Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

গ্রিড লাইন ও সাব স্টেশনে ত্রুটি : গ্যাস সংকটে বন্ধ ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র

চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে চরম জনদুর্ভোগ

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামে অসহনীয় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। এরমধ্যে গতকাল (বুধবার) দুই দফা গ্রিড লাইন ও সাব স্টেশন বিকল হয়ে যাওয়ায় বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় নেমে আসে। প্রথম দফায় বেলা ১টায় হাটহাজারী গ্রিড লাইনে ত্রুটি দেখা দিলে পুরো চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সেটি সচল হতেই বিকেল ৫টায় হাটহাজারী গ্রিড সাব স্টেশনের ব্রেকার বিগড়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয় সমগ্র চট্টগ্রামে। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বন্দরনগরীর বেশিরভাগ এলাকা ছিল বিদ্যুৎবিহীন। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে চরম জনদুর্ভোগ নেমে আসে। হাসপাতালসহ জরুরী সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাহাকার শুরু হয়। অন্ধকারে ডুবে থাকে পুরো নগরী।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, বিকেলে সার্কিট ব্রেকার বিকল হয়ে গেলে আড়াই ঘণ্টার বেশি পুরো চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় হাটহাজারী গ্রিড সাব স্টেশনের ব্রেকার নষ্ট হয়ে গেলে পুরো চট্টগ্রাম বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে বলে জানান পিডিবি চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান। এর আগে বেলা পৌনে একটায় হাটহাজারী-কাপ্তাই ও হাটহাজারী-ফেনী সঞ্চালন লাইনে কারিগরী ত্রুটির ফলে পুরো চট্টগ্রামে পৌনে একঘন্টা বিদ্যুৎ ছিল না। পরবর্তীতে দেড়টায় ত্রুটি সারনোর পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
এরমধ্যে বিকালে হাটহাজারী গ্রিড সাবস্টেশনের ব্রেকার নষ্ট হয়ে ফের বিদ্যুৎ চলে যায়। সন্ধ্যা ৭টার পর ত্রুটি সারিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হলেও বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। হাটহাজারী-কাপ্তাই ও হাটহাজারী-ফেনী জাতীয় গ্রিড লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রামে। এছাড়া হাটহাজারী গ্রিড সাব স্টেশনে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ কারণে দুর্ঘটনার পর পুরো চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার দাশ গ্রিড সাবস্টেশনের ব্রেকার নষ্ট হবার কথা স্বীকার করে বলেন, সন্ধ্যা সাতটার পর থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলগুলোতে কল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা স্থবির হয়ে গেছে। বিঘিœত হচ্ছে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। বিদ্যুৎ সংকটে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে শতভাগ রফতানিমুখি তৈরী পোশাক খাত। গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে সার্বিক বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখন ফের লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবি’র কর্মকর্তারা এতদিন লোডশেডিংয়ের কথা স্বীকারও করতে না। এখন সরকারী ভাবেই চট্টগ্রামে গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে আড়াইশ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। যদিও বাস্তবে বিদ্যুৎ সংকট আরও বেশি।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে ৬৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪টি ইউনিট বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ সংকট চরমে উঠেছে চট্টগ্রামে এখন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় সোয়া ১১শ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ মিলছে ৮শ মেগাওয়াটের মত। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে রাতে দিনে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। রাতে-দিনে চাহিদা প্রায় সমান থাকলেও রাতের তুলনায় দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে করে দিনের বেলায় বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তার উপর রয়েছে সঞ্চালন ব্যবস্থায় ত্রুটি। এরফলে ক্ষণে ক্ষণে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
রাতে-দিনে বিরাট একটা সময় বিদ্যুৎ না থাকায় লোকজনকে অসহনীয় দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়। অফিস আদালত, ব্যাক-বীমায় স্বাভাকি কার্যক্রম বিঘিœত হয়। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেশ কয়েকটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলেও এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট পুরোপুরি কাটেনি। পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বিশেষ করে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মাসের পর মাস বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এই কারণে নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলেও তার সুফল মিলছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ফার্নেস অয়েল নির্ভর কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়। তবে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় শুধু সন্ধ্যায় মাত্র পিক আওয়ারে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হচ্ছে। এতে করে দিনের বেলায়ও বিদ্যুৎ সংকট থেকে যাচ্ছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান গ্যাসের অভাবে রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট বন্ধ। একই কারণে বন্ধ শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। একই এলাকায় ১৫০ মেগাওয়াট গ্যাস চালিত আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনও বন্ধ রয়েছে। এতে করে এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। পিডিবির হিসাবে মঙ্গলবার পিক আওয়ারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে ৭৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া গেছে। ওই দিন বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১১শ’ ৭২ মেগাওয়াট। বাকিটা লোডশেডিং করা হয়েছে।
পিডিবির প্রকৌশলীরা জানান, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ মহাপ্রকল্পের চারটি ইউনিট সচল আছে। চারটি ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ ১৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া মালঞ্চ থেকে ২৬ মেগাওয়াট, বারাকা পতেঙ্গা থেকে ২০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা থেকে ১৭৬ মেগাওয়াট, রাউজানের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৬ মেগাওয়াট. শিকলবাহার একটি কেন্দ্র থেকে ৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যায়। নতুন চালু হওয়ায় তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে জুলদা থেকে ৬৮ মেগাওয়াট, হাটহাজারী থেকে ৬৯ মেগাওয়াট আর দোহাজারী থেকে সর্বোচ্চ ১০১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।
বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য দিনে দিনে বাড়ছে। এতে করে বাড়ছে লোডশেডিংও। এছাড়া সঞ্চালন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ক্রটির কারণে অনেক এলাকায় ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি এখন দারুন বিরুপ আচরণ করছে। শরতেও পড়ছে তীব্রগরম। এই গরমের মধ্যে রাতে-দিনে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া খেলায় জনজীবন দুর্বিসহ। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা করতে গিয়ে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। ব্যাক-বীমা অফিস-আদালত সবকিছু ডিজিট্যাল হওয় যাওয়া বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ অঞ্চলের চালু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।
সরকারের মন্ত্রী নেতারা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার শ্লোগান দিচ্ছে। টানা দুই মেয়াদে প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। এতদিনেও বিদ্যুৎ সংকটের অবসান না হওয়ায় হতাশ সাধারণ মানুষ। একদিকে বিদ্যুৎ সংকট, তার উপর ভ‚য়া ও ভুতুরে বিদ্যুৎ বিলের যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ট। আবার এরমধ্যে চলছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড়। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ

১৪ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ