অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় বন্দর ব্যবহারকারী, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগের কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না। অসৎ কর্তাব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করেই চলছে আইসিডির অনিয়ম, অদক্ষতা, হয়রানি ও অব্যবস্থাপনা। সঠিক সময়ে শিল্পের কাঁচামাল খালাসে গড়িমসি, হ্যান্ডলিং চার্জ যথেচ্ছহারে উসুলসহ বিভিন্ন অভিযোগ অনেক আইসিডির বিরুদ্ধে। কিন্তু মিলছে না অভিযোগের সুরাহা।
আমদানি-রফতানি কন্টেইনারবাহী হরেক ধরনের পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং ও মজুদ করছে বেসরকারি আইসিডিসমূহ। শিপিং বাণিজ্যের চাহিদা ও চাপ যতই বাড়ছে আইসিডিতে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কর্মব্যস্ততাও সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনে তুলনামূলক ব্যয় আকাশ-সড়ক বা রেলপথের চেয়ে অনেক কম। পৃথিবীর সব আধুনিক বন্দরে বর্তমান সময়ে বন্দরের সংরক্ষিত বা অপারেশনাল এলাকার ভেতরে কন্টেইনার খোলা-বাঁধা, মজুদ (স্টাফিং-আনস্টাফিং, স্টেকিং) করা হয় না। এর বিকল্পই হচ্ছে বেসরকারি আইসিডি বা অফডক।
বেসরকারি আইসিডির চাহিদা বাড়লেও সমন্বিত নীতিমালার অভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু অফডক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। আইসিডিসমূহে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, মজুদ-স্টেকিং ও পরিবহনের উপযোগী ভারী, মাঝারি ও হালকা যান্ত্রিক সরঞ্জামের অভাব প্রকট। আবার কোন কোন আইসডিকে ঘিরে সুকৌশলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা সন্নিকটে থাকায় বন্দরনগরী, শহরতলী, কাছাকাছি সীতাকুন্ডে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোসমূহ (আইসিডি) গড়ে উঠেছে। যার সংখ্যা ১৮টি। এসব আইসিডির যান্ত্রিক ও অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা তেমন বৃদ্ধি পায়নি। অফডক পরিচালনায় পদে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব প্রকট। আইসিডিতে বিরাজ করছে সমস্যা-সঙ্কটের বহর। এসব কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
গত আগস্ট মাস থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর সার্বক্ষণিক (২৪/৭) সচল কার্যকরের প্রাক্কালে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বন্দর-কাস্টমস ব্যবহারকারীদের এক যৌথসভায় বেসরকারি আইসিডিসমূহের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতায় তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ ব্যক্ত করা হয়েছিল। এসব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা অবিলম্বে দূরীকরণের তাগিদ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশনা ও শর্ত পরিপূরণ করছেন না আইসিডি মালিকরা। জনবহুল এলাকায় যেনতেন প্রকারে আইসিডি স্থাপন করে নিত্যদিন যানজটসহ নানামুখী জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বেসরকারি আইসিডি তথা অফডককে একটি শিল্পখাত হিসেবে বিকাশিত করতে সার্বিক গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা তৈরির কথা বলে আসছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও আমদানি-রফতানিকারকরা। আইসিডি খাতে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। রফতানিমুখী প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য এবং গার্মেন্টস শিল্পোদ্যোক্তারা অফডক সুবিধার দিকে বেশি হারে আকৃষ্ট হচ্ছেন। তবে খাতটি বন্দরের গতি ও দক্ষতার উন্নতিতে যতটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়ে গেছে তা এখনও হয়নি। বেসরকারি আইসিডিতে জটের প্রভাব পড়ছে বন্দরেও। বছরের অধিকাংশ সময়েই বন্দরে কন্টেইনার ও পণ্যজট তার কারণ। সমস্যা-সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা কাটানো গেলে বেসরকারি আইসিডি খাত দেশে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়ে গেছে। এ খাতে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
বেসরকারি আইসিডিসমূহে বিভিন্ন ধরনের ভারী, মাঝারি ও হালকা ব্যবহার্য যান্ত্রিক সাজ-সরঞ্জামের (ইকুইপমেন্ট) চাহিদার তুলনায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে ব্যবহৃত অধিকাংশ যন্ত্রপাতি সেকেলে, অকেজো, লক্কর-ঝক্কর ও বিকল। কন্টেইনার ওঠানামা, স্থানান্তর, মজুদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ার, রীচ স্টেকার, ফর্ক লিফট, স্প্রেডার, ফর্ক, কন্টেইনার মুভার, এম্পটি হ্যান্ডলার, টার্মিনাল ট্রাক্টর, ট্রেইলর, মোবাইল ক্রেন, লগ হ্যান্ডলার, লো-মাস্ট ফর্ক লিফট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাক্টর, হেভি ট্রেইলর ও লাইট ট্রেইলর রয়েছে আইসডিসমূহে অপর্যাপ্ত সংখ্যক। এরফলে কন্টেইনারবাহী পণ্যসামগ্রী উঠানামায় সময় ও খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিণতিতে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ ও বাজারে পণ্যমূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ভোক্তা সাধারণকেই।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইসিডি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ