দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফলত তিনি ইসলামী নীতিমালার আলোকে এর উপযুক্ত সমাধান ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রচেষ্টা করছে। ড. হাসান ফিলানী বলেন, “কোন ব্যক্তির উপর এমন কোন অবস্থা আপতিত হওয়া যাতে ঐ ব্যক্তি এ বিষয়ের শরঈ বিধান জানার জন্য যে ব্যক্তি তা অবগত করাতে পারেন তার শরণাপন্ন হন। তাই উক্ত বিষয় ইবাদত বা লেনদেন বা আচরণ বা চারিত্রিক যে বিষয়েই সংশ্লিষ্ট হোক না কেন। অতএব সা¤প্রতিক বিষয় বলতে এমন নতুন বিষয়কে বুঝায় যার বিধানের ব্যাপারে শরীআতে সরাসরি কোন নস বর্ণিত হয়নি এবং সর্বসম্মত কোন ইজতিহাদ হয়নি।
সা¤প্রতিক বিষয় ও এ সংক্রান্ত ইসলামী বিধান বুঝাতে আরবী কিছু পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। এ সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ পরিভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাওয়াদিস শব্দটি ‘হাদীসাহ’ এর বহুবচন। নতুন কিছু ঘটাকে ‘হাদাসা’ বলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিসাহ অর্থ-নতুন বিষয়। এ জন্য বছরের শুরুতে নতুন বৃষ্টিকে হাদিসাহ বলে।
আন-নাওয়াযিল: এ শব্দটিও বহুবচন, একবচন ‘নাযিলাহ’। এর অর্থ বর্ণনায় আল-জাওহারী বলেন, সময়ের কোন কষ্টকর বিষয় বা জনসাধারণের উপর পতিত হয়। এ সংক্রান্ত ফিকহকে বলা হয় ‘ফিকহুন নাওয়াযিল’। আল-অকায়িঈ শব্দটি ‘অকিয়াহ’ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ ঘটনা। লিসানুল আরব গ্রন্থকারের মতে, দুর্যোগ ও সময়ের দুর্বিপাক বুঝানোর জন্যও আকিয়াহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ শব্দের সাথে সম্পৃক্ত করে এ সংক্রান্ত ফিকহকে বলা হয় ‘ফিকহুল অকিই’। মুসতাজিদ্দাহ : শব্দটি ‘জুদুদ’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ-নতুন। আর মুসতাজিদ্দাহ অর্থ- সা¤প্রতিক, সর্বশেষ অবস্থা, নতুন নতুন অবস্থা। আর এ সংক্রান্ত ফিকহকে বলা হয় ‘ফিকহুল-মুসতাজিদ্দাহ’।
কাদায় মুআসিরাহ: কাদায়া শব্দটি ‘কাদিয়াহ’ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ অমীমাংসিত বিষয়। যে অমীমাংসিত বিষয় ফয়সালার জন্য কাযী বা বিচারকের সম্মুখে পেশ করা হয় তাকে কাদিয়াহ বা মামলা বলা হয়। আর মুআসিরাহ শব্দটি ‘আসর’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সমসাময়িক, সমকালীন। অতএব কাদায়া মুআসিরাহ অর্থ সমকালীন অমীমাংসিত বিষয়। ফিকহের সাথে সম্পৃক্ত করে একে বলা হয় ‘কাদায়া মুআসিরাহ ‘ফিকহিয়্যাহ’। যেসব সা¤প্রতিক বিষয়ের শরঈ বিধান নির্মিত হয়নি সেসব বিষয়কে বুঝাতে বর্তমানে এই পরিভাষাটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন কারণে সা¤প্রতিক বিষয়কসমূহের ইসলামী বিধান নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে এর মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচিত হল- ইসলামের গতিশীলতা ও পূর্ণতা প্রমাণ করা: ইসলামী একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এ পূর্ণতার ঘোষণা এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিআমত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে নির্ধারিত করলাম।” একই সাথে এ ব্যবস্থা শাশ্বত ও গতিশীল। কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত প্রতিটি মানুষ স্থান, কাল, পাত্র ও পরিস্থিতি ভেদে যে অবস্থার মুখোমুখী হোক না কেন সে ক্ষেত্রে ইসলামের একটি নির্দেশনা থাকতে হবেই। নতুবা এটি হয়তো অপূর্ণাঙ্গ হিসেবে চিহিৃত হবে অথবা যুগের উৎকর্ষতার বিপরীতের এটি অনুপযোগী হিসেবে প্রমাণিত হবে। অতএব নির্ধারিত নীতিমালার ভিত্তিতে সা¤প্রতিক বিষয়সমূহের বিধান নির্ণয়ের মাধ্যমে একদিকে ইসলামের গতিশীলতা ও পূর্ণতা প্রমাণ করা ও অন্যদিকে ইসলাম বিরোধী শক্তি যারা আধুনিক যুগে ইসলামের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাদের প্রতিউত্তর দান করা সম্ভব হয়।
মুসলিম উম্মাহ’র কষ্ট লাঘব করা : এমন অনেক নতুন বিষয় সৃষ্টি হয় যার বিধান নির্ণিত না থাকার কারণে মুসলিম উম্মাহ কষ্টের সম্মুখীন হন। আবার দেখা যায় অমুসলিমরা নিত্যনতুন আবিস্কারের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে অতিক্রম করে, যা তাদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাড়ায়। তাদের এ কষ্ট দূর করার জন্য ঐসব বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয় করার কোন বিকল্প নেই। যদি উক্ত বিষয় বৈধ হয় তাহলে মুসলমানগণ তা গ্রহণ করতে পারবেন। আর অবৈধ হলে এর বিকল্প পদ্ধতি আবিস্কার করার প্রতি সচেষ্ট হবেন এবং উক্ত অবৈধ পদ্ধতি বর্জন করবেন।
ইজতিহাদের ধারা চলমান রাখা: ইজতিহাদ তথা ইসলামী বিধান উদ্ভাবনের গবেষণা একদল মানুষের জন্য অপরিহার্য। মহান আল্লাহ বলেন, “তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে”। ইজতিহাদের মূল উদ্দেশ্যই হয়ে থাকে নতুন নতুন বিষয় গবেষণা করে এর বিধান উদ্ভাবন করা। যাকে আমরা ‘ইস্তিখরাজ, ‘ইস্তিম্বাত’ ইত্যাদি নামে চিনি। অতএব এ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে ইজতিহাদের ধারা চলমান রাখা জরুরী।
সা¤প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান উদ্ভাবনে ক্ষেত্রে করণীয়সমূহ থেকে এখানে আমরা চারটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় নিয়ে আলোচনা করব। সেগুলো হলো- ১. বিধান নির্ণয়ের পূর্বে করণীয় ২. বিধান উদ্ভাবনের সময় করণীয় ৩. শরীআহ অভিযোজন (ঝযধৎরয অফধঢ়ঃধঃরড়হ) ৪. সম্মিলিত গবেষণা (এৎড়ঁঢ় ওলঃরযধফ)
বিধান নির্ণয়ের পূর্বে করণীয়: সা¤প্রতিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের পূর্বে সংশ্লিষ্ট গবেষকের যেসব করণীয় রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ঘটনার বাস্তবতা নিশ্চিত হওয়া: অবাস্তব বিষয় সম্পর্কে ইসলামের বিধান তলব ও প্রদান করা সালফে সালিহীন অপছন্দ করতেন। ইবনে উমর রা. এর নিকট এক ব্যক্তি এসে কোন এক বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যে বিষয়ের কোন বাস্তবতা নেই সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। কেননা আমি উমর ইবনুল খাত্তাব কর্তৃক ঐ ব্যক্তিকে অভিশাপ দিতে শুনেছি যে ব্যক্তি অবাস্তব বিষয়ে প্রশ্ন করে।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা.-এর সাহাবীগণের চেয়ে উত্তম মানবগোষ্ঠী আমি দেখিনী। তাঁরা তাঁর কাছে তেরটি প্রশ্ন ছাড়া কোন কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আর এর সবগুলোই কুরআনে বিধৃত হয়েছে। তাঁদের উপকারে আসত এমন বিষয় ছাড়া তাঁরা অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতেন না। বিষয়টি বিশ্লেষণযোগ্য হওয়া: গবেষককে দৃষ্টি দিতে হবে উদ্ভূত পরিস্থিতি আদৌ বিশ্লেষণের যোগ্য কি না? কেননা এমন অনেক বিষয় আছে যাতে মানুষের দ্বীন- দুনিয়ার কোন কল্যাণ নেই। অযথা এর পিছনে সময় ও মেধা খরচ করা উচিত নয়। যদি কেউ কোন আলিম বা মুফতীকে বিপদে ফেলানোর জন্য বা তাকে অসম্মান করার জন্য অথবা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইসলামের বিধান জানতে চায় তবে তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কেননা মহানবী সা. কুটিল প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে যেসব বিষয়ে শরীয়তের নস রয়েছে সেসব বিষয়ে ইজতিহাদ না করা। কেননা ফিকহী মূলনীতি হল, “নস থাকলে সেখানে ইজতিহাদের অনুমতি নেই।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।