Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডিজিটাল চুরি বড় পরিবর্তন

নৈতিক দায় স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউরের পদত্যাগ

প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৬ পিএম, ১৫ মার্চ, ২০১৬

হাসান সোহেল : ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের বিরাট অঙ্কের অর্থ চুরির ঘটনায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। চাপের মুখে ব্যর্থতার নৈতিক দায় স্বীকার করে গভর্নর পদ থেকে সরে গেছেন ড. আতিউর রহমান। দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নজিরবিহীন পরিবর্তনের পর রাতে অর্থমন্ত্রী গণভবনে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। সূত্রের দাবি, চুরির অর্থ উদ্ধার তদন্তের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরো পরিবর্তন আনা হবে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার-খ্যাত বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবিরকে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সোমবার সকালে সচিবালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। তার বক্তব্যের পরদিনই এই পরিবর্তন এলো। এত বড় রিজার্ভ চুরির ঘটনা বাংলাদেশ তথা বিশ্বে যেমন নজিরবিহীন, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে এক দিনে এত ব্যাপক রদবদলও নজিরবিহীন। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঘটনার নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনার আশঙ্কা থেকে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি এবং গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগ ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। সবার দৃষ্টি ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে। ভারত থেকে দেশে ফিরে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আতিউর রহমানের দেখা না করা নিয়েও ছিল বিতর্ক। অবশেষে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ব্যর্থতায় নৈতিক দায় স্বীকার করে গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। তিনি সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি দাবি করেন তার পদত্যাগে প্রধানমন্ত্রী চোখের পানি ফেলেছেন।
এদিকে, রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনা তদন্তে সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনা এক মাস পর জানানোর দায়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বিদায়ী গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এই পদত্যাগকে সাহসী সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার প্রেস সচিব জানান, দেশের উন্নয়নে বিদায়ী গভর্নরের অবদানও অনেক। আর এ ঘটনা ব্যাংকিং সেক্টরকে নতুন করে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে দাবি করে আতিউর রহমান বলেন, গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে আমি পুরোপুরি সফল হয়েছি। রিজার্ভ বাড়িয়েছি রেকর্ড পরিমাণ। তার মতে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখন অনেকেই মডেল হিসেবে দেখে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ আলম লেলিন আগেই গভর্নরের পদত্যাগ করার আহ্বান জানালেও অনেকটা দেরিতে হলেও মুখ খুলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনাকে অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেন তিনি। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো জায়গায় কিভাবে এ ঘটনা ঘটল তা খতিয়ে দেখা হবে। এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, এর পিছনে কি কি ত্রুটি আছে তা খুঁজে বের করা হবে। এদিকে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেছেন, দ্রত সময়ের মধ্যে রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ, ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল রাজশাহী কলেজ মাঠে এক অনুষ্ঠান শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মানি লন্ডারিং এবং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনে কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, পদত্যাগ এবং অব্যাহতি প্রাথমিক একটি পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু এটাই সমাধান নয়। লুট হওয়া টাকা ফেরত আনা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির বিষয়টি প্রাথমিকভাবে চেপে রাখায় ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়ার এক দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এদিকে অর্থমন্ত্রী ঘোষিত পূর্বনির্ধারিত সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকালের সংবাদ সম্মেলন দুই দফায় সময় পিছিয়ে পড়ে বাতিল করা হয়। একই সঙ্গে গত সোমবার রাতেই পূর্বনির্ধারিত জরুরি বোর্ড সভাও স্থগিত করা হয়।
বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি যাওয়ার পর ঘটনা গোপন রেখে গভর্নর আতিউর রহমান ভারত সফরে যান। এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। সোমবার বিকেলে আতিউর রহমান ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর আগেই গুঞ্জন ছিল তার স্থলে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রীও আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনায় অসন্তুষ্ট ছিলেন ড. আতিউরের ওপর। ভারত থেকে দেশে ফিরলেও সচিবালয়ে গভর্নরের জন্য অপেক্ষায় থাকা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করেই আতিউর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাননি। পরে সকালে সাংবাদিকদের ডেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা জানান। সকাল ১১টায় ড. আতিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। গভর্নরের পদত্যাগ এবং নতুন গভর্নর নিয়ে আগের দিনের মতো গতকাল সকালও আলোচনায় ছিল। আতিউর রহমানের গুলশানের বাসা, বাংলাদেশ ব্যাংক, সচিবালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিল গণমাধ্যমের কর্মীদের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় পদত্যাগী আতিউর রহমান বলেন, গত সোমবার বিকেলে তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। রাতে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন। অর্থমন্ত্রী তাকে বলেছেন, তিনি চলে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো চলবে। তিনি আরও বলেন, আমি আমার বিবেক দ্বারা চালিত হই। মনে করি, প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি না বললে আমার পদত্যাগ করা উচিত হবে না। সাত বছর দায়িত্ব পালন করেছি, বাংলাদেশ ব্যাংককে সন্তানের মতো মনে করেছি। রিজার্ভ থেকে চুরি হোক, এটা আমি কখনো চাইনি।
এরপর বেলা সোয়া ১১টার দিকে আতিউর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য কাছে তার কার্যালয়ে যান। তিনি তার পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। বেলা সোয়া একটার দিকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চলে যান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। বলেন, বিকেলে গুলশানের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করবেন।
এর মধ্যেই দুপুরে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, সাবেক সচিব ফজলে কবিরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। ১৮ মার্চ তার দেশে ফেরার কথা। দেশে ফেরার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তিনি এ পদে নিয়োগ পাবেন। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস। অপর সদস্য হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। কমিটিকে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিকেল তিনটার দিকে গুলশানের বাসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেছেন, নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। বিবেক, দেশপ্রেম ও সাধারণ মানুষের প্রতি আনুগত্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা করেছি। এটি আমার সন্তানের মতো। এখানে কাজ করার সময় অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে, তবে সেগুলোকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক স্থিতিশীল। তিনি জানান, ফিরে যেতে চান পুরনো পেশা শিক্ষকতায়। বলেন, অর্থমন্ত্রী একজন বয়স্ক মানুষ। আগামীতে তরুণদের কথা মাথায় রেখেই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে আতিউর বলেন, আমি যা করেছি সব দেশের স্বার্থেই করেছি। আমি ব্যক্তিস্বার্থে কোনো কিছু করিনি। আমি এজন্য বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম যে, রিজার্ভে যা রয়েছে সেগুলো রক্ষা করতে হবে। আর হ্যাকাররা প্রথমেই জানতে পারলে সতর্ক হয়ে যাবে। হয়তো যে টাকাটা ফেরত পেয়েছি তা পাওয়াও সম্ভব হতো না। তিনি বলেন, আমার সন্তানের চেয়েও এ সম্পদকে বেশি ভালোবাসি। ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে না জানানোর জন্য যদি আমার ভুল হয়ে থাকে তাহলে এ ভুলের জন্য আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাই।
আতিউর রহমান বলেন, তিনি যখন দায়িত্ব নেন তখন রিজার্ভ ছিল ছয় বিলিয়ন ডলার। আর এখন সেই রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলারের ওপর। দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতার জন্য তিনি বারবার কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি দাবি করেন, পদত্যাগপত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি মর্মাহত হন। তারপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সৎ সাহসের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনার পর ব্যাংকটির গভর্নর ড. আতিউর রহমানের ভারত সফর নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে আতিউর জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই ভারত সফর গিয়েছিলেন। আমার ভারত সফর নিয়ে কথা উঠেছে। অর্থমন্ত্রীরও ভারত যাওয়ার কথা ছিল। তিনি যেতে পারেননি। আমি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই ভারত সফরে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে আমি রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির বিষয়ে বিভিন্ন দেশের গভর্নরদের সঙ্গে কথা বলেছি।
রয়ে গেছে গুঞ্জন
রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির দায় নিয়ে গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করলেও নেপথ্যের নায়করা ঠিকই থেকে যাচ্ছেন আড়ালে। অর্থ চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট দুটি বিভাগের দায়িত্বে থাকা দুই ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দিলেও চুরির ঘটনা আড়াল করতে এছাড়াও যারা গভর্নরকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা স্বপদে রয়ে গেছেন। অব্যাহতি পাওয়া ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ দেখতেন। অপরদিকে ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা সরাসরি আইটি বিভাগ দেখতেন। অব্যাহতি পাওয়া দুই ডেপুটি গভর্নর পদে শিগগিরই নতুন নিয়োগ হবে বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
ব্যাংকিং সাফল্য!
গভর্নর হিসেবে সফল এবং মাটির সন্তান হিসেবে আতিউর রহমান নিজেকে দায়িত্বশীল দাবি করলেও টানা ৭ বছর দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও শক্তভাবে ব্যাংকিং খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। বিশিষ্টজনরা বলছেন, ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনীতির বড় উপাদান। এখানে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ শক্ত হাতে করতে হবে। গভর্নরের দরজা উন্মুক্ত থাকতে নেই। তাহলে লুটপাট, অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। যেটি গত ৭ বছরে বেশ কয়েকবার সামনে এসেছে। তার দায়িত্বকালীন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি, যুবক, ডেসটিনিসহ নানা ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক খাত কেটেছে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। ব্যাংক খাতের ওপর বিগত ৭ বছরে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক নেতৃত্ব ও গোষ্ঠীগত প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। এসময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনসহ সব ধরনের ব্যাংকের সুশাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে। তাদের মতে, ব্যাংকগুলো অধিক মাত্রায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা শক্ত হাতে আটকাতে পারেনি। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থতা, যার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করা। তবে বর্তমানে তাতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষি, এসএমই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছে। ফলে জনবল সংকট এবং সার্বিক সক্ষমতায় তদারকিতে এগিয়ে আসতে পারেনি। তিনি বলেন, সময়ের সাথে নতুন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনিয়ম এবং দুর্নীতির ধরন পাল্টেছে। আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সফল হতে পারেনি।
সূত্রমতে, ড. আতিউর রহমানের মেয়াদে ব্যাংকের পরিচালকের পদ শূন্য হওয়া, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয় টানাপোড়েন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ছিল সামগ্রিক অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দুটি মূলনীতি হচ্ছে Ñ স্থিতিশীল মুদ্রানীতি পরিচালনা ও ব্যাংক খাতের ওপর তদারকি-নজরদারির ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান গভর্নরের মেয়াদে এসব ক্ষেত্রে তেমন অর্জন চোখে পড়েনি। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আইন ভেঙে শেয়ারবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কাজে ব্যাংকগুলোকে যথাসময়ে নিবৃত্ত করতে পারেনি, বরং নির্লিপ্ত থেকেছে। অনেকে অভিযোগ করে বলছেন, মূল দায়িত্বের দিকে খেয়াল ছিল না গভর্নরের। এসময় তিনি মানবিক ব্যাংক আর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির নামে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর একাধিকবার নানা অনুষ্ঠানে জানান, আমি ব্যাংকিং সেবা অধিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করছি।
এদিকে নতুন ব্যাংক স্থাপনের সম্পূর্ণ আইনি কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকলেও সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ একমত না হলেও সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়। যার প্রেক্ষিতে ৯টি নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংককে অনুমোদন দিতে হয়েছে। এসব ব্যাংকের পরিচালনায় মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য বা নেতারা রয়েছেন। এখানেও চাপ সামাল দিতে পারেননি আতিউর রহমান।
থানায় মামলা
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মানি লন্ডারিং এবং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনে কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল আড়াইটায় মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা। মামলা নং ১০। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মতিঝিল থানার ওসি মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মানি লন্ডারিংয়ের ৪ ধারা এবং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইন-২০০৬-এর ৫৪ ধারা এবং দ-বিধির ৩৭৯ ধারায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এখনো দায়েরকৃত মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়নি।
ফিলিপাইনের ব্যাংক কর্মকর্তা অভিযুক্ত
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ ফিলিপাইনে স্থানান্তরের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন সেখানকার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের শাখা ব্যবস্থাপক। দেশটির সিনেট তাকে অভিযুক্ত করে। এখন চলছে তার শুনানি। এদিকে, এই জালিয়াতিতে সরাসরি জড়িত দেশটির ব্যবসায়ী কিম উং হংকংয়ের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন সপ্তাহখানেক আগেই। গতকাল এমন খবর দিয়েছে ফিলিপাইনের গণমাধ্যম ইনকোয়ারার।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থচুরির ঘটনায় তোলপাড় চলছে ফিলিপাইনেও। কারণ, চুরি হওয়া ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার হয় ফিলিপাইনে। দেশটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন, আরসিবিসির ৬টি হিসাবের মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তর হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার নাম আসে দুটি প্রতিষ্ঠানেরও। আর এ নিয়ে ফিলিপাইন সিনেটে শুরু হয় শুনানি। শুনানিতে উপস্থিত থাকেন আরসিবিসির প্রধান এবং ব্যাংকটির মাকিতা সিটির জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্টরা। এসময় নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো। জাল করে বিদেশি অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্তও হন তিনি।
এদিকে ফিলিপাইনে গণমধ্যম ইনকোয়ারার জানিয়েছে, বাংলাদেশ অর্থ চুরির ঘটনায় যে ৬ জন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের মধ্য থেকে ব্যবসায়ী কিম অং ফিলিপাইন ত্যাগ করেছেন। হংকংয়ের উদ্দেশে তিনি ফিলিপাইন ছাড়েন অর্থ চুরির ঘটনা ফাঁস হওয়ার আগেই। তিনি একাধিক দেশের পাসপোর্টধারী বলেও জানিয়েছে ইনকোয়ারার।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • বাদল ১৬ মার্চ, ২০১৬, ১১:৫৪ এএম says : 0
    টাকা ফেরত আনতেই হবে। না হয় যারা এর সাথে জড়িত তাদেরকে এই টাকা দিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • মিলন ১৬ মার্চ, ২০১৬, ১১:৫৪ এএম says : 0
    আসল অপরাধী কারা সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Nasir Uddin ১৬ মার্চ, ২০১৬, ১১:৫৮ এএম says : 0
    kaw ke jeno bolir patha banano na hoy
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডিজিটাল চুরি বড় পরিবর্তন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ