Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধীরে কমছে চালের দাম

| প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ব্যবসায়ীদের বোঝাতে হবে শুধু মুনাফার চেষ্টা না করে সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে নজর রেখে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
হাসান সোহেল : সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে চালের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে খুব ধীরগতিতে কমার কারণে এখনো বাজারে স্বস্তি ফিরেনি। কেজি প্রতি ১০/১২টাকা দাম বাড়লেও পাইকারী বাজারে মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ৩/৪টাকা কমছে। তবে খুচরা বাজারে এখনও এর খুব প্রভাব পড়েনি। কোথাও কোথাও মোটা চালে কেজিপ্রতি দু-তিন টাকা কমলেও অধিকাংশ বাজারে এখনও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে চিকন চাল। গত পনের বিশদিনে রেকর্ড পরিমান চাল আমদানি করলেও বাজারে এর প্রভাব নেই। চাল আমদানির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ছাড়িয়েছে বিগত দুই বছরের চাল আমদানির রেকর্ড। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ধান না ওঠা পর্যন্ত চালের দাম কমার কোনো সুযোগ নেই। কারণ চাহিদা থাকলেও চালের মজুদ তেমন নেই। এছাড়া এলসির (ঋণপত্র) চালও বাজারে আসতে সময় লাগছে। এদিকে খোলাবাজারে চাল বিক্রির কার্যক্রমেও (ওএমএস) আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সাধারণ আয়ের মানুষ। কারণ সরকার আতপ চাল বিক্রি করছে। ফলে ওএমএস’র উদ্যোগও ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিদিনের চাল কিনতেই নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। তাদের প্রশ্ন, খুচরা বাজারে চালের দামে স্বস্তি কবে ফিরে আসবে? চাল নিয়ে চালবাজি কবে বন্ধ হবে?
‘সরকারের দূরদর্শিতার অভাবে চালের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে’ বলে মনে করেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, জুন মাসেই দেখা গেছে সরকারের নিজস্ব স্টক (মজুদ)। এরপর বন্যার আভাস তো আগে থেকেই ছিল। বন্যায় যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখনও সরকার থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পরে সরকার আমদানিতে গেছে। আমদানির কিছু কন্ট্রাক (চুক্তি) হয়েছে। বেসরকারি খাতেও আমদানি শুল্ক সরকার সময়মতো কমায়নি। একদিকে সরবরাহ সমস্যা, অন্যদিকে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে দাম বেড়ে গেছে।
চালের দাম কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব আমদানির চুক্তি হয়েছে, সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেলিভারি (সরবরাহ) নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি থাকলে দাম বাড়াটা স্বাভাবিক, তবে ব্যবসায়ীদের বোঝাতে হবে শুধু মুনাফার চেষ্টা না করে সামাজিক দায়বদ্ধতার নিকে নজর রেখে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
সূত্র মতে, দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরবর্তী সময়ে চালের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ে। রোহিঙ্গাদের আগমনে সেই চালের বাজারে আগুন লাগে। দীর্ঘদিন থেকেই চালের বাজার বাড়তির দিকে ছিলো। কিন্তু গত কোরবানীর ঈদের পর মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছিল কেজিপ্রতি ১০ টাকা। এরপর সরকারের নানা উদ্যোগে বাজারে মোটা চালের দাম কিছুটা কমতে শুরু করে। তবে চিকন চালের দাম আগের মতোই। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, শিগগিরই আগের দামে ফিরে আসবে চাল। চাল মিল মালিকদের এবং পাইকারী ব্যবসায়ীদের সাথে বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের বৈঠক হয়। সরকারের পক্ষ থেকেও ব্যবসায়ীদের দাবী দাওয়া মানা হয়। ব্যবসায়ীরা খুব শিগগিরই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু তা কথাতেই সীমাবদ্ধ।
কোরবানীর ঈদের আগেও বাজারে গরিবের মোটা চালের দাম ছিল ৪২/৪৩ টাকা। কিন্তু ঈদের পর তা বেড়ে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা হয়। সরকার অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে সরকার দৃষ্টি দেয় আন্তর্জাতিক বাজারে। সেখানেও বিভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত থেকে ‘সরকার থেকে সরকার’ (জি টু জি) পর্যায়ে চাল আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ নিলেও ব্যর্থ হয় সরকার। একই পরিণতি হয় থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রেও। চাল মজুদ নিয়ে সঙ্কটের অন্যতম কারণ এটি বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এদিকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য নিয়ে ভিয়েতনামে গেলেও চুক্তি হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টনের। আর মিয়ানমারেও ১০ লাখ টন চাল কিনতে চেয়ে আশ্বাস পাওয়া গেছে তিন লাখ টনের। তবে মিয়ানমার ৪৪২ মার্কিন ডলার দরে এক লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। যা এখনো দেশে আসেনি বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ছাড়িয়েছে বিগত দুই বছরের চাল আমদানির রেকর্ড। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতসহ বিভিন্ন দেশে থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই ও আগস্ট মাসে আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৩১ মেট্রিক টন। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ২লাখ ২৯ হাজার ৬৪৫ দশমিক ৭৩ মেট্রিক টন ও ২০১৫-১৬’তে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৬০ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছিল।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন জানান, প্রতিদিন বেসরকারি ভাবে প্রচুর পরিমান চাল আমদানি হচ্ছে। আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়ার পর থেকেই বিদেশ থেকে চাল আমদানি হচ্ছে অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই বিগত দুই বছরের চাল আমদানির পরিমানকে ছাড়িয়েছে। যে হারে চাল আমদানি হচ্ছে তাতে চলতি বছরে চাল আমদানির পরিমাণ আরো বেশি হবে। বেসরকারিভাবে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে এসব চাল আমদানি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারত থেকেই চাল আমদানি হচ্ছে বেশি। চট্টগ্রাম বন্দর, ভোমরা ও বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে চাল আমদানি হয়ে আসছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ সেপ্টেম্বর মোটা চালের দাম ছিলো সর্বোচ্চ ৫২টাকা। যা গতকাল ৬ অক্টোবর ছিলো ৫০টাকা। মোটা চালে ২টাকা কমলেও টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ৬ অক্টোবর নাজিরশাইল/মিনিকেট (উন্নত মানের) দাম ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারী মানের চাল ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা, পাইজাম সাধারণ মানের ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা এবং পাইজাম উন্নত মানের ৫৬ থেকে ৫৮টাকা বিক্রি হয়েছে। অথচ গত সপ্তাহেও একই দামে বিক্রি হয়েছে এই চাল। তাই অধিক চাল আমদানির পরও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি বলেও টিসিবি’র পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে মোটা চালের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু সে তুলনায় সরু চালের দাম কমেনি। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চাল কেজিতে দাম কমেছে দু-তিন টাকা। তবে অন্যান্য চালে কেজিতে দাম কমেছে মাত্র এক-দুই টাকা। তাও আবার পাইকারী বাজারে। যার প্রভাব নেই খুচরা বাজারে।
পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা মোটা চাল মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ২১০০ থেকে ২৩০০ টাকায়। খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি এ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬-৪৮ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হক বলেন, কয়েকদিন ধরে মোটা চালের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু খুব বেশি নয়, এখনও বাজার সেভাবে স্বাভাবিক হয়নি। দাম বাড়ছে না, কমছেও না।
পাইকারী বাজারে ৫০ কেজির ভালোমানের মিনিকেট চাল বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩১০০-৩২০০ টাকায়। নাজিরশাইল ৩৫০০-৩৬০০ টাকা, বিআর আটাশ ২৭০০-২৯০০ ও পাইজাম ২৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত তিনদিনে এসব চালের বস্তায় গড়ে ১০০ টাকা কমেছে।
মিরপুর শেখ রাইস এজেন্সি’র মো. হারুন শেখ বলেন, পাইকারি দোকানগুলো দাম কাঙ্খিত হারে কমাচ্ছে না। তারা প্রচুর চাল মজুদ করে রেখেছে। প্রতি বস্তা চালে তারা ৫০০-৭০০ টাকা লাভ পেয়েও বিক্রি করছে না।
কারওয়ানবাজারের ‘চাটখিল রাইচ এজেন্সি’র স্বত্বাধিকারী নাঈম বলেন, ভারত থেকে মোটা চাল বা স্বর্ণা চালের আমদানি ভালোই হচ্ছে। তবে আমদানি অনুসারে দাম কমেনি। সহসা দাম কমবে বলেও মনে হয় না। ‘তবে নতুন ধান বাজারে উঠলে দাম কমবে এটা নিশ্চিত। এর আগে সেভাবে দাম কমার কোনো সুযোগ নেই’- যোগ করেন তিনি। বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা ও পাইকারি বাজারে মিনিকেট চালের দাম কমে কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৬৮ টাকায়। খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা ফারুক হোসাইন বলেন, মিনিকেট প্রতি কেজি ৫৮ টাকায় বিক্রির কথা শুনে কিনতে আসি। কিন্তু এসে দেখি ৬৫-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগের দামেই তো কিনতে হচ্ছে। চালের দামে এখনও স্বস্তি ফিরে আসেনি। কবে আসবে, আল্লাহই ভালো জানেন। ‘ঈদের আগে ভালো চাল আরও কম দামে কিনেছিলাম। এভাবে চলতে থাকলে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে’- যোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনাসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। আর আমদানির ক্ষেত্রে তুলে দেয়া হয় সীমারেখা। ফলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো পরিমাণ চাল আমদানি করতে পারবেন। এছাড়া পাটের বস্তার যে বাধ্যবাধকতা ছিল তাও উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল আমদানির সুযোগ পান ব্যবসায়ীরা। এছাড়া রেলে চাল পরিবহনের সুবিধা এবং অভিযানের নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানিও বন্ধ করা হয়েছে। সরকারের দেয়া এসব সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রæতি দেন, আগামী দু-চারদিনের মধ্যে দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সেই প্রতিশ্রæতির কোনো প্রতিফলন বাজারে নেই।



 

Show all comments
  • লাবনী ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ৪:৪০ পিএম says : 0
    প্রসাশনকে এব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল

১১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ